আশরাফ আজকে খুব সাজুগুজু করেছে। একজন ছেলের পক্ষে যা যা করা সম্ভব আর কি। বান্ধবী ফারিয়ার কাছ থেকে এ ব্যাপারে উপদেশও নিয়েছে।
‘বুঝলি, মেয়েরা ফরমাল কাপড় পরা ছেলেদের খুব পছন্দ করে। পরলে পরবি পাঞ্জাবী নইলে ফুলহাতা শার্ট। সাদা কিংবা ধূসর শার্ট হতে পারে। চুল আবার বেশি ফিটফাট রাখিস না, একটু উস্কোখুস্কো থাকে যেন। আর অতি অবশ্যই ভালো একটা গন্ধ গায়ে মাখবি। আমার আজকাল পছন্দ ওল্ড স্পাইস।’
কি লম্বা লিস্ট রে বাবা! এত কিছু কি মনে থাকে! তারপরো আশরাফ যথেষ্ট সময় নিয়েছে তৈরি হতে। সবুজ পাঞ্জাবী না ধূসর শার্ট, চুল একপাশে আউলাঝাউলা না পুরোটাই, সিদ্ধান্তের কি আর শেষ আছে!! তাও ভালো ফারিয়ারই উপহার দেয়া ওল্ড স্পাইসটা ছিলো। শেষ পর্যন্ত ধূসর ফুলহাতা শার্ট পরে, সূচারুরূপে চুল এলোমেলো করে চারুকলার সামনে হাজির হলো সে। জীবনে এত নার্ভাস লাগেনি। রূপন্তীর জন্য একটু নার্ভাস হওয়া যায় হয়তো!
আশরাফকে আধা ঘন্টা ধরে বুক ঢিবঢিব অবস্থায় রেখে সাড়ে ১০টায় মহারানীর আগমণ। বন্ধুদের টিটিকিরির কথা মনে পড়ে গেলো ওর। এতদিনেও আউট না হওয়া চিরকুমার শেষপর্যন্ত এই কালো মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে! তখন গুনগুন করে গাওয়া গানের কথাও মনে পড়লো। ‘কালো, তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার, কালো হরিণ চোখ।’ হরিণী এসে চোখ তুলে তাকালেন আর মিষ্টি হাসি দিলেন। ‘অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছো বুঝি?।’ প্রেমে পড়লে সব ছেলেরা যেমন করে হাসে তেমন হেঁ হেঁ ছাড়া আর বেশি কিছু বলতে পারলো না ও। রূপন্তী বেশ স্মার্ট এবং স্ট্রেইট ফরোওয়ার্ড, ‘চলো বকুলতলায় গিয়ে বসি।’
বকুলতলায় গুনগুন করতে করতে ও অনেক বকুল কুড়ালো। আশরাফ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছে এমন সময় ফোন বাজলো। এই মিষ্টি গুনগুনের মধ্যে কর্কশ রিংটোন সহ্য করা যায়! দায়িত্ব নিয়ে সে ফোন বন্ধ করলো এবং আবার পন্তীতে মনোযোগ দিলো। এটা ওর দেয়া আদরের নাম। প্রায়ই সে মনে মনে পন্তীর সাথে আহ্লাদী কথা বলে। এখন যেমন বাস্তবের রূপন্তীকে দেখতে দেখতে কল্পনায় বলছে, ‘দেখ তো পন্তী, শার্টের হাতাটা কি এমনই ভালো লাগছে না গুটিয়ে ফেলবো?’
রূপন্তী গুনগুন থামিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘গুটিয়ে ফেলো। এভাবে তো অনেকক্ষণ ধরেই দেখছি।’ ও যে কল্পনার কথা জোরে বলে ফেলেছে আর পন্তী সব জেনে গিয়েছে এই লজ্জায় আশরাফের চোখ সেই যে মাটিতে স্থির হলো আর উপরে উঠলো না! যদি উপরে উঠতো তাহলে সে একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখতে পেত।
মেয়েটা হঠাৎ করেই কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে গেলো। ওর মধ্যে একটা মূর্তি মূর্তি ভাব এসেছে। আশরাফকে ঘোর লাগা গলায় বললো- ‘কালকে কি হয়েছে জানো? আমি একটা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছি।’
- কি স্বপ্ন?
- দেখলাম, আমি সন্ধ্যাবেলা বাসায় ফিরতে গিয়ে ওভারব্রীজের উপর উঠেছি আর খুব সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে।
এতক্ষণে হাহা একটা হাসি দিলো ছেলেটা- কি ভয়ংকর স্বপ্ন রে বাবা! চাঁদ ওঠার সাথে ফুলটুল ফোটেনি তো আবার! তাহলে কিন্তু সাড়ে সর্বনাশ।
একটু অস্থির শোনাল রূপন্তীকে। ‘আহা তুমি বুঝতে পারছো না। চাঁদ দেখে আমি ওখানেই আটকে গেলাম। আর চলতে পারছিলাম না। আমার হঠাৎ, আমার হঠাৎ খুব লাফ দিতে ইচ্ছা করলো।’
- ভয় পেয়োনা মেয়ে। কবি বলেছেন, আমার হঠাৎ মরিবার হইলো সাধ। তার মানে তো এই না যে তিনি সত্যি সত্যি মারা যাবেন। এটা শুধু ভয়ংকর সৌন্দর্যকে প্রকাশ করার চেষ্টা।
- কিন্তু আমি যে লাফ দিলাম!
- স্বপ্নই তো। লাফ দেয়ার পর নিজের বিছানায় ঘুম ভেঙ্গে গেছে না?
হাহাকার করে রূপন্তী বললো- না!
আশরাফ বরাবরই ভীতু টাইপের ছেলে। ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞেস করলো,
- কি হয়েছে তবে?
- আমি অথই জলের মধ্যে পড়ে গেলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি পানিতে ভাসছি।
- তারপর?
- অসংখ্য পাপ আমাকে ঘিরে ধরেছিলো। লোভ, হিংসা, মদ, মাৎসর্য্য পুরোটাই। অনেক কষ্টে নাক ভাসিয়ে রেখেছি আর আস্তে আস্তে আমার শরীর থেকে চুল, চুল থেকে মুখ পাপে ডুবে যেতে থাকলো।
রূপন্তী থরথর করে কাঁপছে। ওর ঠান্ডা হাতটা ধরে আশরাফ বলে চললো, ভয় পেয়োনা পন্তী। ভালো কিছুর কথা ভাবো। ওটা স্রেফ একটা বাজে স্বপ্ন ছিলো।
- ভালো কিছু ছিলো তো। আমি যখন ডুবে যাচ্ছিলাম তখন আমার চোখের ওপর বিশাল একটা চাঁদ ছিলো। কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদ। এই চাঁদ কখনো মেঘে ঢাকা পড়েনা জানো তো?
একটু সহজ হতে পারলো ছেলেটা। আগ্রহ নিয়ে বললো- তাই নাকি?
- হুম। কিন্তু কাল রাতে দুপাশ থেকে দু’দল মেঘ এসে ওকে ঢেকে ফেললো। আমি দারুণ ভয় পেলাম। চিৎকার দিতে গিয়ে ভুলে গেলাম যে আমাকে ভেসে থাকতে হবে।
- তারপর?
- ডুবে গেলাম। কাকচক্ষু পানিতে আমার আর দেখা পাওয়া গেলোনা।
- আহারে মেয়েটা। তারপর?
রূপন্তী হতাশ গলায় হাসলো। এই ছেলেটাকে নিয়ে আর পারা গেলোনা!
- তারপর আর কি! আজ সকালে নীল পানিতে সবুজ জামা নিয়ে ভেসে উঠলাম। সেটা দারুণ একটা ছবি হতে পারতো। কিন্তু বোকা দারোয়ান চাচা চিৎকার দিয়ে বাড়ী মাথায় তুললো আর পানির আলোড়নে শান্ত-সৌম্য ছবিটা নষ্ট হয়ে গেলো।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১:০০