পুরোনো, অতি ব্যাবহারে জীর্ণ সব জিনিসের জন্য ভীষণ মায়া আমার। একটা পুরোনো ভাঙা বাড়ি, যার কিনা আসল রঙ বোঝা যায়না, দেখলেই মনে হয় কাছে গিয়ে একটু কথা বলি। জিজ্ঞেস করি, তোমার গল্পটা আমাকে বলবে ভাই?
এইসব পুরোনো ব্যাপার আমার ভালো লাগে কারণ সব পুরোনো জিনিসেরই একটা গল্প থাকে। এই যেমন, আমার অনেক আগে কেনা ছেঁড়াখোঁড়া একটা বই এক বন্ধু হারিয়ে ফেললো। সাথে সাথে এর পেছনের গল্পটা, যেখানে আমি বইয়ের ভেতর ছোট্ট একটা দাগ কেটেছিলাম বলে বইটা একজনের অনেক প্রিয় হয়ে গিয়েছিলো, তাও হারিয়ে গেল। বন্ধু আমাকে নতুন একটা বই কিনে দিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু সেই গল্পটা তো আর কোনোদিনই পাওয়া গেলো না! সেদিন তেমনই একটা গল্প শেষ হয়ে যেতে যেতে বেঁচে গেল। গল্পটা, না গল্পগুলা আমার একমাত্র ছাতার।
ছ-সাত বছর আগে আমি স্কুলবাসে করে স্কুলে যেতাম। তখন আমার একটাও ছাতা ছিলোনা। স্কুলবাসে গেলে ছাতার প্রয়োজন হওয়ার কথাও না। কিন্তু এক বর্ষাকালে আমার বাসার মানুষজন একটা আজব জিনিস আবিষ্কার করলো। স্কুলবাস নিয়ম করে আমাকে প্রতিদিন বাসার সামনে থেকে স্কুলের ভেতর পর্যন্ত পৌঁছে দিলেও আমি প্রতিদিনই কাকভেজা হয়ে বাসায় ফিরতাম আর তার থেকে ঠান্ডা, জ্বর ইত্যাদি ইত্যাদি। ঘটনার তদন্তের জন্য ৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হল এবং নানা প্রশ্নে আমাকে জেরবার করা হল। আমি তখন উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমার একটা ছাতা নেই বলেই তো এই দুরবস্থা। ভাবুন তো ব্যাপারটা, ছাতার অভাবে প্রতিদিন জ্বর বাঁধিয়ে ঘরে ফেরা কিরকম আলোড়ন সৃষ্টি করলো! আমাদের সব কিছু কেনা বিশেষজ্ঞ মামাকে নির্দেশ দেয়া হলো আগামী শুক্রবারেই আমার জন্য একটা ছাতা কিনে আনতে। মামা নানান কিছু দেখে, শুঁকে শেষ পর্যন্ত আমার জন্য একটা কালো ছাতা নিয়ে আসলো।
নতুন ছাতা পেয়ে খুশি হব কি আমি পড়লাম মহা বিপদে। ছাতা নেই অজুহাতে প্রতিদিন বৃষ্টিতে ভেজার সুযোগটা যে একেবারেই বন্ধ হতে চললো! তবে আমাকে সবাই খুব ভুলোমনা বলে জানে কি না তাই বেশি একটা সমস্যাও হলো না। প্রতিদিনই ছাতা নিয়ে যেতে ভুলে যাওয়া আমার অভ্যাস হয়ে গেল আর আমাকে ছাতা কিনে দেয়াটা যে আসলে কোন লাভজনক প্রকল্প ছিলোনা তা নিয়ে মামা আফসোস করতে লাগলো। মাঝে মাঝে বের হওয়ার সময় ছাতাটার উপর চোখ পড়তো ঠিকই কিন্তু উদাস হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে চলে আসার ক্ষমতাটাও আমার কোন কালেই কম ছিলো না। যতই অবহেলা করি না কেন তার মধ্যেই কিভাবে যেন ছাতাটার সাথে আমার বেশ একটা মায়া-মমতার সম্পর্ক হয়ে গেল। মাঝে মাঝে ছাতাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে যাই, কোন জ্বরাক্রান্ত বেচারা বন্ধুর বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছা জাগলে তাকে ধমক দিয়ে ছাতা ধরিয়ে দিয়ে মনের সুখে বৃষ্টিতে ভিজি।
তখন আমি আর স্কুলবাসে যাইনা। তাই ছাতাটা আমার আরো আপন হয়ে গেল। ছাতা কাঁধে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যখন আমাদের ছায়া ছায়া গলিটা দিয়ে হেঁটে যেতাম তখন জমে থাকা পানিতে লাফালাফি করেই ভেজার সাধ মিটে যেত। তখনো গানটা শুনিনি কিন্তু শুনলে ঠিকই ‘’I’m singing in the rain, just singing in the rain/what a glorious feeling/I’m happy again’’ গাইতে গাইতে যেতাম। তিন জন মিলে একটা রিকশায় যখন স্কুল থেকে ফিরতাম তখন উপরের বন্ধু আমার ছাতাটা ধরেই সবার মাথা রক্ষা করতো। তাতে আমরা যে ভিজে যেতাম না তা নয় কিন্তু নচিকেতার গানটা আমাদের প্রেরণা যোগাতো- ‘রেললাইনে বডি দেব, মাথা দেবনা’! তাছাড়া মাঝে মাঝে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে একটা চিপসের প্যাকেট তিনজন কাড়াকাড়ি করে খাওয়ার সময় তিনজনের মাঝখানে চিপসের প্যাকেট রেখে তাকে এই ছাতাটা দিয়েই রক্ষা করা হত। তবুও কেন যেন চিপসগুলো চুপসে যাবেই আর সেই চুপসানো চিপস নিয়েই যখন আমরা কাড়াকাড়ি করতাম তখন নিশ্চই ছাতাটার খুব হাসি পেত।
আমার ব্যাগে আবার নানারকম বিপদজনক জিনিসের ছড়াছড়ি। কাগজ কাটার অ্যান্টিকাটার, জোড়া লাগানোর আইকা আঠা, পুতুল বানানোর পাটের দড়ি, রঙ গুলানোর সরঞ্জাম ইত্যাদি ইত্যাদি। যদিও আমি খুবই শান্তশিষ্ট, স্কুলে কখনোই আইন অমান্য করে কুটিরশিল্প চর্চা করিনি তারপরও এত সব দামী সহায় সম্পত্তি কিছুতেই বাসায় রেখে যেতে পারতাম না। সেই থেকেই ঘটলো এক দারুণ দুর্ঘটনা, আইকা আঠার কৌটো খুলে ছাতায় সাদা রঙ মাখামাখি হয়ে গেল। তাও আমি লক্ষ্য করলাম বেশ কয়দিন পর। একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে, ছাতাটা খুলতেই চারদিক থেকে হায় হায় রব উঠলো। তৃষার এত সুন্দর কালো ছাতাটায় কলংকের বিরাট বড় সাদা রঙ কে মাখালো!!
এবারো আমি উদাস হওয়ার ভান করলাম বটে, তবে এই প্রশ্নটা কখনোই আমার পিছু ছাড়লো না। তিন বছরের পুরোনো সেই সাদা দাগ দেখে সেদিনও একজন কৌতুহলে প্রশ্ন করেছিলো। বুড়োটে মেরে গেছি তো, তাই এক সাদা দাগের কথা বলতে বলতে ছাতা নিয়ে কত দিনের কত কথা বলে ফেললাম! তখনই খেয়াল হলো, ছাতাটার দুই পাশে দুইটা ডাঁটি ভেঙ্গে পড়েছে আর উপরটাও কেমন ফুটো ফুটো হয়ে গিয়েছে। এতদিন পর আমার ইচ্ছেটা তবে আসলেই সত্যি হলো! ছাতা মাথায় নিয়েই কি সুন্দর ভিজতে ভিজতে ইউনিভার্সিটির পথে হাঁটা ধরলাম।
আবার ধরা পড়ে যেতে হলো। মায়েদের কাছে কিছুই লুকোনো যায়না কিনা! ভাঙা, ফুটো, বিচ্ছিরি একটা ছাতা নিয়ে আমি কিভাবে রাস্তায় বের হই তা নিয়ে মা যারপরনাই অবাক হলেন। আমি যখন সাদা দাগের গল্পের মাহাত্ম্য আর আমার পুরোনো কুটির শিল্প নিয়ে লম্বা একটা বক্তৃতা দিতে যাব তখনই মা ঘোষণা দিয়ে দিলেন, আমার মত মাথা টিং দের গল্প শোনাই বৃথা। মনের দুঃখে বক্তৃতা থামালেও ছাতাটা কিন্তু ঠিকই আমার ব্যাগে থেকে গেল। তবে আমি এখন আর বৃষ্টির মধ্যে কাউকে আমার ছাতায় লিফট দিইনা। তাতে আরো বেশি ভিজে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা!