somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শেষ যাত্রার আগে

০৯ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ১১:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি চলে যাচ্ছি। এই ঘাসে ঢাকা সুন্দর সবুজ দেশটায় আর ফিরে আসবো না। ফিরে আসার মত কেউ নেই আর। কখনো ছিলো হয়তো, তা আর মনে নেই। শুধু মনে আছে যখন এক্কেবারে একা হয়ে গেলাম, তখন আমার পাগল পাগল লাগছিলো। আর সেই পাগলামির মধ্যেই হাতড়ে হাতড়ে, পৃথিবীর ওপ্রান্তে একটা জায়গা খুঁজে পেয়েছি। নতুন একটা জীবন শুরু করবো আমি। বরফঢাকা কনকনে শীতের দেশে।

শীত ব্যাপারটা আমার কখনোই সহ্য হত না। হেমন্তের শুরু থেকে বসন্তের মাঝামাঝি পর্যন্ত কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাতাম। চক্ষুলজ্জার খাতিরে দস্তানা না পরলেও সোয়েটার থেকে বের হওয়া কবজিটা ঠান্ডায় কত কষ্ট পাচ্ছে তা নিয়ে আমার প্রায়ই মনের মধ্যে হাহাকার হতো। সেই শীতকাতুরে, ঘুমকাতুরে আমি একটা বরফের দেশে একা একা চলে যাচ্ছি ভাবতেই কেমন ভয় ভয় লাগছে। তাই সাহস সঞ্চয়ের জন্য ইউনিভার্সিটির দিকে রওনা হলাম। এতবছরের পড়ালেখায়, ফাঁকিবাজিতে, পাশে, ফেলে একসাথে থেকেও আমার কোন বন্ধু নেই। তবুও কেন যে যাই! কলাভবনের সামনে, টিএসসিতে, কার্জন হলের মাঠে ঘাসে বসে কাটানো অনেকটা সময়ের কথা মনে পড়লো। আমার সেই একলা সময়টা কত ভালো কাটতো! এইখানে ঘাসের উপর একটা বই নিয়ে বসে থাকতাম আর হিংসা নিয়ে বড় বড় বন্ধুচক্রের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। বইয়ের উপর যখন হাজার পাতার আর রোদের ঝিলিমিলি, তখন আমি আবার আমার জগতে। আমার ভালো লাগতো সঞ্চয়িতা আর আরেকজনের জীবনানন্দের প্রেমের কবিতা সমগ্র।

ইউনিভার্সিটিতে এসে ডাস এর সামনে রিকশা থেকে নামলাম। এখানে প্রতিদিনই দেখতাম এরকম অনেক পিচ্চি চকলেটওয়ালাদের একজন এসে বললো, আপনে আর আসেন না কেন ছুটি চলতাসে? ফিক করে হেসে বললাম, ছুটি চলতেসে না, আমি আর এইখানে পড়বো না। ক্যান পড়বেননা? মজা লাগলো পিচ্চিটার কথা শুনে। কতদিন আমাকে এরকম আগ্রহ নিয়ে কেউ প্রশ্ন করেনা! বললাম, আমি বিদেশ চলে যাবো তো এইজন্য। এই পিচ্চি যে এত খোঁজখবর রাখে আমি বুঝতেই পারিনি। হঠাৎ প্রশ্ন করলো, ভাইয়াও বিদেশ যাইবো? কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম আমি। মনে পড়লো, এই পিচ্চিকে আরেকজন প্রায়ই আইসক্রীম কিনে দিতো। তাই পাশের আইসক্রীমওয়ালার কাছ থেকে একটা আইসক্রীম কিনে দিলাম ওকে। পিচ্চি আইসক্রীম হাতে নিয়ে বললো, আপা ২টা টাকা দ্যান। আরে আশ্চর্য, আইসক্রীম দিলাম না? আবার ২টাকা দিয়ে কি করবা? পিচ্চি কিছু বলেনা আর ফিক ফিক করে হাসে। আমি একশ টাকার একটা নোট দিয়ে বললাম, এই নাও আর কক্ষণো দিবোনা। সে খুবই গম্ভীর গলায় বললো- আমি জানি। বলেই উধাও।

আমি তখন দেয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে বসে আশেপাশের মানুষের আনাগোনা দেখতে থাকলাম এবং খুবই আতংক নিয়ে আবিষ্কার করলাম মানুষের মনের কথা আমি বুঝতে পারছি। একজন দেখলাম অমুক সাহেবের সাথে এপয়ন্টমেন্ট রক্ষার্থে প্রায় দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছে। আরেকজন কোন এক বদরাগী স্যারের ক্লাস বাঙ্ক করে বীরত্বের সাথে বের হয়ে গেলেও এখন বেশ দোটানার মধ্যে আছে। একজন ফিটফাট মানুষকে দেখে চমকালাম। সে পেশাদার চোর এবং এই মুহূর্তে একটি সম্ভাব্য চুরির স্পট রেকি করতে যাচ্ছে। বাড়ির মালিক খুবই পয়সাওয়ালা এবং তার আলমারির বামপাশের ড্রয়ারটা খুললেই একটা গোপন কুঠুরি পাওয়া যাবে যার মধ্যে লাখ পঞ্চাশেক টাকা রাখা আছে। চুরিটা ২-১ দিনের মধ্যেই করতে হবে কারন এর পরই টাকাগুলো অন্য কাউকে দিয়ে দেয়া হবে। চোর লোকটার টেনশনে আমারো একটু টেনশন লাগলো। তখন আমি দুষ্টু একজনকে দেখলাম। সে তার রুমমেটকে ভয় পাওয়ানোর প্ল্যান করছে। তার মুখে মিচকি হাসি দেখতে দেখতে উঠে পড়লাম। বাসায় আসতে আসতে মনে মনে একটা যুক্তি দাঁড় করিয়েছি, এতদিনের চেনা জগৎ ছেড়ে নতুন একটা জায়গায় যেতে ভয় পাচ্ছি বলে আমার মস্তিষ্ক উল্টোপাল্টা চিন্তা করছে।

জিনিসপত্র কিছুটা গোছগাছ করে বাসার বারান্দায় বসে আছি তখন হঠাৎ চোখে ঝাপসা ঝাপসা লাগলো। তারপর আমি সেই পিচ্চিটাকে দেখতে পেলাম। ১০০ টাকা নিয়ে সে একটা বিরিয়ানির দোকানে গিয়েছে। এক প্যাকেট বিরিয়ানি কিনে লোভে পড়ে একটু খেয়ে ফেললেও বাকিটা সে ঘরে নিয়ে যাবে ভাবছে। মা আর ভাই-বোনদের নিয়ে খাবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘরে যেতে হবে তাকে। নইলে রাস্তার মধ্যেই খাওয়া শেষ হয়ে যাবে। বিরিয়ানি পেয়ে সবাই কত খুশি হবে ভাবতে ভাবতে রাস্তা পার হওয়ার জন্য দৌড় দিলো ছেলেটা। তখনি একটা বাজে গালি শুনতে পেলাম। এক লোকাল বাসের ড্রাইভার সামনে হঠাৎ একটা রাস্তার ছেলে এসে পড়ায় ভীষণ রেগে গেছে। এখন তাকে যত দ্রুত সম্ভব পালিয়ে যেতে হবে। রাস্তা জুড়ে ছেলেটার খাবার আর রক্তের মাখামাখি দেখলাম আমি। কেউ একজন আফসোস করলো, রাস্তাটা পুরো নোংরা হয়ে গেছে দেখে। খুব তাড়াতাড়ি রাস্তা পরিষ্কার করার মানুষজন এসে গেল। জ্যাম লেগে গেছে বলে সবার অস্থিরতা টের পাওয়া যাচ্ছে। বেওয়ারিশ লাশটাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে তা নিয়ে জল্পনা কল্পনা করছে কয়েকজন। বারবার সেই রক্ত আর খাবারে মাখামাখি রাস্তাটা দেখতে দেখতে আমি সংজ্ঞা হারালাম।

অনেক্ষণ পর জেগে উঠলাম আমি। সন্ধ্যা হয়ে গেছে এবং কোথাও থেকে কর্কশ গলার একটা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। বারান্দা থেকে আমার ঘরে ঢুকতে যেয়েই মাথাটা টলে উঠলো। ফ্যান ছেড়ে খাটের উপর বসলাম। চারদিকে আমার বাক্স-প্যাটরা। বারান্দায় বসে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কি বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছি ভেবে অদ্ভূত একটা অনুভূতি হচ্ছিলো। লম্বা একটা গোসল করে রাতের খাওয়া খেয়ে নিতেই পুরো দিনটাকে একটা লম্বা স্বপ্ন মনে হতে থাকলো। শেষবারের মত সবকিছু দেখে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সেই ভোর পাঁচটায় এয়ারপোর্টে যেতে হবে।

কাল রাতে সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখেছি। খুব চেনা চেনা একটা ভঙ্গিতে কেউ একজন আমাকে গান শোনাচ্ছিল আর আমি তালে তালে মাথা দুলাচ্ছিলাম। সেই অনুভূতিটা মাথায় নিয়ে ট্যাক্সি ক্যাবের জানলা দিয়ে শহরটাকে শেষবারের মত দেখে নিচ্ছি। ভোরবেলার জ্যাম ছাড়া শহরটা আমার কতই না ভালো লাগতো! এয়ারপোর্ট থেকে একটু দূরে একটা সিগনালে থামলো ট্যাক্সি। শুনতে পেলাম, আপা ১০০ টাকা দ্যান। অবাক হয়ে পাশে তাকাতেই দেখি কালকের পিচ্চিটা। আগের দিনের ঘটনাকে আমার তখন স্বপ্ন মনে হচ্ছে তাই খুব স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞেস করলাম, ১০০ টাকা দিয়ে কি করবা? হঠাৎ কেমন খনখনে হয়ে গেল ওর গলাটা। তীক্ষ্ণস্বরে বললো, বিরানি খামু। কালকেরটার কি হইসে দেখেন নাই?
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ২:১৯
২২টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×