somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি হারিয়ে যাওয়া গল্প এবং তারপর...

১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এই হাস্যময়ী, লাস্যময়ী রূপ তার কাছে অচেনা। এই মহিলাই তার বৌ! তার কাছে কেমন কেমন লাগে। দুর্নিবার আকর্ষণ তার অনুভবে তোলপাড় তোলে। আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে লালসার পাখি। আর জাগরণমাত্রই কোমলতার রূপান্তর ঘটে, পাখি হয়ে যায় কর্কশ মিনার। ঋজু, খাঁড়া! কঠিন কংক্রিটে গড়া। এই মিনার আকাশ দেখে না কখনো, সুড়ঙ্গই খুঁজে ফেরে।

এটা একটা গল্পের সূচনা। এ-ফোর আকৃতির কাগজের এক পাশে এটুকুই শুধু লেখা। অপর পাশে অফিসের কিছু কাজ। কবে লিখে রেখেছিল মনে নেই। কী লিখতে চেয়েছিল, শেষটা কিভাবে করতে চেয়েছিল কিচ্ছু মনে নেই। হঠাৎ সেদিন অফিসে দেরাজ পরিষ্কার করতে গিয়ে এটা পেয়েছিল সে। তারপর থেকে অযুতনিযুতবার মনে করার চেষ্টা করেছে গল্পের প্লটটি। কিন্তু কোনো ধারণাই করতে পারছে না। গল্পটা যেন হারিয়ে যাওয়া রাতের স্বপ্নের মতো; সকালে ঘুম থেকে জেগে নানা কাজের ফাঁকে হঠাৎ মনে পড়ে, আরে রাতে না আজ একটা স্বপ্ন দেখলাম! তারপর হাজার চেষ্টা করেও সেই স্বপ্ন আর মনে পড়ে না।

আফসোস লাগে খুব। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। কেন যে দু-চার লাইনে প্লটটি লিখে রাখল না। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। গ্লাসে না ঢেলেই জগ থেকে ঢকঢক করে পানি খায়। অস্থির পায়চারি করে। কিন্তু কিছুই মনে পড়ে না, শুধু আফসোস বাড়ে। মনে হয় গল্পটা একটা মাস্টারপিস হতে পারত।
গল্পের কত প্লটই তো মনে আসে আবার হারিয়েও যায়, মিলিয়ে যায় বৃষ্টির বুদবুদের মতো। কিন্তু কখনোই এমন আফসোস হয় না যেমন হচ্ছে এখন। এই গল্পটার সূচনা সে লিখে রেখেছিল। তারপরও ভুলে গেছে। বিস্মৃতিপ্রবণ মনটার প্রতি তার ক্ষোভ হয়। কেন যে সব কিছু সে ভুলে যায়! শব্দ, নাম, ঠিকানা, কিংবা কোনো ঘটনা, কারও চেহারা, কিছু প্রয়োজন সবই তার ভুলে যাওয়ার তালিকায় উজ্জ্বল। এমনকি বিয়ের পর দীর্ঘদিন ধরে বৌয়ের চেহারাও সে অন্তরস্থ করতে পারেনি। সুতরাং এমন ভুলো মন যার তার উচিত ছিল শুধু শুরুটা না লিখে রেখে গল্পের প্লটটির অন্তত কিছু ইঙ্গিত দু-চার লাইনে দিয়ে রাখা। জন্ম নিতে না পারা সম্ভাবনাময় গল্পটির জন্য তার অনুশোচনা হতে থাকে যেন নিজের বোকামোর কারণেই গর্ভপাত হয়ে গেছে তার গর্ভস্থ শিশুটির।

চোখ বন্ধ করে দুহাতে মাথা চেপে ধরে আরেকবার চেষ্টা করে সে, যদি মনে পড়ে যায়। বিচারক ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেন। উৎসুক চোখ মেলে, কান পেতে উৎকন্ঠিত অপেক্ষা করে এজলাসে উপস্থিত সবাই।


পদ্মা নদী চলতে চলতে বুড়িয়ে যেতে যেতেও যায়নি কোথাও কোথাও; কোনো কোনো ফোকলা দাঁতি বৃদ্ধার মাথাভর্তি কুচকুচে কাল চুলের মতো এখনো যৌবনের উচ্ছলতার রেশ রয়ে গেছে। সেই ছিটেফোঁটা যৌবনের তেজেই টিকতে পারছে না বাঁশবাড়ি গ্রামের মানুষ। প্রতিনিয়ত সে তার কীর্তিনাশা, সর্বনাশা উপাধির বিশুদ্ধতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে। ফলে বলি হচ্ছে জনপদের সকলের স্বপ্ন – আজ কাশেমের ছনের ঘর, কাল নিতাইয়ের পানের বরজ, পরশু মোড়লের কাছারি ঘর; কিছুই রেহাই পায় না - সধবা, বিধবা, এতিম; ফকির, মিসকিন, ধনী; খেলার মাঠ, শস্যক্ষেত, মসজিদ; ধনুকের মতো বাঁকা চিকন পায়ে চলা প্রিয় পথটি, গ্রামের বিশাল বটবৃক্ষটি, এবং একদিন শেষ-বাঁশঝাড়টির সাথে অবশিষ্ট বাঁশবাড়ি গ্রামটিও উধাও হয়ে যায়। বদলে যায় প্রত্যেকের আবাল্য পরিচিত আকাশ। লোকজন তীরে দাঁড়িয়ে দেখায় উই যে উই-ই --- ঐখানে ছিল আমাগো গ্রাম – হায় শুধু জলের ঘূর্ণিই দেখা যায়।
গ্রামের আর সকলের মতোই কপাল পোড়ে মোড়ল মতি মিয়ার। রাতারাতি পদ্মা তাকে আঁখের ছোবড়া বানিয়ে ছাড়ে। মাজাভাঙা গোখরা সাপের মত অক্ষম আক্রোশে মোড়ল ফোঁসফোঁস করেন ভাগ্যের সাথে। তাতে অবশ্য বদলায় না কিছুই। যথারীতি দিনের পরে রাত, রাতের পরে দিন। সময় চলতে থাকে সময়ের নিয়মে।
মাজাভাঙা সাপ মারা বেশ সহজ। সুতরাং মোড়লকে ভাগ্যের হাতে মার খেতেই হয়। ধীরেধীরে ক্রুদ্ধ ফোঁসফোঁসানি বদলে যেতে থাকে। অসহায় বিড়বিড় ধ্বনিতে শোনা যায়, আল্লাহ তুমি আমার মাইয়াডারে বাঁচাও। কিন্তু তার দোয়া কবুল হয় না। কপর্দকহীন মতি মিয়া বাধ্য হয়েই প্রাণের পুত্তলি ইয়ারুনকে অপাত্রে দান করে ডুকরে কাঁদেন। আর জনান্তিকে কাঁদে জয়নাল, ইয়ারুনের অল্পবয়সী গোপন প্রেমিক। চিরদিনের হাস্যময়ী, লাস্যময়ী, খিলখিলে ইয়ারুন চিরকালের জন্য অন্ধকার হয়ে গেলে নতুন পরিবেশে শ্বশুর বাড়ির সবাই ভাবে, নতুন বৌটা সুন্দর তয় বড় আন্ধারমুখী।


বাংলার বিশাল বিশাল বিলের কোনো একটির অন্তর্গত টেকের কথা – টেক মানে উঁচু হয়ে ওঠা প্রান্তর যেখানে গাছপালা, ঝোঁপঝাড়, বনবাদাড় থাকে। বনে থাকে পাখি, কীটপতঙ্গ-ফড়িং-প্রজাপতি; সাপ, গুইল, শিয়াল, খাটাস। চিল চিৎকার করে, ঝিঁঝিঁ ঝিঁকঝিঁক করে, সাপে ব্যাঙ ধরে, ব্যাঙ কাতরায়, খাটাসের ছানাগুলি হুটোপুটি খায়, শিয়ালের দল ফুর্তিতে সারগাম ধরে।

এতসব কোলাহলের মাঝে একদিন কতিপয় মানুষ এসে নৌকায় করে নামল সেই দূরিরটেকে। আর মুহুর্তেই দূরিরটেকের আমজনতা টের পেয়ে যায় – বিপদ! তারা চুপ মেরে যায়। সমস্ত টেকের পরিবেশ থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে অজানা আশংকায়। তারপর অপেক্ষার অবসান ঘটে, দূরিরটেকের আমজনতা চমকে ওঠে, ভয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। হরিৎ টিয়ে উড়ে গিয়ে মগডালে বসে; সাপের মুখ থেকে ব্যাঙ ছুটে যায়; খাটাসের ছানাগুলি মায়ের বুকে মুখ লুকায়; শিয়ালের দল কাঁপতে থাকে ভয়ে; এমনকি গাছেরাও যেন তব্দা খেয়ে যায় এক ভয়ানক মরণ চিৎকারে! ফিনকি দিয়ে রক্ত আকাশের দিকে ছুটে গেলে আকাশ যেন রক্তের দরিয়ায় পরিণত হয়। উষ্ণ রক্তের স্রোত যখন জমাট বেঁধে কালো মেঘ, তখন টেকজুড়ে নামে আলকাতরার মতো অন্ধকার। অন্ধকারে সাহস বাড়ে নিশাচরকুলের। শিয়ালের দল হরিলুটের বাতাসা কুড়াতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে; মহাফুর্তিতে ভুরিভোজের অপ্রত্যাশিত আয়োজনকে স্বাগতম জানায় – হুয়া-হুয়া-হু!

কিন্তু তার পর থেকেই উচারটেকের একটি পরিবার; পরিবারের বড়মেয়েটি, মাত্র উনিশ, হাসতে ভুলে যায়। আহা তার ছিল হাসির অতুল ভাণ্ডার – কুলুকুলু হাসি, কল্লোলিত হাসি, খিলখিলে হাসি; হাসতে হাসতে রিনিঝিনি, হাসতে হাসতে নিক্বণ! মধুরতম, সরলতম হাসির কী ঐশ্বর্যটাই না ছিল। হাস্যময়ী, লাস্যময়ী সেই মেয়েটি, সকলের প্রিয় সেই মেয়েটি হাসতে ভুলে গেলে, লীলায়িত ভঙ্গিতে হাঁটতে ভুলে গেলে বাতাস আর সুরভিত থাকেনা, শীতের কুয়াশা হয়ে ওঠে পুরো টেকের শোকের চাদর। পথের বাঁকে শোকসন্তপ্ত বৃক্ষেরা পত্রমোচন করতে শুরু করে, থেমে যায় পাখিদের আনন্দ সঙ্গীত।


ব্যাপার হল টুম্পামনি আবাল্য প্রেম করে এসেছে ঝন্টির সাথে। বেকার ঝন্টি লোভনীয় চাকরি পেয়ে বাবা-মাকে সাথে করে একদিন টুম্পামনিদের বাড়িতে আসে, ঝন্টির বাবা-মা টুম্পার বাবা-মাকে বেয়াই-বেয়াইন ডাকতে শুরু করে এবং কনেকে আংটি পরিয়ে আশীর্বাদ করে যায়।

ঝুম্পা টুম্পার বড়বোন। শহরের সকল যুবাপুরষের মাথা আউলাঝাউলা হয়ে আছে বিগত সাত-আট বছর ধরে। কারণ আর কিছু না, ঝুম্পার সৌন্দর্যের কিছু মাদক ঘ্রাণ বাতাসে মিশে গেছে শহরজুড়ে। ঝুম্পা-টুম্পাদের বাড়ির চারদিকে দিন নেই, রাত নেই দলেদলে যুবাপতঙ্গরা ভিড় জমিয়ে থাকে অগ্নিতে আত্মাহুতি দেওয়ার আশায়। কিন্তু ঝুম্পার অগ্নিকুণ্ড কার জন্য কেউ জানে না। তবু তারা অক্লান্ত অপেক্ষায় সময় পার করে।

ঝুম্পা মাঝেমাঝে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। পতঙ্গদলের মাঝে গুঞ্জনের একটা ঢেউ ওঠে। ঝুম্পা দেখে কোনোটা ঝিঁঝিঁপোকা, কোনোটা কাঁচপোকা, কোনো-কোনোটা আবার গান্ধিপোকা। আরও কতরকমের পোকামাকড়ের অবয়ব ভেসে ওঠে তার চোখে। সবগুলোই ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে তার দিকে। মৃদু হাসি খেলে যায় তার মুখে। হাত বাড়িয়ে ডাকে এই ঝিঁঝিঁপোকা, কিংবা এই কাঁচপোকা, কিংবা এই গান্ধিপোকা। যদিও সবাই শুনতে পায় এই সোহেল ভাইয়া, কিংবা এই রুবেল ভাইয়া, কিংবা এই খলিল ভাইয়া – আমাকে একটা রিকসা ডেকে দাও না। অমনি উড়ে যায় সব পোকামাকড়ের দল। মোড়ের সব রিকসা মাইকেল শুমাখার হতে ফর্মুলা ওয়ানের ছুট লাগায়।
ঝুম্পা যদি জানালা থেকে মানিককে ডেকে বলে, ভাইয়া আমাদের রিফাতকে কে যেন মেরেছে। অমনি শহরের সব মাস্তান-টাইপ ছেলে অলিগলি খুঁজে শিকার করে ফেলে সেই দুর্যোধনকে।
ঝুম্পা হয়ত ইলিয়াস, ইকবাল, আকরামদের কাউকে ফোন দিয়ে বলে, আমার ভাইয়্যুমনি, আম্মু যে খুব অসুস্থ, ডাক্তারের কাছে নেয়া দরকার। অমনি এ্যাম্বুলেন্সের ভেঁপু বাজে ঝুম্পাদের রাস্তায়।
ঝুম্পা যদি বলে, রফিক দাঁড়া, তোর বুকটা ফেড়ে দেখাতো। নিশ্চিত রফিক কোনো দ্বিরুক্তি করবে না; জানতে চাইবে না, কেন? হাসিমুখে আদেশ পালন করবে।

এহেন ঝুম্পার পাশে টুম্পা দিনের চাঁদের মতোই অনুজ্জ্বল। ঝুম্পা যদি দুপুরের ঝিকিমিকি রোদ, টুম্পা বিকালের ম্লান আলো। ঝুম্পা যদি সমুদ্রের তরঙ্গোচ্ছ্বাস, টুম্পা তবে দীঘির কুলুকুলু। টুম্পা তার মায়াময় বড়বড় ডাগরদুটি চোখ মেলে বড়বোনের কাণ্ডকীর্তি দেখে। ঝুম্পা কারও সাথেই প্রেম করে না অথচ পুরো শহরটাই তার প্রেমিক হয়ে দিনরাত অপেক্ষমাণ। ঝুম্পার মনে কারও জন্যই ভালবাসা নেই অথচ টুম্পার বুকভরা ভালবাসা। সেই ভালবাসার ভার অত্যধিক হয়ে গেলে পুরোটাই সে ঝন্টির উপর ঢেলে দিয়ে নির্ভার হয়ে হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। ঝন্টির মনেহয় টুম্পাটা একটা টুনটুনি, দোয়েল, মৌটুসি – সারাদিন চিউট-চিউট! সারাদিন খুনসুটি!

ঝন্টিরও পতঙ্গ-স্বভাব। তবে সে বাড়ির বাইরে ভিড় করে না ঘরে আসে। আত্মীয়তার অধিকারে ঘরে তার নিত্য যাতায়াত। টুম্পার সাথেই তার সকল লেনাদেনা, ঝুম্পার সাথে বাতচিৎ কম। টুম্পা যখন বড়বড় চোখে ঝন্টির দিকে তাকায় ঝন্টির বেশ লাগে। কেমন ঝিরিঝিরি মৃদু বাতাস। টুম্পা কিন্তু কখনোই মুখ ফুটে ঝন্টিকে তার অনুভূতির কথা বলেনি, তবুও আবাল্য সে ঝন্টির সাথেই প্রেম করেছে। নিয়মিত ঝন্টির অপেক্ষায় থেকেছে, ঝন্টির জন্য সেজেছে, ঝন্টি এলে আন্তরিক খুশি হয়েছে, পুরোটা সময় কাছাকাছি থেকেছে আর নিবিষ্ট মনে ভালবেসেছে।

অবশেষে রাকিব ইমতিয়াজ ওরফে ঝন্টি তার বাবা-মাকে সাথে করে যেদিন টুম্পামনিদের বাড়িতে এল, ঝন্টির বাবা-মা টুম্পার বাবা-মাকে বেয়াই-বেয়াইন ডাকতে শুরু করল এবং কনেকে আংটি পরিয়ে আশীর্বাদ করে গেল, টুম্পা পৃথিবীর সকল বিস্ময় নিয়ে সকলের অগোচরে একবার শুধু রাকিব ইমতিয়াজের দিকে তাকাল। তাকিয়ে উঠে চলে গেল তার ঘরে।
তারপর টুম্পাদের বাড়িতে একটি পাথরের, হ্যাঁ পাথরের মূর্তি আবিষ্কৃত হলে সবাই দেখতে পেয়েছিল ঝিরিঝিরি মৃদু বাতাসের অফুরন্ত উৎসমুখ বন্ধ করে আছে সেই নিষ্প্রাণ পাথর।



আজ এজলাস ভর্তি উৎসুক মানুষের কোলাহল। সবাই ভিড় করেছে খুনির কী শাস্তি হয় শুনতে। রাশভারী বিচারক আসন গ্রহণ করলে ভিড়ের মুখ চুপ হয়ে যায়।
লেখক মাথাতুলে পুরো এজলাসের দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে আনেন। তারপর বিচারকের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করেন নদী-নগর আর টেকের গল্প। হারিয়ে যাওয়া হাসির তিনটি উপাখ্যান। পুরো এজলাসে পিনপতন নীরবতা। লেখক তার বলা শেষ করে আবারও পুরো এজলাসে চোখ ঘুরিয়ে আনেন। মৃদু গুঞ্জন শুরু হয়। সরকারি উকিল প্রশ্ন তোলেন সূচনার সাথে এই আখ্যানত্রয়ের যোগসূত্র থাকার ব্যাপারে। তিনি বলেন, ইওর অনার, প্রবল সম্ভাবনার সেই সূচনার সাথে আদৌ এই আখ্যানত্রয়ের কোনো যোগসূত্র আছে কি? তিনটিই তো আলাদা-আলাদা স্বাধীন গল্প। একজন দায়িত্ববান, সৃষ্টিশীল লেখকের কাছ থেকে সমাজ এটা আশা করে না যে, সম্ভাবনাময় একটি গল্প ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই হত্যা করে, সে হত্যার দায় এড়াতে উল্টাপাল্টা, গাঁজাখুরি সব গল্প তিনি ফেঁদে বসবেন। ইওর অনার, আশা করি আপনার বুঝতে আর বাকি নাই যে, লেখক একটি নৃশংস খুনের ঘটনা সুকৌশলে ধামাচাপা দিতে চাচ্ছেন। অতএব মাননীয় আদালত, আপনার কাছে লেখকের সর্বোচ্চ শাস্তিই কামনা করছি।
আপনার আর কিছু বলার আছে এ ব্যাপারে? লেখকের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করেন বিচারক।

লেখক আবার শুরু করেনঃ
নিষ্প্রাণ বিশটি বছর পর, একদিন এক বিয়ের আসরে আবার বাতাস সুবাসিত হয়ে ওঠে - হারিয়ে যাওয়া হাসির ঘ্রাণ! আবার সোনা রং সূর্য ওঠে – দুচোখের খুশির ঝিলিক! শস্যের ক্ষেত দুলে ওঠে সোনালি ঢেউয়ে – সেই অপরূপ দেহভঙ্গি অবিকল ফিরে আসে।

সুতরাং এই হাস্যময়ী, লাস্যময়ী রূপ মধ্যচল্লিশের লোকটির কাছে অচেনা। এই মহিলাই তার বৌ! ভাবতে অবাক লাগে। দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভবে তোলপাড় তোলে। আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে লালসার পাখি। পাখি হয়ে যায় কর্কশ মিনার। এই মিনার আকাশ দেখে না কখনো, সুড়ঙ্গই খুঁজে ফেরে।
কিন্তু সে আজ কিছুতেই সুড়ঙ্গ হতে রাজি নয়। তার চোখে ভাসে শুধু প্রাণের পুত্তলিটার সুপ্রিয় মুখটি। লাজুক লাজুক হাসিতে মুখটা কেমন নির্ভার! স্বপ্নমাখা! মনপছন্দের জামাই পেয়েছে মেয়ে। সবাই খুব তারিফ করেছে; জামাই নাকি সুপাত্র হয়েছে। ইয়া আল্লাহ, মেয়েটাকে তুমি শান্তি দিও।
তারপর, বিশ বছর পর, হাসিমাখা মুখে ঘুমিয়ে পড়ে ইয়ারুন! ঘুমিয়ে পড়ে টুম্পা! কিংবা সেই স্নিগ্ধ উনিশ! ঘুমন্ত মুখে তার জননীর স্নিগ্ধতা।

লেখকের বলা শেষ হয়। পুরো এজলাসের দিকে আবার ঘুরে তাকান। কিছুক্ষণ স্তব্ধতার পরে শুরু হয় আবার গুঞ্জন।
অর্ডার – অর্ডার – অর্ডার!
গল্পের পরিণতি চমৎকার ইতিবাচকতায় পূর্ণ। উপস্থিত প্রত্যেকে উপভোগ করেছেন আপনার গল্পকথন। এই গল্পে আপনি হারিয়ে যাওয়া হাসিকে আবার উদ্ধার করেছেন। এদিকটি এ গল্পের বিশাল সার্থকতা। উপস্থিত সকলের মুখে দেখতে পাচ্ছি স্মিত হাসির ছটা। আপনার ভুলে যাওয়া গল্পের উদ্ধারে সকলেই সন্তুষ্ট ---

লেখক মাথা নত করে থাকেন। দুচোখের কোল বেয়ে নামতে থাকে ঝর্ণা।
ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে, লেখক সেদিন মুক্তির আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন। কিন্তু সব সত্য কি আর ইতিহাসের পাতায় থাকে ?
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০১৭ রাত ৮:৩৬
১৮টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×