আমরা মেকাপ (সজ্জাকরণ) মুখ দেখে অভ্যস্ত। তবে ইদানিং মেকাপ মুখের চেয়ে মেকাপ হৃদয়ের দেখা মেলে বেশি। মেকি হৃদয়ে সামাজিকতা রক্ষার চেষ্টা সব মানুষের। এ যেন হৃদয় মেকাপ করার দৌড় প্রতিযোগিতা। সজ্জাকরণে হৃদয় যত ভারি হয় বাহির সজ্জাকরণের প্রয়াস তত বাড়ে। ভেতরে কি আছে সেটা বিষয় না, মানুষকে কি দেখানো হলো সেটাই মূল বিষয়। সমাজ এখন মাকাল ফলের মত- উপরে টকটকে লাল কিন্তু ভেতরে কালো কুৎসিত। এ যেনো লোপা মুদ্রা মিত্রের কণ্ঠে গাওয়া সেই গানটির অনুরুপ।
মেঝেতে গর্ত ছিলো এদিক সেদিক নানা মাপে
কিনেছি কার্পেট তাই সস্তা দরে সঠিক মাপে।
অতিথী এলে এখন লুকাইনা মুখ লজ্জাতে হায়
বরংচ খ্যাতি জোটে আমার রুচির প্রশংসায়।
আমরা যে করেই হোক খ্যাতি চাই, প্রশংসা চাই। টাকা দিয়ে হলেও প্রশংসা চাই-ই চাই। বাজারে এখন প্রশংসা বেচা-বিক্রিও হয়। প্রশংসার সার্টিফিকেট দেয়ার জন্য দেশে তো বটেই আন্তর্জাতিক মহলেও অনেক প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে গেছে। যাদের কাজ রুটিনমাফিক প্রশংসা করা আর সুবিধা নেয়া।
সমাজের সব চেয়ে কুৎসিত হৃদয়ের মানুষটি দুর্নীতি, অপরাধ, আর কালো টাকা ঢাকতে মসজিদ, মন্দির, গীর্জা তৈরি করছেন। বাজারের সবচেয়ে দামি গরুটি কিনে কুরবানি দেয়ার প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হতে চাইছেন অনেকে। যতটা পরা যায় নিজেকে ভালো মানুষ হিসেবে জাহির করাটাই আমাদের চেষ্টা। অন্যের কাছে ভালো হওয়ার জন্য অনেক খারাপ কাজ করতেও দ্বিধা হয়না আমাদের। অথচ নিজের কাছেই ভালো হওয়া হয়না কখনো। আমরা আমাদের আত্মা আর হৃদয়ের কাছে শুদ্ধ হতে পারিনা। কার্পেট বিছিয়ে মেঝের গর্ত না ঢেকে সত্যি সত্যি গর্ত পূরণের চেষ্টা করি না। জীবনটাকে যতটা পারা যায় রঙ্গিন কাগজে মুড়িয়ে উপহারের মোড়ক বানাই। কুৎসিত ক্ষত গুলো যেনো কেউ না দেখতে পারে তার জন্য নিজেকে একলা করে রাখি অথবা একলা হয়ে যাই।
সাত’শ কোটি জনসংখ্যার অংশ হয়েও মানুষ বড় একা হয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রের সাথে সখ্যতা বাড়ছে দ্রুত, অন্যদিকে কমছে রক্ত মাংসের মানুষের সাথে হৃদ্যতা। পরস্পরের সাথে আলিঙ্গন করেও দুজনেই ব্যাস্ত হাতে ফোন নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তরুণ তরুণীর ব্যাস্ত সময় কাটে, কাছের মানুষের সাথে যোগাযোগের সময় হয়ে ওঠে না। ফেসবুক টুইটারে কানেক্ট থাকতে গিয়ে মুধুর সম্পর্কগুলো ডিসকানেক্ট হয়ে যায়। গৌতম চট্টোপাধ্যায় ও পল্লব রায়ের কথায় ক্রস উইন্ডস এর গাওয়া ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে/ স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে/ ড্রইংরুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দি’র কথা গুলো বড় সত্য।
ভেবে দেখেছো কি
তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে
তারও দূরে
তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে- গানের এ কথা গুলো মনে করিয়ে দেয় আমাদের ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনাকেই।
প্রেমিকার সাথে প্রেমিক হাটে শুধু পায়ে পায়ে তাল মিলিয়ে হৃদয়ের তাল মেলে না। তাল মেলে না চাওয়া পাওয়ারও। মানুষ খুব স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। কাছের মানুষগুলোকেও আর আপন মনে হয়না। স্বজন হত্যা করাও এখন প্রতিদিনকার খবর। কিছুদিন আগে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিলো ঐশি নামের এক মেয়ের বাবা-মা কে হত্যার বিষয়টি। আদালতে মেয়েটির সাজা হয়েছে কিন্তু এরকম ঘটনা সমাজের দগ দগে ঘা গুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। এর জন্য ঐশি একাই দায়ী নয়, সমাজ ব্যবস্থাও হয়তো দায়ি।
মাদকের টাকা না পেয়ে স্ত্রীর গায়ে আগুন দিচ্ছে স্বামি, কখনো কখনো নৃশংসভাবে হত্যা করছে। দাম্পত্য কলহের জের ধরে স্বামীকে হত্যা করছে কেউ কেউ। সম্পত্তি অথবা দাম্পত্য বিরোধের সূত্রে নিজের শিশুকে হত্যার মতো ঘটনায় জড়াচ্ছে মা-বাবা।
সমাজ যত আধুনিক হবে, সামাজিক ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব ততই বাড়বে- একথাটির বাস্তবতা দেখতে পাচ্ছি আমরা। পারিবারিক মুল্যবোধ কমছে দিন দিন। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতাও বাড়ছে। সমাজের উচ্চবিত্তে পারিবারিক সম্পর্ক এতটাই ঠুনকো হয়ে গেছে যে কে কোথায় কি করছে তার খোঁজ খবর নেয়ারও প্রয়োজন মনে করে না অভিভাবকরা। সর্বপরি ভার্চুয়াল জগতের সম্পর্কে টিকিয়ে রাখতেই আমরা মনোযোগি বেশি। ঘরের মানুষগুলো বোকা বাক্স এ বন্দি হয়ে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:১৮