সে দেখছিল একটি ধুসর পাতা। পতনের ভংগিতে অনেকক্ষন ঝুলে আছে বাতাসে, প্রায় নিশ্চল। একদা ক্লোরোফিল আর সুর্যের যোগসাজশে পুস্টিতে ভরে উঠতো সে, জীবনানুর ভাঁড়ার ছিল তার সবুজ শরীর, ভাবছে সে। জীবন প্রক্রিয়ার দুরহ কিন্ত অনিবার্য চক্রে; তার এবং পাতাটির মধ্যে অন্তঃস্থিত সাজুজ্যের কথা ভেবে তার প্রায় কালো ঠোঁটটি বেঁকে গেছে বাঁ দিকে, খানিকটা হাসির মতো। সে এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে আছে গাবতলির তুমুল ব্যস্ত রাস্তার ভাটিতে এবং অনেক দুরের বহুতল আ্যাপার্টমেন্টের বাদামি শরীর মৃত পাতাটি থেকে তার চোখদুটো লুটে নিয়ে যায়। সে দেখে আ্যাপার্টমেন্টের কোন এক ব্যালকনি থেকে আত্মখুনের ইশতেহর নিয়ে এই মাত্র লাফিয়ে পড়লো একটি শাড়ি, শাদা জমীনের মায়া ছাড়া একদংগল জংলি নীলাভ ফুল দোল খেয়ে ছুটে আসছে ওর দিকে বিভ্রমের কারসাজি নিয়ে। সে পাতাটির কথা বিস্মৃত হয়। পুনর্জন্মের অপেক্ষায় ঝুলতে থাকা শাড়ির খানিক পাশেই ব্রাজিলের সবুজ-হলুদ পতাকা অসময়ে প্রদর্শনির আক্ষেপে স্থির। ও হানিফ কাউন্টারের সামনে এইসব দেখতে দেখতে এলোমেলো হয়ে যায়। অসময়ের ঘুর্নি বাতাসে উড্ডিন মুখ ব্যাদান নিঃস্ব চিপসের মোড়ক আর অনাত্তিয় শহুরে ধুলোবালির আদর উপেক্ষা করে সিগারেট জ্বালানোটা দুরহ হয়ে পড়লে , সে পাশের অস্থায়ি চা-শালায় একটু আড়ালের জন্য দাঁড়ায়। চা-শালাটি তার ভালো লাগে। নোংরা কাপে ফেনিয়ে ওঠা ঘুর্নিতে শাহাবাগ-হেফাজত উপজাত তর্ক-বিতর্ক তার অপেক্ষার সময়টাকে অর্থপুর্ন করে তোলে। এই নোংরা চায়ের কাপের ফেনিল ঘুর্নির মনোটোনাস পুনরাবৃত্তি আরো উপভোগ্য হয়ে ওঠে যখন প্রাক-বিকেলের গাবতলি প্লাবিত করে তাকে। গাবতলি সব সময় তার কাছে বিশেষ কিছু, এর চাইতে হ্যাপেনিং প্লেস আর দুটো আছে কোথাও? তুখোড় ক্লাউনের মতো কন্ডাক্টর টুটাফুটা-ভাংগাচোরা মানুষগুলো খেদিয়ে বাসে উঠাচ্ছে অথবা ছুঁড়ে ফেলছে যত্রতত্র এর মাঝে কোন বস্ত্রবালিকার ধবল বুকের ঘ্রান নিয়ে উড়ে গেল একটা মেরুন ওড়না, গোঁয়ার অটো সিএনজি অন্ধ করে জড়িয়ে গেল নিমিষেই। চারজন অন্ধ-খোঁড়া-বিকৃত-ঝলসানো ভিখিরির দল আর্তির অর্কেস্টা বাজিয়ে চলে গেল দ্রুত, ম্যাজিক কলম বিক্রেতা লোকটি ৮ নাম্বার বাসে উঠতে না পারার হতাশায় স্থবির দাঁড়িয়ে থাকে খানিক । এইসব খুচরো দৃশ্য শিকারে আরো কিছুক্ষন কাটানোর পর তার হাই ওঠে। সে ঘন্টা দেড়েক বা তার বেশি সময় ধরে হানিফ কাউন্টারের সামনে ঘোরাঘুরি করছে তার বড়চাচার অপেক্ষায়। বড়চাচাকে যে বাসটা নিয়ে আসছে, সেটা যমুনা ব্রিজের এপাশে না ওপাশে অপ্রত্যাশিত জ্যামে জমে আছে সে কথাটা কাউন্টারের বিরক্ত ছেলেটা দু'বার জানিয়েছে ওকে। ও বড়চাচার কথা ভাবে। মানুষটা তার ভাই-বোন-স্ত্রী-সন্তানের মৃত্যর মিছিলের বিপরীতে হেঁটে বেঁচে আছেন এখনো।বেঁচে থাকাটা কি তার কাছে বয়ে বেড়ানোর মতো বোঝা হয়ে উঠেছে? তিনি প্রায়ই সাময়িক স্মৃতিহীনতায় আক্রান্ত হন অথবা এটা হতে পারে স্মৃতিপীড়নের হাত থেকে নিস্কৃতির কৌশল। ৭০ পেরুনো একজন মানুষ কাছের সবাইকে হারিয়ে রাধাকান্তপুরের ভিটার পাটচুকিয়ে তার বংশের অবশিস্ট একমাত্র রক্তের ফোঁটার কাছে ফিরতে চাইবেন, এই সাভাবিকতা ফিকে হয়ে যায়, যখন আধুনিক মানুষের বিবিধ টানাপোড়েনের বহুমাত্রিকতা এই শহরে গাঢ় থেকে প্রগাঢ় হয়ে ওঠে। তাদের দেড় কামরার ছোট্ট বাসায় সাময়িক স্মৃতিহীনতায় আক্রান্ত চাচা এঁটে উঠবে কিনা বা তার বৌ বা তার ৪ বছরের মেয়ে বিষয়টা কিভাবে নেবে, এটা সে অনেক ভেবেছে।তার বাবার মৃত্যর পরে আর দেখা হয়নি বড়চাচার সাথে, তা প্রায় বছর পাঁচেক হবে। এর মাঝে তিনি হারিয়েছেন তার একমাত্র ছেলে, মৃত মেজ ভাইয়ের এক মেয়ে, ছোট বোন এবং হয়ত দুরের কাছের আরো কয়েক জন। সে এই বছর পাঁচেকের মধ্যে এইসব মৃত্য বা মৃত্য পরবর্তি কোন স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে, রাধাকান্তপুরে একটি গোপালভোগ আমগাছের সুমিস্ট ছায়ার নিচে লাল টালির ছাদে মোড়া বাড়ির দহলিজে নিজেকে টেনে তুলতে পারেনি, যেখানে তার বড়চাচা স্মৃতিপীড়নের করাত থেকে তার বুড়ো মগজ বাঁচাতে বার বার স্মৃতিহীনতায় ডুবে যেতেন। সময় বা অসময়ে রাধাকান্তপুরে নিজেকে টেনে তুলবার টানটা ঢিলে হয়ে গেছে কোথাও অথবা আসলে এমন কোন টানের অস্তিত্তই গড়ে ওঠেনি ওর ভেতর। তবে টানসুত্রের কারসাজি ছাড়াই বড়চাচা বা রাধাকান্তপুরের কিছু খবরাখবর সে না চাইলেও পেয়ে যেত মাঝে সাঝে। রাধাকান্তপুরে গোপালভোগের সুমিস্ট ছায়ার নিচে লাল টালির নিস্তরংগ ভিটের পেছনে পারিবারিক গোরস্থান ফি বছর নিজের ব্যাপ্তি বাড়িয়েই চলেছে, এই অমোঘ বিস্তারে বিলিন হওয়ার অপেক্ষায় ক্লান্ত হয়ে উনি শেষ-মেষ হাত হানিফ ট্রাভেল্স এর কোন বাসে উঠে পড়েন বংশের শেষ উত্তরাধিকারের নাগাল পেতে। ওর হাই ওঠে।হা এর সাথে ইন্সমনিয়ার টকটক গন্ধ বা সকালের প্রাত্যহিক যুদ্ধে হারতে হারতে কোনরকমে অফিসে পৌছানোর টেনশন বা বড়চাচাকে গাবতলির সমুদ্র থেকে ছেঁকে তুলতে আধাবেলা ছুটির আবেদনে বসের রক্তচক্ষু এবং সবশেষে ঘন্টাদেড়েকের অপেক্ষার ক্লান্তি আলাজিভ কাঁপিয়ে বিস্ফরিত হলে তার একটু ভালো লাগে। এবং এই ভালো লাগার রেশ থাকতে থাকতেই হানিফ ট্রাভেলের একটি বাস এসে দাঁড়ায়। আড়মোড়া এবং অবসাদের পীড়নে যাত্রিরা হয়ত নামতে ভুলে যায় বা কেউ কেউ ভাবে আড়স্ঠ সিটে আরো খানিক ডুবে থাকতে পারলে বেশ হতো। অবশেষে তারা বাঁকাচোরা হয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে বাসটির তপ্ত পেট থেকে। সব শেষে ক্ষিনকায়া যে মেয়েটি বাস থেকে নামলো, তাকে দেখে ওর "অ্যান্টিক্রাইস্ট" মুভির কথা মনে পড়ে। সে কি বিগত জন্মে রুপা নামে তার বন্ধুস্ত্রীর সাথে দেখেছিল সিনেমাটা? উত্থিত শিশ্ন থ্যাঁতলানোর দৃশ্যটা রুপা ব্যাখা করছিল নখ কাটার অবসরে। জানো তো, এই মুভির স্টার্টিংটার মতো স্টানিং শুরু আর কোন মুভির নেই? স্নানঘরে সংগমরত দু'জন আবার একই সময়ে মানে অরগাজমের সময়টাতে ওদের বাচ্চাটাও পড়ে যাচ্ছে জানালা থেকে, স্লো মোশনে....অনেক নিচে।আহ, আর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক টা? ক্ষিনকায়া মেয়েটি ওর শিশ্নে থ্যাঁতলানোর অপার্থিব অনুভুতির জন্ম দিয়ে সেলফোনে কারো সাথে কথা বলতে শুরু করে উঁচু স্বরে। ওর সামনে, হুস-হাস বেরিয়ে যাওয়া বাসগুলোর পটভুমিতে স্থিরচিত্রের মতো এক তরুন। হাতে বায়োপসির রিপোর্ট, সেলফোনে বাবার কন্ঠনালির ক্যানসারের কথা যানাচ্ছে বাসায়, হয়তো বোন বা ভাই কে, মাকে জানানো যাবে না এক্ষুনি, ফোঁপানির অবসরে জানায় সে। কচুরিপানার ফুল, বেত বনে বেজির চকিত চাহনি, ইশ্কুল গেটে আট আনার চাটনি, একপেয়ে শালিক সবকিছু ঠিকরে পড়ছে ছেলেটার গা থেকে। তার কান্না মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে মানুষ, মুখ ফরসাকারি ক্রিমের বিগ্গাপনের গাড়ি আর একটা প্রতি বিপ্লবী কুকুর। এই ছেলে, তোমার বাবা কি জানে স্বেচ্ছামৃত্যর কথা? বাইরে কিন্ত অনেক আন্দোলন হচ্ছে এটা নিয়ে, প্রত্যেকের অধিকার আছে তার নিজের জীবন আলেখ্যের উপসংহার লেখার, তুমি কি মানো সেটা?ওহ, অলরেডি প্ল্যান করে ফেলেছো, অবশিস্ট জমিটুকু আর ভিটে বেচে দেয়ার?
কতটুকু গেলে আরেকটি জন্মের দরকার হয় ফেরবার জন্য? কার কবিতার লাইন এটা, শক্তি'র? ও কি কখনও কবিতায় ছিল? সে আরেকটা সিগারেট ধরাতে গিয়ে দেখলো ম্যাচের কাঠি ফুরিয়েছে।ও রাধাকান্তপুরের কথা ভাবে, সবসময়ের অচেনা আর অবেলায় ঘুম ভাংগার মতো বিষাদগ্রস্থ।
"কেরে অনু?"
"আমি রবি, চাচা।"
"অ।"
তিনি "অ" বলে তার সাময়িক স্মৃতিহীনতার আপাতঃ সর্পিলতা থেকে সরে আসতেন আর ও ভেবে ভেবে কুল পেত না অনুটা কে! অনু কি খন্জনার মৃত পালকে ফসিল হয়ে গেছে? অনুর পাঠশালায় বড় চাচা তাকে একলা ফেলে চলে গেলে সে সারাদিন গোপালভোগ আমগাছটির সাথে কথা বলে কাটিয়ে দেয়।
ও ভাবে; দেড় কামরার বাসায় বড় চাচা ঘুরে ঘুরে অনুকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন, না পেয়ে নেমে গেলেন রাস্তায়। পুরানো ঢাকার ল্যাবিরিন্থে অনু কি কোন চিন্হ রেখে গিয়েছিল? ওর বউ আর মেয়ের দম ফেলার অপরিসর জায়গাটুকু বড়চাচার বেডপ্যান আর মফস্বলি হাতব্যাগের দখলে চলে যাবে, এই আশংকায় অনুর ভাবনা গৌন হয়ে যায়। ফি হপ্তায় ডাক্তার দেখাও, গু-মুত-ব্লাড সুগার-কোলস্টরল এর টেস্ট গিলে খাবে মাসের বিশটা দিন। তো, হাত পাতো অফিস কলিগ এর কাছে অথবা একটা ডার্ক সাইক্লোজিক্যাল থ্রিলার দেখো রুপার সাথে বন্ধুর অফিস ট্যুর এর অবসরে, প্রশংসা করো ওর মেলাঙ্কোলিক যোনির! ওর সেলফোনে এই মুহুর্তে রুপার একটি অপঠিত এসএমএস জমে আছে, কোরিয়ান রিভেন্জ মুভি দেখার আমন্ত্রন। মাস খানেকের লিবিডোহীনতা এইসব ভাবনার প্ররোচনায় নড়ে চড়ে উঠলে ওর ভালো লাগে। দুটো স্কুলফেরতা বালক হানিফ কাউন্টারের সামনে প্রাক্তন পর্নস্টারের হিন্দি মুভিতে ক্লিভেজ প্রদর্শনির কথা বলতে বলতে প্রগলভ হয়ে ওঠে। ওরা গাবতলির বিবষিময়তা উপেক্ষা করে পরস্পরের সেলফোনে পর্নক্লিপ ট্রান্সফারে ব্রতি হলে ওর স্বমেহনকালের মোহন মুহুর্তগুলোর কথা মনে পড়ে। বালকেরা এরপর ইউটিউবে জেমস ফলির মাথাকাটার দৃশ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়লে ও হানিফ কাউন্টারে উঁকি দেয় এবং জানতে পারে বড়চাচাবাহী বাসটা মির্জাপুরের কাছাকাছি ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্সে মুখ থুবড়ে পড়েছে পাশের গভির জলায়। ও খানিকক্ষন স্থবিরতায় বুঁদ হয়ে থাকে। দুর্ঘটনা পরবর্তি বিপর্যস্ততা হঠাৎ করেই ওকে ভারমুক্ত করে দেয়। ওর একঘেয়ে অপেক্ষার তো শেষ হলো! ও আরেকটু হালকা হয় যখন ভাবে; ওদের দেড়-কামরার বাসায় দমফেলার অপরিসর জায়গা আর বেমাক্কা দখলে নিতে পারবে না বড়চাচা। খুব টানাটানির হিসেব করা খরচের খাতায় বড়চাচা বাবদ বাড়তি কিছু যোগ করতে হবে না ভেবে আরেকটা অতিরিক্ত সিগারেট খাওয়ার তিয়াস বেড়ে যায় ওর। এই যে হুট করে বাসটা অ্যাকসিডেন্ট করে ওর অপেক্ষার সময়টা শেষ করে খানিক অবসরের সুজোগ করে দিল, এই অপ্রত্যাশিত অবসর নিয়ে কি করবে ও?
২।
স্নানের মোহন সময়টাতে তুমি নিজেকে চিনে নিলে আরেকটু অথবা ভেজাচুলে বুরুশ চালাতে চালাতে, আয়নার ওপারে নাকের বাঁ পাশের শুকতারার মতো তিলটির লুকোচুরিতে হারাতে হারাতে, তোমার মনে হতে পারে, খুব তুচ্ছ কিছুর জন্য মরে যেতে পারো তুমি। অথবা, ধরো, গভির ঘুমের ভেতর মুখে আংগুল পুরে চেখে নিলে অমল শৈশবের স্বাদ। একটু একা তুমি হতেই পারো।
রুপা তো সবটায় একা। মধ্যদিনের অপ্রকাশিত রোদের নিচে মাথা হেট বাড়িগুলো কী এক আক্ষেপে অনুজ্বল হয়ে গেলে, পোষা বেড়ালটা ঘুমিয়ে গেলে, মন খারাপের পোস্টার-ফেস্টুনে মহল্লার অপরিসর রাস্তার দুপাশ ভরে উঠলে রুপার আরো একা হতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে জানালার কাঁচে নাক চেপে ওপাশের বিষাদগ্রস্থতাকে প্রগাঢ় হতে দেখে। পাঁচতলার ওপর থেকে গলিটাকে ওর মনে হয় সেই কৈশরের নীল ফিতের মতো আঁকাবাকা, মোচড়ানো, অকালে রং হারিয়ে ফিকে আর ম্রিয়মান। এই ফ্যাকাশে নীল ফিতে বেয়ে উঠে আসে মুরগিওয়ালার হাঁক এঈ মুরগিঈঈ, চাবি সারাইয়ের ঝনঝন, সবুজের স্তুপ নিয়ে তরকারি ভ্যান এমন কি গলায় জাদুকরী বাক্স ঝুলিয়ে শনপাপড়ীওয়ালা পর্যন্ত। রুপা ভাবে চোখের ভুল, এই পোড়া শহরে কোত্থেকে আসবে অপার্থিবনম্রমিস্টির পালক? আশে পাশের বাড়ির জানালগুলোর সখ্যতা এমন যে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। প্রতিটি জানালায় কতো মুখ, একেকটা মুখের পেছনে কতো বিচিত্রতা। শুধু পশ্চিমের ঝকমকে কিন্তু খটমটে নামের আ্যাপার্টমেন্টটার কাঁধ ঘেসে পুরনো চারতলা যে বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে কোনমতে, সেটার চারতলার গাঢ় কমলা রংগের জানালাটা সে বন্ধই দেখছে এ বাসায় আসা অব্দি। ঐ জানালাটা রংগিন প্রহেলিকার বিগ্গাপন হয়ে ওকে প্ররোচিত করে প্রায়, চারপাশের মুখর জানালগুলোর মাঝে কমলা জানালাটা একটা আশ্চর্য প্রশ্নবোধক হয়েই থাকে।
তো, রুপার একলা হওয়ার জানালাটি ওর স্বামীরও খুব পছন্দের। ওর যখন খুব ইচ্ছে জানালার কাঁচে নাক-গাল চেপে ঐ দুরের নিঃসংগ গাঢ় কমলা রংগের বন্ধ জানালাটা দেখতে, অপেক্ষা করতে ; কখন আলগোছে পাঁজর খুলে দেবে, ঠিক তখনই সেটা ওর স্বামীর শুন্য চোখের দখলে চলে যাবে। ছুটির সকালে রকিং চেয়ারটায় বসে জানালার ওপারে ছুঁড়ে দেবে নিজেকে। মরচে রংগের আকাশ, বিসদৃশ্য দালানের জড়াজড়ি, হঠাৎ আছড়ে পড়া হাইড্রলিক হর্ন এইসব তার শুন্য চোখে কোন কাঁপন না তুলেই মিলিয়ে যায়।
রুপার বসার ঘরে মেঝেতে নিজেকে মেলে দেয়। ঘরটা কী দারুন অগোছালো! মনখারাপের মৃদু গন্ধ কী মিস্টি আর মায়াঘনো! রুপার সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করে; কোরিয়ানরা কী দারুন দারুন সব সিনেমা বানায় প্রতিশোধস্পৃহতার! ওর স্বামী খানিক আগে ফোন করে বললো মির্জাপুরের কাছে একটা বাস অ্যাকসিডেন্ট করেছে, ওর কোন আত্মিয় নাকি আসার কথা ছিল, অনেক হতাহত, ও অফিস থেকে ডিরেক্ট চলে যাচ্ছে মির্জাপুরে। রুপা অনুর কথা ভাবে, অনুর সাথে আরো একা হওয়ার কথা ভাবে। ঢাকা-মির্জাপুরের আসা-যাওয়ার দুরত্ত আর রোড অ্যাকসিডেন্ট এর বিপর্যস্ততায় যে অবসরটুকু পাওয়া গেল সেটায় সে একটি কোরিয়ান রিভেন্জ মুভি দেখার কথা ভাবে!