somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ ছুটে চলা জীবনের বাঁকে

১৭ ই মে, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



কোথায় যাব শুনে নিয়ে চালক বিন্দু মাত্র অপেক্ষা না করে ঝড়ের বেগে টানতে লাগলেন। অবশ্য এতে তাঁর কোন দোষ নেই। কেবলমাত্র রিকশায় উঠলেই আমাদের সময় স্বল্পতা দেখা দেয়।
- মামা আস্তে চালান, সামনে পুলিশ ফাঁড়ি আছে।
- দাঁত বের করে বললেন, কি বলেন মামা, আপনি ছাত্র না? ছাত্রদের পুলিশ আটকায় না।
তার কথা শেষ হতে না হতেই একজন পুলিশ রিকশার গতি রোধ করল।

পরিচয় দিয়ে যাতে দেরি না হয় সেজন্য আইডি কার্ড বাড়িয়ে দিলাম। তিনি সেটা হাতে নিয়ে একপলক দেখলেন। তবে আইডি কার্ডের প্রতি তাঁর তেমন আগ্রহ নেই। তিনি চোখ একবার সরু একবার বড় করে গভীর দৃষ্টিতে আমাকে পরিমাপ করছেন।
- ব্যাগে কি?
- অপরিষ্কার কাপড় চোপড়
আরেকজন পান খেয়ে পিক ফেলতে ফেলতে বেড়িয়ে এলেন।
- কি হয়েছে সগীর?
- ওস্তাদ কাছে আসেন।
তিনি যে ওস্তাদ তা তাঁর ভুঁড়ি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। যেন ভুঁড়ি দেখে র‍্যাঙ্কিং করা হয়েছে।
তিনি আসা মাত্রই কোন কিছু না শুনেই বললেন
- ব্যাগ চেক কর।
সাগরেদ যেন বুকে সাহস ফিরে পেলেন। এতক্ষণ কি করবেন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। তালা দেয়া ব্যাগ টিপেটুপে দেখতে লাগলেন। কিছুক্ষণ হাতড়ে বললেন
- ওস্তাদ!!! বোতল!!!
বুঝলাম শেভিং ফোম কিংবা আফটার শেভ জেল এর কন্টেইনার এ হাত লেগেছে। বিরক্ত হলেও কিছুই করার নেই। ইনারা আবার স্বপ্রনোদিত হয়ে মাদক সাপ্লাই করেন। বেশি কথা বললে মাদক সহ গ্রেপ্তার। দেখা গেল পরদিন সংবাদপত্রে ছবি দেখে মা-বাবাও ভাবছেন ছেলে বোধহয় এসব করে। আর ডলা খেয়ে আমি নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছি।
তারপরও শেষ চেষ্টা করলাম।
- দেখুন ব্যাগ খুললে আপনার কি লাভ হবে জানি না। তবে আমার একটা উপকার হবে আমার আর রেলস্টেশনে যেতে হবে না। রিকশা নিয়ে হলে ফিরতে হবে।
আমার কণ্ঠস্বরে কিংবা বলার ভঙ্গীতে হয়তবা কিছু একটা ছিল, আমাকে আর কোন প্রশ্ন করা হল না। বিনা বাক্য ব্যয়ে যেতে দেয়া হল।

আমার মনে হল এখন থেকে আইডি কার্ড না দিয়ে কণ্ঠস্বরের তীব্রতার উপর ভিত্তি করে সার্টিফিকেট দেয়া উচিৎ।
৭০-৮০ ডেসিবল, রাজনৈতিক নেতা। দেখা মাত্র পুলিশ গার্ড অব অনার দেবে।
৬০-৭০ ডেসিবল,ছাত্র নেতা। এদের দেখলে হাতে বেনসন এন্ড হেজেস তুলে দেয়া হবে। প্রতিটি পুলিশ ফাঁড়িতে সুদৃশ্য লাইটার থাকবে। প্রয়োজন হলে সিগারেটে আগুন ধরিয়ে দেয়া হবে।
৫০-৬০ ডেসিবল, সাধারণ মানুষ। অপমান করা যাবে। যে কোন ধরণের প্রশ্ন করে কালক্ষেপণ করা যাবে। বেশি তেড়িবেড়ি করলে মাদক সহ গ্রেপ্তার। তবে গ্রেপ্তার করলে কতটুকু সমস্যা হতে পারে সেটা চোখ বুলিয়ে পরখ করে নিতে হবে।

মারমুখী ব্যাটসম্যান স্ট্রাইকে আসলে যেমন বোলারের পায়ের গতি কিছুটা কমে যায়, তেমনি আমার বেগতিক অবস্থা দেখে রিকশাওয়ালার গতিও মনে হয় কমে গেছে।

স্টেশনে নেমে শুনলাম ট্রেন লেট হবে। একটা চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিলাম। চোখ বন্ধ করলাম। আশেপাশের পরিবেশ যেন আমাকে জাগিয়ে রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

আমি যেখানে মাথা রেখেছি ঠিক তার অপর পাশে একজন মহিলা কথা বলছেন। তাঁর সুযোগ্য কণ্যা কোন এক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছে সেটা আনতে সৈয়দপুর যেতে হবে তাঁর। সাথে রয়েছেন তাঁর স্বামী, কণ্যা এবং স্বামীর কলিগ। আমি তাদের দেখতে পাচ্ছি না তবে কথা শুনতে পাচ্ছি। স্বামী সম্ভবত কিছু কিনতে গেছেন সেই সময় তিনি কলিগ এর সাথে গল্প করছেন। কথোপকথন নিম্নরূপ।
- ভাই আপনি কি কখনও সৈয়দপুর গেছেন?
- না যাই নি তবে এটা ফরিদপুর, চাঁদপুর ঐ দিকেই হবে।
- ঠিকই বলেছেন, নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে।
আমি লোকটির উপস্থিত বুদ্ধি দেখে মুগ্ধ। সেই সাথে তাঁদের ভূগোল জ্ঞান দেখে যারপর নাই বিস্মিত।

চোখ মেলে তাকালাম। পাখিদের কলকাকলি কিছুটা কমে গেছে। যেন তারাও স্টেশনের লোকজনের মত নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত, কোন দিকে তাকানোর সময় নেই।
আমার সামনে জনা তিনেক তরুণ তরুণী। দেখে মনে হচ্ছে একজন তরুণের গার্লফ্রেন্ড, আরেকজন কোন একজনের বান্ধবী। এ ধরণের পরিস্থিতিতে তরুণদের সর্বজ্ঞ হয়ে ওঠাটাই নিয়ম। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম দেখছি না।
- আমি জানি ট্রেন ২ ঘন্টা লেট হবে
- কি করে জান?
- দেখ হয় কিনা, এসব ট্রেনের নাড়ি-নক্ষত্র আমার জানা
তবে তরুণ মনে হয় নারী ছাড়া কারও প্রশ্নের উত্তর দেয় না। কারণ একজন বয়স্ক ব্যক্তি তার কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দেখলাম বিরক্ত মুখে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। তবে তাকে হতাশ করে আধা ঘন্টার মধ্যে ট্রেন চলে এল। দ্রুত ট্রেনে উঠতে গিয়ে তার মুখের অবস্থা কি হয়েছিল তা দেখার সুযোগ হল না।

টিকিট দেখে সিট খুঁজে পাওয়ার পর দেখি সেখানে একজন মধ্যবয়স্ক নারী বসে আছেন। আমাকে দেখা মাত্রই জানালেন তাঁর গতিজনিত অসুস্থতা আছে তাই যদি কোন সমস্যা না থাকে আমি যেন পাশের সিটে বসি। আমার কোন সমস্যা নেই, তবে নারীদের পাশে ভ্রমণ খুব একটা সুখকর নয়। একবার বাসে পাশে একজন বসেছিলেন, যিনি কিছুক্ষণ পরপর মেহজাবিন কন্ঠে
- ভাইয়া, জানালার গ্লাসটা একটু টেনে দিন না, এত্ত শক্ত!!!
- পর্দাটা একটু ঠিক করে দিন না, বাইরে কি রোদ দেখেছেন!!!
- ভাইয়া, কাইন্ডলি একটা চিপস এর প্যাকেট এনে দিন না!!!
তার ওপর কিছুক্ষণ পরপর আয়না বের করে লিপস্টিক ঠিক করেন আর আয়নার মাধ্যমে আমার চোখের গতিবিধি লক্ষ্য করেন!!! বিরক্তিকর!!!
এ ধরণের মেয়ের পাশে বসে যাওয়ার চেয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া অনেক ভাল। দাঁড়িয়ে গেলে অবশ্য একটু সমস্যা আছে। নিজেকে সেকেন্ড ক্লাস যাত্রী মনে হয়। আর কিছু নারী আছেন যারা কোন কারণ ছাড়াই অপমান করার চেষ্টা করেন। যেমন-
- কি ব্যাপার! এত কাছে দাড়িয়েছেন কেন? একটু সরে দাঁড়ান না!
- একেবারে গায়ের উপর উঠে পড়লেন যে! বলি লজ্জা শরমের কি মাথা খেয়েছেন নাকি?

এসব চিন্তা করেই আগে থেকে টিকিট করে রেখেছি। আমার পাশের যাত্রীকে দেখে অবশ্য এরকম মনে হচ্ছে না।

ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে। কিছুক্ষণ পরপর চায়ের কাপের টুংটাং আওয়াজ পাচ্ছি। চায়ের নেশাকে দূরে ঠেলে দিতে হচ্ছে। এদের ধারণা দুধ, চিনি বেশি দিলেই চা ভাল হয়। চা তৈরি করে মনে হয় লিকার ধোয়া পানি। আর দাম শুনলে মনে হয় অন্য গ্রহ থেকে নিয়ে আসা। তাই চোখ বন্ধ করে থাকাটাই নিরাপদ। কিন্তু কোথা থেকে যেন ফোঁপানোর আওয়াজ আসছে। বাধ্য হয়ে চোখ খুললাম। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আমার পাশে যে ভদ্র মহিলা বসেছেন তিনিই ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। তাঁর চোখে রিডিং গ্লাস এবং হাতে বেশ সুন্দর একটি ডায়েরি। কিছু কিছু নারী চশমা পড়লে অনেক সুন্দর লাগে, ইনিও তাদের মধ্যে একজন। কিন্তু তিনি কাঁদছেন কেন? জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে? তিনি কিছু না বলে ডায়েরিটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। কেন দিলেন আমি জানি না। আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে তিনি নিজেও জানেন কি না। ডায়েরিতে যা লেখা তা হুবুহু নিচে তুলে ধরলাম। স্পষ্ট হস্তাক্ষরে লিখা

লোকটার কথাবার্তা সব সময়ই কেমন যেন হেয়ালি মনে হত, কিন্তু ভাল লাগত। ভাল লাগত তার সব কিছুই। অদ্ভুত সেই ভাল লাগা। কেন ভাল লাগত আজও বুঝি নি।
সুন্দর গান করত, মনকাড়া গান। গানের সুরের বৈচিত্রে এক ধরণের শিহরণ অনুভব করতাম। কখনো মৃদু গুঞ্জন কখনো চড়া সুরের মিশেল গান আমাকে যেন সারাক্ষণ মুগ্ধ আর শিহরিত করে রাখত। গানের অপূর্ব সুর ছিল আমার নিত্যদিনের সঙ্গী।
স্বপ্নের বেলাতেও কেমন একটা শিহরণ জাগানো অনুভূতি হত। চোখ বুজলেই আমি মুহূর্তের মাঝে তার কাছে পৌঁছে যেতাম। যতক্ষণ স্বপ্ন দেখতাম ততক্ষণ মনের ভেতর শান্তি অনুভব করতাম। ঘুম ভেঙ্গে গেলে তার স্পর্শ আর নিজের চোখের পানির লবণাক্ত স্বাদ অনুভব করতাম। তাকে কাছে পাওয়ার ব্যকুলতা আমাকে সবসময়ই তাড়া করত।

ডায়েরিটা তাঁর হাতে ফিরিয়ে দিলাম। তিনি ঘোরলাগা চোখে একবার আমার দিকে তাকালেন তারপর মুখ ফিরিয়ে নিলেন। মানুষের জীবনের সকল আশা-আকাঙ্খা, স্বপ্নের যখন মৃত্যু ঘটে তখন শুধু বিগত দিনের স্মৃতিগুলোকে আকড়ে ধরে বেঁচে থাকা কষ্টকর। জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। সারি সারি গাছ পিছনে ফেলে ট্রেনটি দুর্বার গতিতে সামনে ছুটে চলেছে। যাত্রীদের কিছু দুঃখ পিছনে ফেলে গেলে কি এমন ক্ষতি? কি দরকার সেগুলো সাথে নিয়ে ছুটে চলার?


সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১৪ বিকাল ৪:১২
২১টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×