ফাদার স্যামানকে লোকেরা ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে মান্য করতো। তিনি ছিলেন জাগতিক পাপ-পুণ্য বিষয়ে বিশারদ এবং স্বর্গ-নরক ও কবরের শাস্তি বিধান সম্পর্কিত শাস্ত্রে সুপণ্ডিত।
ফাদার স্যামানের কাজ ছিল উত্তর লেবাননের গ্রামে গ্রামান্তরে সফর করা এবং ধর্মীয় আদর্শ প্রচারের মাধ্যমে লোকদেরকে পাপাসক্তি থেকে মুক্ত করা, আর শয়তানের প্রভাব থেকে রক্ষা করা। মাননীয় ফাদার অহরহ শয়তানের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। কৃষকরা তাঁর কাছ থেকে উপদেশ ক্রয়ের জন্য ব্যাকুল থাকতো। প্রত্যেক মৌসুমে তারা তাদের উৎপন্ন উৎকৃষ্ট ফল ফুল তাঁকে উপহার দিত।
শরৎকালের এক বিকেলে ফাদার স্যামান একাকী হেঁটে চলেছিলেন নির্জন গ্রামীণ পথ বেয়ে। পথটি ছিল জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি উপত্যকার মধ্য দিয়ে। হঠাৎ তিনি পথের পাশের একটি গর্ত থেকে ভেসে আসা করুণ ক্রন্দন শুনতে পেলেন। থমকে দাঁড়িয়ে তিনি শব্দের উৎসের দিকে লক্ষ্য করলেন এবং একজন বিবস্ত্র লোককে শায়িত দেখতে পেলেন। তার মস্তক ও বক্ষদেশের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছে। সে কাতরোক্তি করে চলেছেঃ আমাকে বাঁচাও, আমাকে সাহায্য করো। আমার প্রতি সদয় হও, আমি মারা যাচ্ছি – ফাদার স্যামান কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো তার দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলে উঠলেনঃ নিশ্চয় এই ব্যক্তি চোর ডাকাত... সম্ভবত কোনো পথিকের ওপর হামলা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে এবং কারো হাতে আহত হয়েছে। আমি ভয় পাচ্ছি, লোকটি এখন মারা গেলে আমাকেই হত্যাকারী বলে অভিযুক্ত করা হতে পারে।
এ-রকম পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে তিনি আবার পথ চলতে শুরু করলেন। কিন্তু মরণোন্মুখ লোকটি তাঁকে থামিয়ে দিল। ব্যাকুলভাবে সে বলে উঠলোঃ আমাকে ফেলে যেও না, আমি মারা যাচ্ছি।–ফাদার আবার ভাবতে লাগলেন এবং আর্তের সেবায় নিজের মধ্যে অনীহার উদ্রেক হওয়ায় অনুতপ্ত হলেন। তাঁর ঠোটে কম্পন দেখা দিল। তবু তিনি স্বগতোক্তি করে উঠলেনঃ নিশ্চিতই এই লোকটি বঞ্জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো কোনো উন্মাদ। তার শরীরের ক্ষতগুলো দেখে আমার খুব ভয় করছে, আমি এর কি প্রতিকার করতে পারি? আমি তো নিতান্তই মানুষের আত্মিক রোগের চিকিৎসক।–ফাদার স্যামান কয়েক পা এগিয়ে গেলেন নিজের পথে! সেই মহূর্তে মরণোন্মুখ লোকটি এমন আর্তনাদ করে উঠলো যে সে শব্দে পাষাণ হৃদয়ও বিগলিত হয়। হাঁপাতে হাঁপাতে সে বললোঃ এসো, আমার কাছে এসো। আমরা বহুকালের মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ। তুমি মহান যাজক ফাদার স্যামান। আর আমি চোরডাকাতও নই। উন্মাদও নই। আমার কাছে এসো। আমাকে এই বিজন পথের ধারে মরতে দিও না। এসো, আমি তোমাকে বলবো আমার সঠিক পরিচয়।
ফাদার স্যামান লোকটির কাছে গেলেন। নতমুখী হয়ে একদৃষ্টিতে তাকালেন তার দিকে। তিনি দেখতে পেলেন এক বিপরীতধর্মী মুখাবয়ব। দেখলেন শঠতাযুক্ত বুদ্ধিমত্তা, সুষমাযুক্ত নোংরামী এবং নম্রতাযুক্ত নষ্টামি। সেই মুহূর্তে তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন এবং প্রশ্ন করলেনঃ কে তুমি?
মরণোন্মুখ লোকটি আর্তস্বরে বললোঃ আমাকে তোমার কোনো ভয় নেই, ফাদার! আমরা যে বহুকালের অন্তরঙ্গ বন্ধু। আমাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করো। কাছাকাছি কোনো ঝর্ণার ধারে নিয়ে চলো, আমার ক্ষতস্থানগুলো ধুয়ে মুছে দাও তোমার নরম বস্ত্রখণ্ড দিয়ে।
ফাদার আবারও জানতে চাইলেনঃ কিন্তু আমাকে তুমি বলো, সত্যি কে তুমি? আমি যে তোমাকে চিনতে পারছি না। এমন কি, জীবনে তোমাকে কোনোদি ন দেখেছি বলেও মনে পড়ছে না আমার।
উত্তরে অত্যন্ত কাতরভাবে লোকটি বললোঃ অবশ্যই তুমি আমার পরিচয় জানো। হাজার বার তুমি আমাকে দেখেছ এবং প্রতিদিনই তুমি আমার সম্পর্কে আলোচনা করে থাকো...তোমার কাছে আমি তোমার নিজের জীবনের চেয়ে অধিকতর প্রিয়। এবারে ফাদার লোকটিকে তিরস্কার করলেন। বললেনঃ তুমি একজন মিথ্যাবাদী প্রতারক। তুমি এখন মরতে বসেছ,তবু সত্য কথা বলছ না।...আমার জীবনকালে কোনোদিনই আমি তোমার এই পাপ-মুখ চোখে দেখিনি। সত্যি করে বলো তুমি কে, কি তোমার পরিচয়। না-হয় তুমি তোমার অজ্ঞাত পরিচয় নিয়েই মরো।
আহত লোকটি একটু নড়ে চড়ে উঠলোএবং ধর্মযাজকের চোখে চোখে তাকালো। তার ঠোঁটে ফুটে উঠলো রহস্যময় হাসি। শান্ত গভীর সুষম কণ্ঠে সে বললোঃ আমি শয়তান।
এই ভীতিকর কথাটি শুনেই ফাদার স্যামান বিকট চিৎকার করে উঠলেন। সেই শব্দে উপত্যকার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত কেঁপে উঠলো। এবারে তিনি লক্ষ্য করে দেখলেন এবং মরণোন্মুখ লোকটিকে চিনতে পারলেন। এরই তো চিত্রকল্প, ঠিক এ রকম বিকৃত অবয়ব শয়তানের প্রতিকৃতি গ্রামের গীর্জার দেয়ালে টাঙানো আছে। তিনি শিহরিত হলেন এবং উচ্চকণ্ঠে বলতে লাগ্লেনঃ ঈশ্বর আমাকে তোমার পাপ-মুখ দেখালেন। আমি তোমাকে ঘৃণা করি। তুমি অভিশপ্ত, তুমি ধ্বংস হও। এখন আমার কর্তব্যই হচ্ছে, তোমাকে ধ্বংস করা, তোমার পাপ যেনো অন্যের মধ্যে সংক্রমিত হতে না পারে।
উত্তরে শয়তান বললোঃ একটু থামো ফাদার, শূন্যগর্ভ কথা বলে সময় নষ্ট করো না...আমার কাছে এসো, তাড়াতাড়ি আমার ক্ষতস্থানগুলো বেঁধে দাও, রক্তপাতে আমি যেনো মারা না পড়ি।
তাচ্ছিল্যভরে উত্তর দিলেন ধর্মযাজকঃ যে হাত ঈশ্বরের প্রতি প্রসারিত, সে হাত তো পাপের শরীরকে পারে না স্পর্শ করতে...তোমাকে মরতেই হবে-কালের কণ্ঠনিসৃত অভিশাপে, মানবতার ওষ্ঠপুটে উচ্চারিত অভিসম্পাতে। মানবতার শত্রু এবং ধর্মের বিনাশ সাধনই তোমার কর্মব্রত, একথা সবাই জানে।
শয়তান তীব্র যন্ত্রণায় নড়ে উঠলো। কনুই-এর উপর ভর করে মাথা তুললো। বললোঃ তুমি বুঝতে পারছ না, তুমি কি বলছো। কিছুই তুমি ধারণা করতে পারছো না, নিজের প্রতি কি অপরাধ করছ। মন দিয়ে শোনো, আমি সব কথা খুলে বলছি। আজ আমি একাকী এই নির্জন বনভূমিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। ঠিক এখানটায় এসে যখন পৌছলাম, তখন একদল দেবদূত নেমে এলো আমাকে আক্রমন করতে। তারা আমাকে ভীষণ জোরে আঘাত করলো। আমি ওদেরকে ঠেকাতে পারতাম। শুধু পারিনি ওদের মধ্যে একজনের জন্যে, তার হাতে ছিলো একখানা দৈবিক ধারাল তরোয়াল। সেই তীক্ষ্ণ তরোয়ালের আঘাত ঠেকানোর ক্ষমতা আমার ছিল না।
শয়তান কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো এবং নিজের কাঁপা কাঁপা হাত শরীরের গভীর ক্ষতস্থানে স্থাপন করলো। আবার বলতে শুরু করলোঃ সেই অস্ত্রধারী দেবদূত, নিশ্চয়ই মিকাইল-সে হচ্ছে দক্ষ অস্ত্রবিদ। সে মুহূর্তে আমি যদি ধরাশায়ী না হতাম এবং মড়ার ভান না করতাম, তাহলে সে আমাকে নির্মনভাবে টুকরো টুকরো করে মারতো।
সশস্ত্র জয়োল্লাসের সঙ্গে ঊর্ধ্বনেত্র হলেন ফাদার স্যামান। বললেনঃ মহান মিকাইলের নাম আশিস-ধন্য হোক। তিনি জঘন্য শত্রুর হাত থেকে মানবতাকে রক্ষা করলেন।
প্রতিবাদে শয়তান বলতে লাগ্লোঃ মানবতার প্রতি আমার অবজ্ঞা তোমার নিজের প্রতি নিজের ঘৃণার চেয়ে তীব্রতর নয়। তুমি মিকাইলকে সাধুবাদ জানাচ্ছ, সে তো কোনোদিন আসেনি তোমাকে উদ্ধার করতে। আমাকে তুমি অভিসম্পাত দিচ্ছ আমার পরাজয়ের মুহূর্তে, যদিও বরাবরই তোমার শান্তি ও সুখের উৎস হিসেবে আমি ছিলাম, আমি আছি। তুমি আমার কল্যান কামনা করতে চাও না, আমার প্রতি দয়া প্রদর্শনে তোমার অনীহা, অথচ আমার অস্তিত্বের ছায়ার মধ্যেই তোমার জীবনের সমৃদ্ধি। আমার অস্তিত্বের কারণেই তুমি সৃষ্টি করেছ তোমার আত্মোপ্রতিষ্ঠার উপযোগী একটি কৈফিয়ৎ এবং অনুকূল পরিবেশ। তোমার কাজকর্মের যৌক্তিকতা হিসেবে তুমি তো ব্যবহার করে থাকো আমারই নাম। অতীতের মতোই বর্তমানে এবং ভবিষ্যতেও আমার অস্তিত্ব অটুট থাকা কি তোমার নিজের জন্যে প্রয়োজনীয় নয়? তুমি কি তোমার আকাঙ্ক্ষিত রাশিরাশি সম্পদ সঞ্চয় করে ফেলেছ? আমার অস্তিত্বের ভয় দেখিয়ে তোমার অনুসারীদের কাছ থেকে আরো স্বর্ণ রৌপ্য উসুল করে নেয়া কি আর সম্ভব নয়, লক্ষ্য করেছ?
তুমি কি বুঝতে পারো না, আমার মৃত্যু হলে তোমাকেও না খেয়ে মরতে হবে? আজ আমাকে এভাবে মরতে দিলে আগামীকাল তোমার কি উপায় হবে? ঈশ্বরকে পাবার জন্যে কার বিরুদ্ধে তুমি মন্ত্রপাঠ করবে, যদি আমার নামই উহ্য থাকে? যুগ যুগ ধরে তুমি এই গ্রামীণ জনপদে বিচরণ করছ এবং আমার খপ্পরে না পড়ার জন্যে লোকদেরকে সতর্ক করছ। তারা তাদের কষ্টার্জিত টাকাকড়ি আর হাড়ভাঙা খাটুনি দ্বারা উৎপাদিত ফসলের বিনিময়ে ক্রয় করছে তোমার ধর্মোপদেশ। কিন্তু তারা যখন জানবে, তাদের শত্রুর অস্তিত্বই আর নেই, তখন আগামীকাল তারা তোমার কাছ থেকে কোন ধর্মোপদেশ ক্রয় করবে? আমার সঙ্গে সঙ্গে তোমারও ধর্ম ব্যবসায়ের ঘটবে অপমৃত্যু, কেননা লোকেরা সবাই তখন হবে পাপমুক্ত। একজন ধর্মযাজক হিসেবে তুমি কি বুঝতে পারো না, একমাত্র শয়তানের অস্তিত্বের কারণেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ধর্মমন্দির? সেই প্রাচীন সংঘাত, যার দৌরাত্বে বিশ্বাসীদের উপার্জিত সোনাদানা কায়েমীভাবে এসে সঞ্চিত হচ্ছে ধর্মযাজক ও প্রচারকের থলিতে। কেমন করে তুমি আমাকে মরতে দেবে, যখন তুমি নিশ্চিত জানো যে, এতে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে তোমার সম্মান, তোমার মন্দির, তোমার গৃহস্থালী এবং তোমার জীবিকা?
.............................................(এর পরবর্তী অংশের জন্যে দেখুন শয়তানঃ২য় অংশ)
মূল বইয়ের নামঃ শয়তান
লেখকঃ খলিল জিবরান
অনুবাদঃ বেলাল মোহাম্মদ
প্রকাশনীঃ মাওলা ব্রাদার্স
প্রচার ও প্রকাশনার উদ্যোগঃ মনিরুস সালাম