বাঙলাদেশের একজন সুহৃদ ব্যাক্তি এডওয়ার্ড এম. কেনেডি; স্মৃতি।
এডওয়ার্ড এম. কেনেডি বাংলাদেশের পরীক্ষিত সুহৃদ ও বন্ধু ব্যাক্তি। তিনি বর্তমান বিশ্বের অন্যতম লব্ধ প্রতিষ্ঠিত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়-এর একজন গ্রাডুয়েট শিক্ষিত ব্যাক্তিত্ব । তিনি গত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে আমেরিকা যুক্ত রাষ্ট্রের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। এডওয়ার্ড এম. কেনেডি ছিলেন যুক্ত রাষ্ট্রের দূরদর্শি, বিচক্ষন এবং অন্যতম প্রবীন রাজনীতিবিদ। ইরাক যুদ্ধ নিয়ে মিথ্যা, বানোয়াট এবং ভুল যুদ্ধের বিরুদ্ধে। ইরাক যুদ্ধে যখন আলোচনা করা হয় তখন এই যুদ্ধ যারা তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলেন তাদের অন্যতম ও প্রথম ছিলেন এই এডওয়ার্ড এম. কেনেডি। আরো দুজন সিনেটর যুক্ত রাষ্ট্রের সিনেটে প্রতিবাদ করে স্বাক্ষরদান থেকে বিরিত ছিলেন; (১) ওয়েষ্ট ভার্জিনিয়ার সিনেটর বার্ড ও (২) ইলিনয়-এর তখনকার সিনেটর ও বিগত প্রেসিডেণ্ট বারাক হোসাইন ওবামা। আরও একজন প্রবীন রাজনৈতিক; ফোর্ড (কিছুদিন আগে প্র্যয়াত)। ভ্যাটিকান সিটি থেকে সরাসরি ‘হোয়াইট হাউস’-এ ফোন করেছিলেন আরও একজন প্রয়াত পোপ জন পল (২য়)। তিনিও ইরাক যুদ্ধে না যেতে বলেছিলেন মাতাল-মদখোর বুশ (জুনিয়র)-কে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
যে ইরাক যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল মাতাল-মদখোর জর্জ ডব্লিউ. বুশ (জুনিয়র)-এর ললাটে পাদুকা মনিহার নিঃক্ষেপের মাধ্যমে। যে দৃশ্য সারা বিশ্বের মানুষ টেলিভিশনের পর্দায় প্রতক্ষ করেছিল। বর্মান বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি আমেরিকা যুক্ত রাষ্ট্র এবং এর শক্তিশালী সংসদ ক্যপিটাল-হিল। সেই সংসদে গত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে দোদন্ড দাপটে পদাচরনা করে এসেছেন এডওয়ার্ড এম. কেনেডি। তার জীবদ্দশায় ১০৯টি নতুন আইন প্রনেতার জল-জ্বলন্ত স্বাক্ষর তিনি। তাই এডওয়ার্ড এম. কেনেডিকে বলা হয় কিংবদন্তী কেনেডি।
আমেরিকা যুক্ত রাষ্ট্র-এর সংবিধান প্রনয়ন হয় ১৭৮৯ সালে। সেই সংবিধেনে গত অর্ধ শতাব্দী ধরে জনকল্যানে সংবিধান সংসোধিত হবার দুর্লভ সদ্ধিক্ষনে এডওয়ার্ড এম. কেনেডি-এর অনন্য অবদান। মানব কল্যানে তার অনন্য অবদানের জন্য ইংল্যান্ডের সর্বোচ্য রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘নাইটহুড’ নামক বিরল সম্মানে অলংকৃত করা হয়। তাই ক্যাপিটাল হিলে সবার কাছে এডওয়ার্ড এম. কেনেডি ছিল সিংহ পুরুষ সিনেটর। এডওয়ার্ড এম. কেনেডি একমাত্র সিনেটর হেলথ কেয়ার, ইমিগ্রেশন শুধু নয় বরং যুক্ত রাষ্ট্রের প্রতিটি যুদ্ধের সময়ে মার্কিন সৈন্যের পরিবারে সরাসরি টেলিফোন করে ব্যাক্তিগতভাবে খোজখবর নিতেন। তাদের সুখ দুঃখকে নিজের সুখ ও দুঃখের মত মনে করতেন। বারাক ওবামা যখন প্রেসিটেন্ড পদে প্রচন্ড প্রতিদ্বন্দিতা করছিলেন; তখন তিনি অনিশ্চিত, দ্বিধা, দ্বন্ধে সংকিত। বারাক ওবামা কি সত্যিই ডেমোক্রাটিক পার্টি থেকে প্রার্থী হতে পারবেন কিনা (!) ঠিক এমনই একটি যুগসন্ধিক্ষনে এডওয়ার্ড এম. কেনেডি দিয়েছিলেন সিনেটর বারাক ওবামাকে অকুন্ঠ সমর্থন। এডওয়ার্ড এম. কেনেডি তার জীবদ্দশায় বারাক ওবামর মতো কালো একজন মানুষকে আমেরিকা যুক্ত রাষ্ট্রের অবিস্মরনীয় বিজয় সাফল্য প্রেসিডিন্ট প্রতক্ষ করেছিলেন। তিনি প্রতক্ষ করেছিলেন তার অকুন্ঠ জনসমর্থন বৃথা যায় নি।
এবার আসাযাক বাংলাদেশের সমন্ধে এডওয়ার্ড এম. কেনেডি-এর অবদান সম্পর্কেঃ বাংলাদেশের মানুষের স্বাধিকার আন্দোলনের সংগ্রাম আজকের নয়। তা বহু যুগের। আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অতিপ্রাচীন। বাঙ্গালী জাতির ইতিহাস সহস্র বছরের প্রাচীন। বাংলাদেশের আজকের স্বাধীনতার জন্য অনেক রক্ত, অনেক তিতিক্ষা, অনেক দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল। তেমনি একটি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দিনে পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন এডওয়ার্ড এম. কেনেডি বাংলাদেশী জনগণের সমর্থনে। তিনি বাংলাদেশী মানুষের জন্য দিয়েছিলেন অকুণ্ঠ সমর্থন। কিংবদন্তি কেনেডি তদানীন্তন মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে বাংলাদেশের হতভাগ্য মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই দুর্দিনে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মানুষদের একজন পরীক্ষিত অকৃত্রিম বন্ধু। সেই দুর্দিনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁন তাকে ঢাকা যাওয়ার ভিসা প্রদান করে নি নিরাপত্তা ঝুঁকির দোহাই দিয়ে। তাই তিনি ভারত হয়ে পশ্চিমবাংলার বাংলাদেশি শরণার্থী শিবির প্রত্যক্ষ করে এসেছিলেন। সেই সময় বাংলাদেশের মানুষের কি দুর্বিষহ দুঃখ জ্বালা, দুঃখ কষ্ট প্রত্যক্ষ করে এসেছিলেন। তিনি আমাদের স্বাধীনতা এবং আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে একটি বৃক্ষের চারা রোপণ করে এসেছিলেন তখন। আজ এডওয়ার্ড কেনেডি আমাদের মাঝে নেই। তিনি পরপারে স্বর্গলোকে চলে গেছেন । বাংলাদেশে তার নিজ হাতে রোপন করা চাড়া গাছটি একটি পূর্ণাঙ্গ গাছে রূপান্তরিত হয়েছে। শাখা-প্রশাখা মেলে মর্তের বুকে যেন কেনেডির স্মৃতিকেই আগলে ধরে রেখেছে।
এডওয়ার্ড এম. কেনেডি হারিয়ে যাননি, কেনেডি লক্ষ-কোটি বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে বেঁচে ছিলেন বেঁচে আছেন। বেঁচে থাকবেন। এডওয়ার্ড এম. কেনেডি-এর জীবদ্দশায় বাবা, মা, ভাই, ভ্রাতুষ্পুত্র সবাইকে হারিয়েছেশ। শূন্য পরিবার এ এক অপূরণীয় ক্ষতির কঠিন দায়িত্ব যুবক এডওয়ার্ড এম. কেনেডির স্কন্ধে অর্পিত হয়েছিল। সেই অর্পিত দায়িত্ব স্কন্ধে তার এবং ভাইদের রেখে যাওয়া অসম্পূর্ণ দায়িত্ব, দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র-এর সমাজ এবং রাষ্ট্রের। এরকম বিভিন্ন সমস্যা একজন নবীন সিনেটর হিসেবে পাহাড় সমতুল্য দায়িত্বভার বয়েছিলেন বাকি জীবন। একদিকে ছিল পারিবারিক শূন্যতা, সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট অন্য দিকে ছিল জনগণ তথা দেশের অর্থনৈতিক, যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল সমস্যা। সীমাহীন সমুদ্রের সমস্যা। তাই অবসরের সীমাহীন নীল জল রাশিতে পালতোলা নৌকায় ভেসে বেড়াতেন এডওয়ার্ড এম. কেনেডি। গভীর সমুদ্রের জলরাশির সঙ্গে তার একটি সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছিলেন। কেনেডি পরিবারের ভার একাকী বইতে গিয়ে তিনি ছিলেন ক্লান্ত, শ্রান্ত, অবসন্ন। তিনি জীবনের শেষ সময় ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত হলেন। সেই ব্রেইন টিউমার ক্যান্সার এর রূপ নিল। সেই ক্যান্সার তার ব্রেইন কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়ল। তিনি হাসপাতালে ছিলেন দুই মাসের অধিক সংজ্ঞাহীন। জীবন-প্রদীপ যেন দিন দিন অনিশ্চিত হল।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়-
একদিন এই দেখা হয়ে যাবে শেষ,
পড়িবে নয়ন পরে অন্তি নিমেষ।
……………………………………………
সেই কথা স্মরণ করি নিখিলের পানে
আমি আজি চেয়ে আছি উৎসুক নয়নে
যাহাকিছু হেরি চোখে কিছু তুচ্ছ নয়
সকলই দুর্লভ বলে আজ মনে হয়।
এডওয়ার্ড এম. কেনেডি ছিলেন বাংলাদেশের একজন পরীক্ষিত অকৃত্রিম সুহৃদ বন্ধু।
তাই আবারও কবিগুরুর কন্ঠে বলতে হয়ঃ
মৃত্যুর পূর্বে পৃথিবীর সব কিছু দুর্লভ মনে হয়।
মনে হয় দুর্লভ এ জীবন
দুর্লভ এ ধরনীর লেশতম স্থান,
দুর্লভ এ জগতের ব্যার্থতম প্রাণ।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বিশাল একটি দেশ। বিশাল তাদের হৃদয় এত বড় এত বড় মাপের নেতা, তবুও আকাশের মত উদার। এত উঁচু মাপের একজন মানুষ তবুও মাটির মতো নিরহংকার।
এত শক্তিশালী, তবু বিনয়ী। এত সাধারন তাই বুঝি এত অসাধারণ।
মৃত্যুর মুহূর্তে তুচ্ছতম প্রার্থনা তার কাছে ছিল দুর্লভ। কৃতজ্ঞতার ঋনে আপ্লুত হয়েছিলেন কেনেডি পরিবার।
শ্বেত পাথরের তৈরি লিঙ্কন মেমোরিয়াল। তাঁর সম্মুখে লিঙ্কন ব্রিজ ডান দিকে মোড় নিলেই প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি এবং প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল রবার্ট কেনেডির সমাধী। তার পাশেই এডওয়ার্ড এম কেনেডির সমাধি। সেখানেই জলছে অনির্বাণ শিখা। তার চতুর্দিকে গভীর অরণ্যে ঘেরা। সেখানে অজস্র পাখি ডাকছে তারপাশেই পটোম্যাক নদি। নদির তীর ঘেঁষে অসংখ্য চেরী ফুলের গাছ। শীতের হিমেল হাওয়া বইছে, অজস্র পাতা ঝরে পড়ছে নদীর বুকে। সেই সাথে ঝরে পড়ছে চেরি ফুল। আর কিছুদিন পরেই প্রচন্ড শীতে নদীর পানি জমে কঠিন বরফ পাথর হবে। তখন প্রকৃতি বদলে যাবে। বদলে যাবে মৌসুম। বদলে যাবে আজকের এই ধরিত্রী। শুধু বদলে যাবে না এডওয়ার্ড এম. কেনেডি এবং হারিয়ে যাবে না কেনেডি পরিবারের স্মৃতি। আমরা বাংলাদেশীরা আজ হতে অনেক অনেক বছর পরে যখন ইতিহাসের পাতা উল্টাবে তখন আমাদের মনে চির সম্মানের সাথে স্মরণ হবে এক সহৃদ বন্ধুত্বের কথা আমাদের অকৃত্রিম বন্ধুর স্মৃতি।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




