Almost at half distance, on flight CX830.
পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১
হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল। গ্যাংওয়ের একেবারে শেষ মাথায় লাইন করে দাঁড়িয়ে ছিল ক্যাথে প্যাসিফিক এর কয়েকজন গ্রাউন্ড স্টাফ। তারা যাত্রীদের বোর্ডিং পাস চেক করে করে একেকজনের বাম বাহুতে একেক রঙের একেকটি স্টিকার লাগিয়ে দিচ্ছিল। আবার কারও হাতে কিছুই লাগাচ্ছিল না। পরে আরেকটু নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করে বুঝলাম, তারা যাত্রীদেরকে মোট তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করে নিচ্ছিলঃ এক, যারা নিউ ইয়র্ক যাবে, দুই, যারা টরোন্টো যাবে, আর তিন, যারা আর কোথাও যাবেনা, ওখানেই নেমে যাবে। প্রথমোক্ত দুই শ্রেণির সামনে একজন করে স্টাফ এসে “ফলো মি” বলে হাঁটা শুরু করলো। আমাদের যিনি লীডার ছিলেন, তিনি লম্বায় প্রায় ছয় ফুট দুই ইঞ্চির মত হবেন, বয়স হয়তো বিশের শেষ অথবা ত্রিশের কোঠার শুরুতে হবে। তিনি কোন দিকে না তাকিয়ে লম্বা কদমে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছিলেন। তার সাথে তাল মিলাতে গিয়ে অনেকেই হাঁপিয়ে উঠছিলেন। আমি এ বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি সবিনয়ে বললেন, “sir, we are running behind schedule; just take a little longer and quicker steps”. যাহোক দূরত্বটা খুব বেশি ছিল না, তাই রক্ষা! সিকিউরিটি চেকপয়েন্টে এসে তিনি আমাদেরকে একজন মহিলার কাছে হস্তান্তর করলেন, যার তত্ত্বাবধানে খুব দ্রুতই আমাদের সিকিউরিটি চেক সম্পন্ন হলো। অবশেষে প্লেনে নির্দিষ্ট আসন গ্রহণ করে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাচলাম! মাত্র ত্রিশ মিনিটের মধ্যে নিউ ইয়র্কগামী সকল যাত্রীর ট্রান্সফার সুসম্পন্ন হলো।
এত দৌড়াদৌড়ি ও টেনশনের কারণে খুব ক্ষুধা পেয়েছিল। টিকেট কাটার সময়েই আমরা ফুড চয়েস দিয়ে রেখেছিলাম। নির্ধারিত সময়ের আধ ঘণ্টা বিলম্বে প্লেন টেক-অফ করলো। টেক-অফ এর কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন বিমানবালা এসে আমাদের দু’জনের নাম ধরে পরিচয় নিশ্চিত হলেন এবং আমাদের দেয়া ফুড চয়েস অনুযায়ী দুটো ফুড ট্রে দিয়ে গেলেন, যেটার উপরে আমাদের নাম লেখা ছিল। সবার আগে তিনি আমাদেরকেই খাবার দিয়ে গেলেন, বাকিদের টেবিলে তখনো কিছু দেয়া হয়নি। তবে একটু পরেই বাকিদেরকেও লাইন ধরে দেয়া হলো। এরকমটি এর আগে আমি কখনো দেখিনি। এবারে দীর্ঘ একটানা ষোল ঘণ্টার ফ্লাইট। আগের ফ্লাইটে ঠিকমত ঘুম হয়নি। তাই এবারে খেয়ে দেয়ে ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তিন আসনের সারিতে আমার আসন জানালার পাশে, তারপরে আমার স্ত্রীর এবং তার পাশে অন্য একজন মহিলার। হঠাৎ মনে হলো, ওয়াশরুমে যাবার প্রয়োজন হলে এদের দুজনকে তাদের আসন থেকে উঠিয়ে আমাকে যেতে হবে। তাই ওরা জেগে থাকতে থাকতেই আমি ওয়াশরুম অভিমুখে রওনা হলাম। সেখানে গিয়ে দেখি লম্বা লাইন। লাইনের বাইরেও কয়েকজন যাত্রী এবং কেবিন ক্রুদের একটি ছোট দল কী নিয়ে যেন আলাপ করছিল। তাদের পাশে একজন বয়স্কা নারী দাঁড়িয়ে ছিলেন। মনে হলো, তাকে নিয়েই তাদের আলাপ চলছিল।
ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে আমি মনিটর অন করে প্লেনের যাত্রাপথ দেখছিলাম। প্লেনটি প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে উড়ছিল। যাত্রীরা যেন ঠিকমত ঘুমাতে পারেন, সেজন্য বিমানবালারা প্রত্যেক আসনের সারির পাশে এসে জানালার ব্লাইন্ড নামিয়ে দিতে বলে গেলেন। কাজেই দিনের বেলা হলেও বাইরের দৃশ্য দেখার জন্য জানালার ব্লাইন্ড ওঠানোর উপায় নেই। মনিটরে একবার রুটম্যাপ দেখি তো আরেকবার সুইচ করে ককপিট ভিউ দেখি। যাত্রাপথে আমার এগুলো দেখতেই ভালো লাগে, মুভি দেখতে কিংবা গান শুনতে ভালো লাগে না। একসময় ঘুমে চোখ লেগে এলো। নিরবিচ্ছিন্ন কিছুক্ষণ স্বস্তিদায়ক ঘুমের পর একজন বিমানবালার কণ্ঠে নিজের নাম উচ্চারিত হতে শুনে চোখ খুলে তাকালাম। দেখি একজন বিমানবালা আমাকে নাম ধরে ডাকছেন। আমি চোখ খুলে তাকাবার পর তিনি বললেন, “এক্সকিউজ মি, মিস্টার আহসান, আর ইউ ফ্রম দাকা?” আমি হ্যাঁসূচক জবাব দেয়াতে তিনি সংক্ষেপে আমাকে জানালেন যে তারা একজন বাংলাদেশি মহিলা যাত্রীর সাথে কিছুতেই কমিউনিকেট করতে পারছেন না। তিনি কেবিন ক্রুদের জন্য সংরক্ষিত জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে আছেন, কিছুতেই সেখান থেকে নড়ছেন না এবং কিছু বলছেনও না। আমাকে তিনি অনুরোধ করলেন আমি যেন তাদের হয়ে তাকে একটু বাংলায় বুঝিয়ে বলি। আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম তাকে আমার আসনের কাছে এগিয়ে আনার জন্য। তিনি তাই চেষ্টা করলেন, কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছিলাম যে মহিলা একেবারে ‘নট নড়ন নট চরণ’।
সেই বিমানবালা ছিলেন কেবিন ক্রুদের মধ্যে প্রধান। তিনি আবার আমার কাছে এসে অসহায়ের মত বললেন, “উনি একেবারেই নড়ছেন না”। আমি তাকে বললাম, “আপনি কি চান আমি তার কাছে গিয়ে কথা বলি?” উনি সাথে সাথে দুহাত তুলে করজোড়ে নমস্কারের ভঙ্গিতে আমাকে এবং আমার পাশের দুই যাত্রীকে ধন্যবাদ জানালেন এবং মাথা নীচু করে কয়েকবার দুঃখ প্রকাশ করলেন (আসন ছেড়ে ওঠাউঠি করার অসুবিধার জন্য)। আমি উঠে গিয়ে সেই বাংলাদেশি মহিলাকে তার কী অসুবিধা হচ্ছে তা জিজ্ঞেস করলাম। উনি নিরুত্তর। আবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে নিউ ইয়র্কের কোথায়, কার কাছে তিনি যাচ্ছেন। উনি অত্যন্ত ক্ষীণকণ্ঠে জানালেন, একজনের কাছে। এই বলে তিনি হাতের তালু মেলে ধরলেন, সেখানে একটি টেলিফোন নম্বর লেখা ছিল। আমি বিমানবালাকে বললাম সেই নম্বরটি টুকে রাখার জন্য। উনি হয়তো কিভাবে তার সাথে যোগাযোগ করবেন, সে দুশ্চিন্তায় কাতর। বিমানবালা জানালেন, তিনি ইতোমধ্যে সেই নম্বরটির ছবি তুলে স্ক্রীনশট যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে মেইল করে দিয়েছেন।
উনি আমাকে আরও বললেন তাকে আশ্বস্ত করতে যে প্লেন ল্যান্ড করার পর তাদের গ্রাউন্ডস্টাফ তাকে নিয়ে যেভাবেই হোক তার আত্মীয়ের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিবেন। এয়ারপোর্টে অনুবাদক থাকবে, তাই তাকে বুঝতে ও বুঝাতে কোন অসুবিধে হবেনা। আমি তাকে সেই কথাটি বুঝিয়ে বললাম, কিন্তু উনি দৃশ্যতঃ আনইম্প্রেসড! বিড়বিড় করে বললেন, ‘আমি কাইল সকালে ঢাকায় ফেরত যামু গা’। যদিও তখন দিন ছিল, প্লেনের ব্লাইন্ড নামানো থাকার কারণে উনি ভেবেছিলেন তখন রাত্রি। তারপর বিমানবালার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার খুদা পাইছে, আমারে রুটি দাও”। আমি কথাটা অনুবাদ করে দিলাম। বিমানবালা আমাকে বলতে বললেন, তাদের কাছে কোন রুটি নেই, তবে বার্গার, চিকেন এন্ড রাইস, ফিস এন্ড রাইস ইত্যাদি আছে। আমি অনুবাদ করে দেয়াতে তিনি চিকেন চাইলেন। আমি আসনে ফিরে আসার আগে বিমানবালাকে বললাম, Probably she is not in the correct frame of mind for some reasons. So, as a sensitive passenger she might need special handling। বিমানবালা সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন।
অনিচ্ছাকৃতভাবে ক্যাথে প্যাসিফিক এর সাথে সাথে আমাকেও এমন একটি অনাকাঙ্খিত সমস্যার সাথে জড়িত হতে হলো, তবে আমি সাধ্যমত চেষ্টা করেছি যেন উভয়ের সাহায্যে আসতে পারি। আসনে ফিরে এসেও আমি লক্ষ্য রাখছিলাম, পরবর্তীতে কী হয়, তা দেখার জন্য। প্রধান কেবিন ক্রু চরম ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিচ্ছিলেন এবং তাকে সাহায্য করার জন্য অন্যান্য বিমানবালারাও মহিলাকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে নানারকমের কুকিজ, চকলেট এবং ড্রিঙ্কস সামনে মেলে ধরছিলেন। অবশেষে তাদের বিনয় ও সুআচরণ জয়ী হয়েছিল, মহিলা আস্তে আস্তে তার আসনে গিয়ে বসেছিলেন। বিমানবালা ফিরে এসে পুনরায় মাথা নীচু করে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে গেলেন। এমনকি JFK বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর যখন আমি বের হচ্ছিলাম, তখনও আরেকবার তিনি আমার সামনে এসে ঘটনাটির উল্লেখ করে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন।
এভাবেই নানা রকমের অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে আমাদের আকাশযাত্রা প্রায় শেষ হয়ে এলো। ক্যাপ্টেন একসময় ফ্লাইট অবতরণের নোটিশ দিলেন। বিমানবালারা এসে সীটবেল্ট চেক করে ব্লাইন্ড ওঠাতে বললেন। অবতরণের সময় আমি ঝটপট কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। ছকে বাঁধা ক্রম অনুযায়ী একের পর এক পর্যায় পার হয়ে একসময় ইমিগ্রেশন অফিসারের সম্মুখীন হ’লাম। তিনি একজন ভারতীয় বংশোদভূত মহিলা ছিলেন। আমার দিকে কয়েকবার তাকিয়ে তিনি মাথার ক্যাপ সরাতে ও চশমা খুলতে বললেন। তার পাশে থাকা ক্যামেরায় চোখমুখের ছবি তুলে নিয়ে এবং কয়েকটি গৎবাধা প্রশ্ন করে পাসপোর্টে সীল দিয়ে দিলেন। ব্যাগেজ কালেকশন পয়েন্টে এসে দেখি আমার দুটি লাগেজের মধ্যে একটি কে যেন নামিয়ে রেখেছে। অপরটি যখন খুঁজছি, তখন একজন মহিলা পুলিশ (NYPD) এসে আমাকে জানালেন যে তারা একজন যাত্রীকে নিয়ে কিছুটা অসুবিধায় আছেন। আমি তাদেরকে একটু সাহায্য করতে পারি কিনা, তাদের হয়ে কিছু কথা অনুবাদ করে দিতে। আমি রাজী হ’লাম। তার সাথে গিয়ে দেখি প্লেনের সেই মহিলা সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন।
পুলিশ তার কাছে পাসপোর্ট চাইছে, কিন্তু তিনি দেখাচ্ছেন না। আমি তাকে বললাম, উনি একজন পুলিশ অফিসার, আপনাকে সাহায্য করতে চাইছেন। আপনার পাসপোর্ট দেখতে চাইছেন, দেখান। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, “প্লেনে যখন উঠছি, পাসপোর্ট তো আছেই। পাসপোর্ট ছাড়া কি হ্যারা আমারে প্লেনে উঠতে দিত”? এই বলে তিনি ব্যাগ থেকে বের করে পাসপোর্ট দেখালেন। পুলিশ তখন তাকে তার সাথে যেতে বললেন। মহিলা রেগে গিয়ে চীৎকার করে বললেন, “তরা আমারে মাইরালাবি? মাইরালা। কর, গুলি কর’! আমি আর এ কথাগুলো পুলিশকে বললাম না, পুলিশও জানতে চাইলো না তিনি কী বললেন। তবে পুলিশ দৃঢ়কণ্ঠে আমাকে তাকে বুঝিয়ে বলতে বললেন, “Tell her she doesn’t at all need to scream, that’s absolutely unnecessary”। আমি কথাটি মহিলাকে যেমন বুঝিয়ে বললাম, তেমনি পুলিশকেও বললাম সেই কথাটি, যেটি আমি বিমানবালাকে বলেছিলাম। পুলিশের পিছে পিছে মহিলা চলে গেলেন, আমি ফিরে এসে আমার বাকি লাগেজটি সংগ্রহ করে বহির্গমন গেইটের দিকে অগ্রসর হতে থাকলাম।
মনে মনে সেই মহিলার কথা ভেবে মায়া হচ্ছিল। না জানি তিনি কার কাছে যাবার জন্য প্লেনে উঠেছিলেন। কারা তাকে এভাবে একাকী ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন! পুলিশের কাছেও মহিলা বারবার ঢাকা ফেরত যাবার কথা বলছিলেন। একবার তার বুকে ব্যথা ওঠার কথাও বলেছিলেন। হয়তো তার শারীরিক ব্যথার পেছনে বুকের গহীনে আরও অন্য অনেক ব্যথাও লুকায়িত ছিল, কে জানে!
নিউ ইয়র্ক, ইউএসএ
১৩ মে ২০২৪
শব্দ সংখ্যাঃ ১৩২৮
Almost at half distance, on flight CX830.
Atka, an island on the Pacific Ocean enroute our destination.
View from my window side seat, at an altitude of 37000+ feet.
Approaching JFK runway, @13:01, 10 May 2024.
Approaching JFK runway, @13:02, 10 May 2024.
Approaching JFK runway, @13:03, 10 May 2024.
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৫২