বিকেল বেলা এই রাস্তাটায় হাঁটতে খুব ভালো লাগে । রাস্তার চারপাশে সব গাছপালা । আর মাঝে মাঝে কয়েকটা বিল্ডিং । পুরো রাস্তাটা ছায়ায় ঢাকা । প্রায় সময় হালকা বাতাস থাকে । সব রাস্তায় যদি এইরকম অবস্থা থাকত তাইলে সারাদিন খালি হেঁটে হেঁটেই কাটাইতাম । যদিও এখনও কম হাঁটি না । কিন্তু এরপরও রোদের মধ্যে বেশীক্ষণ হাঁটতে ভালো লাগে না । তার উপর এখন গরমকাল ।
এই রাস্তাটায় হাঁটার সময় আমার মাথায় খালি কবিতা ঘোরে । কবিতা লিখতে ইচ্ছা করে । শুরুও করে দিই । খাতা কলম তো আর থাকে না, তাই মোবাইলের নোটসেই লিখি । ওইটা আমার খাতা কলমের কাজ করে এখন ।
মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে নোটস ওপেন করলাম । মাথায় এখন যেটা ঘুরছে ওইটা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড অভ্রকে নিয়ে । ওই পাগলা টাইপ ছেলেটাকে নিয়ে কয়েকটা লাইন মাথায় আসছে । এমনকি নামটা পর্যন্ত ঠিক করে ফেলছি, অর্থহীন অভ্র ।
“অভ্রকে সবসময় ধূসর হতে হবে এমন তো না
সে তো মাঝে মাঝে নীল আকাশের আল্পনা
কখনো আকাশ নামক বিরাট রাজ্যের নৃপতি
অভ্র কে কি বলা যায়?
আত্মভোলা, স্বাধীনচেতা নাকি অভিমানী?
এ…”
হঠাত মোবাইলটা বেজে উঠল । মাথা পুরা গরম হয়ে গেল । এখন যদি কথা বলি তাহলে যে লাইনগুলা মাথায় এসেছিল ওগুলোর কিছু ছুটে যাবে ।
প্রিয়ন্তি কল করেছে । আমার অনেক অনেক ভালো একটা বন্ধু । ওর সাথে প্রথম পরিচয় ফেসবুকে । প্রায় ৬ মাসের কাছাকাছি হয়ে গেছে ওর সাথে পরিচিত হওয়ার ।
আমি ওই মেয়েটার জন্য অনেক কিছু । আসলে আমাকে অনেক ভালোবাসে মেয়েটা । অনেক ইশারা-ইঙ্গিতে বুঝিয়েছে । কয়েকবার সরাসরিও বলে ফেলেছে, ‘তুই আমার বয়ফ্রেন্ড হবি ?’ কিন্তু আমি ওসব কিছু চিন্তা করিনা কখনো ।
আমি সবার আগে চিন্তা করি যে, ও হিন্দু আর আমি মুসলমান । অন্য সবকিছু মানানো গেলেও এইটা মানানো সম্ভব না আমার পক্ষে ।
ওকেও কয়েকবার বলেছি এ কথা । কিন্তু ও মানতে চায় না । তারপরও একই কথা বলে । আর ও আমাকে বলেছে, ওর খুব শখ মুসলমান ছেলে বিয়ে করার । কিন্তু আমি পারবো না সেই ছেলেটা হতে ।
কলটা রিসিভ করলাম না । কেটে দিলাম । আগে কবিতাটা শেষ করা দরকার । তারপর কল দেবো ।
যেখানে শেষ হয়েছিলো সেইখান থেকে শুরু করলাম আবার ।
“এ তো আর অবাক করা কিছু না যে
অভ্র যা ইচ্ছে তাই করে
অভিমানে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে
স্বাচ্ছন্দ্যে ভেসে বেড়ায় অগোচরে…
কিন্তু তার সবকিছুই অর্থহীন
অর্থের সবরকম অস্তিত্ব অভ্রের চারপাশে অদৃশ্য ।।”
নোটটা সেভ করার সাথে সাথেই কল এল আবার, প্রিয়ন্তি । রিসিভ করলাম ।
- হ্যালো
- কিরে তখন কেটে দিলি কেন?
- ব্যস্ত ছিলাম । কেমন আছিস?
- আর বলিস না, মেজাজ খারাপ ।
- কেন, কি হইল আবার?
- আজকে সিটি কলেজে গেছিলাম ভর্তি হওয়ার জন্য । পোলাপাইন দেখেই দূর থেকে চিল্লাচিল্লি শুরু করছে । বিরক্তিকর…
- সুন্দরী হওয়ার এই এক সমস্যা ।
- আমি সুন্দরী কখন হইলাম?
- ওইটা তো জানিনা । তবে সুন্দরী, ওইটা জানি ।
- হইছে, আর তেল মারতে হবে না ।
- তোমারও আর ভাব নেওয়ার দরকার নাই ।
হাসলো কিছুক্ষণ মেয়েটা । আমি শুনলাম । ভালোই লাগছে শুনতে । হাসি থামার পর বলল,
- ওই চল দেখা করি ।
- তুই তো প্রতিদিনই দেখা করস । এই সপ্তাহে তিনদিন বলছস দেখা করবি । কিন্তু দেখা করার কিছুক্ষণ আগেই তোর এই প্রবলেম হয়, সেই প্রবলেম হয় ।
- এইবার কিন্তু আসলেই করমু । যত প্রবলেমই হোক ।
- শিওর?
- হুম ।
আগামীকাল দেখা করার কথা ঠিকঠাক করে ফোন রাখলাম ।
পরদিন দেখা করতে গেলাম । সত্যি কথা বলতে খুব ভালো কেটেছে সময়টা । কোনখান দিয়ে যে সময়গুলো চলে গেছে টেরই পাইনি ।
আসলে আমার নিজেরও প্রিয়ন্তি মেয়েটাকে ভালো লাগে । ওর সাথে সব শেয়ার করি । কোন কিছুই মুখে আটকাত না ।
ও যদি মুসলমান হত, তাহলে খুব ভালো হত । এমনিতেও আমি একটু সাম্প্রদায়িক । ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু করা আমার পক্ষে মোটেই সম্ভব না । আর আমার বাবা-মা তো ওসব কখনোই মানবে না । আম্মু তো মাঝে মাঝে সরাসরিই বলে দেয় এসব ব্যাপার থেকে দূরে থাকতে । উলটাপালটা কিছু করা থেকে বিরত থাকতে বলে ।
এতসবের বিপক্ষে যেতে পারবো না আমি । আমি আর আগাতে চাইছি না । আমি চাই সম্পর্কটা এখানেই শেষ করে দিতে । এখনও তেমন বেশি কিছু হয়নি । বেশি কিছু হওয়ার আগেই সব কিছু ঠিক করে ফেলতে হবে । কিন্তু আমার প্রিয়ন্তিকেও কষ্ট দিতে ইচ্ছে করছে না । ওর কথা চিন্তা করলে খারাপ লাগে অনেক । আমাকে পাগলের মত ভালোবাসে মেয়েটা । তবে এখনই যদি সব শেষ করে দিই তাহলে হয়ত নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবে মেয়েটা ।
আমার নিজেরও যে খারাপ লাগবে না সেটার নিশ্চয়তা দিতে পারব না । আমি জানি আমার কতটা খারাপ লাগবে । কিন্তু কিছুই করার নেই ।
পরদিন কলেজ থেকে ফিরছিলাম । এক বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল । তখন ওর কাছ থেকে প্রিয়ন্তির সম্পর্কে কিছু কথা শুনলাম । অবশ্যই ভালো কিছু না । যদিও বন্ধুটা জানত না যে প্রিয়ন্তির সাথে আমার সম্পর্ক কতটা ভালো, কতটা গভীর । শুধু জানত আমরা বন্ধু ।
ওর কাছে যা শুনলাম, সেটার সারমর্ম হল, প্রিয়ন্তির সাথে অন্য একটা ছেলের খুব বেশি ভালো সম্পর্ক । শুধু ওই ছেলে না, আরো কয়েকটার সাথে মোটামুটি ভালো সম্পর্ক আছে ।
ও যে ছেলেটার কথা বলল সেটার কথা প্রিয়ন্তি আমাকে বলছিল । তবে এখন মনে হচ্ছে অনেক কিছুই বলেনি ।
ছেলেটার কথা জিজ্ঞেস করলাম । ও বলল, ওর সাথে জাস্ট ফেসবুকে ফ্রেন্ডশীপ । আর কিছুনা ।
আমি বিশ্বাস করতে চাইলাম না । ওকে ওর ফেসবুক আইডির পাসওয়ার্ড দিতে বললাম । দিয়েও দিল মেয়েটা । যদিও আমি যাইনি চেক করতে ।
প্রিয়ন্তি বারবার জানতে চাচ্ছিল কি হয়েছে । সব বলার পর মেয়েটা কাঁদল অনেক । ও বলছিল, ‘প্লিজ আমাকে ভুল বুঝিস না । ওরকম কিছুই নেই । আমি আগে অন্যরকম ছিলাম । তোর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি । এখন আমি আর আগের আমি না ।’
কিন্তু আমি শুনলাম না কিছুই । সব কিছু শেষ করে দেওয়ার মত এরকম সুযোগ আবার কখন পাব জানি না । এমনও হতে পারে, যখন পাব তখন হয়ত অনেক দেরী হয়ে যাবে । যেভাবে হোক, যত কষ্ট হোক, আজকে সব শেষ করে দেব । মেয়েটা কল দিয়ে কাঁদে । আমি কোন কথা বলি না । চুপ করে থাকি । দিন দিন পশুতে রূপান্তরিত হচ্ছি আমি ।
আজকের বিকেলটা একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে । বাতাস বেড়েছে । চারপাশটা একটু বেশিই নির্জন । আমি হাঁটছি আগের মতই । আজ সারাদিনে একটুও হাসিনি । জানি না কেন । হাসতে ইচ্ছা করছে না । কিছু একটা নাই মনে হচ্ছে । পূজা কল করেছে আরো । কেঁদেছে শুধু । আমি কিছুই বলি নাই । পিছুটান মুক্ত করেছি নিজেকে । কিন্তু অতটা খুশি হতে পারছি না ।
আমার কাছে আর কয়েকটা বছর ভিক্ষা চেয়েছে ও । ফ্রেন্ড হয়ে থাকতে বলেছে । কিন্তু ওর কাছে কাছে থাকলে তো নিজেকে আর ধরে রাখতে পারবো না । ওর প্রতি আমার দূর্বলতা যে বেড়েই চলেছে ।
পারব না আমি ফিরে যেতে । যে অধিকার ছেড়ে দিয়েছি সেটা আবার দখলে নেওয়ার কোন ইচ্ছে নেই । আমার জন্য যেটা ভালো ওটা ভেবেছি আমি । অনেক নিষ্ঠুর আমি ।
আজকে আরেকটা কবিতা লিখব আমি । ওকে নিয়ে লেখা আমার শেষ কবিতা হবে এটা । আর কখনও ওকে নিয়ে লিখব না । কখনও না ।
"দরজা খোলা রেখে তুই ঢের বসতে পারিস
উকি মেরে দেখে তুই লুকিয়ে ভুল করিস
জানলার কাচ ঘেসে তুই বৃষ্টি ছুয়ে যাস
পায়ে তোর স্বপ্ন তুই তাও কেন হারাস ?
তোর নুপূর ঘেরা রাতে তুই নোস স্বপ্নরাণী
স্বপ্নের রাজ্য ঘিরে তুই হোস অভিমানী
তোর বায়না ধরা চোখ আমার লুট করেছে সব
তাও তো আমি খুজি আরো কিছু কলরব
তুই তবুও এই শহরটা একটু হাতে নিস
ক্লান্ত সব উদাসে তুই যেন ফিরিয়ে দিস
আজ মেঘলা বিকেলটা তুই সঙ্গে নিয়ে ফির
তোর শ্রাবণ ঘেরা সন্ধ্যে আর ঘরে ফেরা নীড়
আছড়ে পড়া ঢেউ সব না হয় আমার
কাছেই থাক
তুই তো সেই তুই হোস যে জোছনার কোলে রাত"
THE END
(কিছু কথাঃ- লেখাটা আমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড অংকনকে ডেডিকেট করলাম । গল্পটা ওর নিজের জীবনের । আর এই গল্পে লেখা কবিতা দুটোও ওর লেখা ।
কেউ কেউ হয়ত বলতে পারেন যে, ছেলেটা কাপুরুষ । ভালোবাসার মূল্য বোঝে না । ভালোবাসতে পারে না । সাহস নেই ।
ভালোবাসার জন্য সব করতে পারি একথাটা সবাই বলে । কিন্তু করে দেখানোর সময় কয়জন পারে ? আর আমাদের সমাজে এরকম সম্পর্কের টিকে থাকার সম্ভাবনা ১০০% এ ১% আছে কিনা সন্দেহ । তাহলে শুধু শুধু পরে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে শুরুতেই সবকিছু ঠিক করে নেওয়াটা কি অনেক দোষের? একটু ভেবে দেখবেন…)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




