ষষ্ঠ : তুষারের দেশে একলা পথচলা
দেশ থেকে যখন প্রথম এখানে এসেছিলাম, প্রথম কয়েকদিন আমি একটা বাংলাদেশী Family এর সাথে থেকে ছিলাম। যাদের সাথে আমার আগে কোন পরিচয় ছিলনা , তবু থাকতে দেবার মতো এতো বড় সাহায্যটুকু , যেন ছিল অপ্রত্যাশিত পাওয়া।
Flat টা বেশ বড় ছিল। তার পর আবার husband পাশের শহরে চাকুরী করতেন। ভদ্রমহিলা কেবল দুটো baby নিয়ে থাকতেন। স্বামী ভদ্রলোক তাই সারা সপ্তাহের খাবারের ব্যবস্থা করে রেখে যেতেন। প্রথম রাতে অন্তত খাবারের কোন চিন্তা করতে হয়নি। তবে কি- এই নতুন শহরে, একা একটা মানুষ কতটুকু অসহায় তা বলে বোঝানো যাবেনা। আর তাই তো রাতে ঘুমবার একটা জায়গার ব্যবস্থা হওয়া ছিল স্বর্গ পাবার মতো। তবে স্বর্গে বুঝি আন্তরিকতা আর বিবেচনা নামক শব্দটার একটু অভাব ছিল।
সেটাই ছিল, আমার প্রথম দেশের বাহিরে আসা। প্রতি মুহূর্তে একজন মানুষকে শুদ্ধ উচ্চারনে appropriate শব্দটা ভাবতে হচ্ছে , কোন কিছু জানতে পাবার আগে, কোন সাহায্য চাইবার আশায়। অথবা খুজতে হচ্ছে কোন পথ যেখানে Transit system, manner , Weather , চলার রীতি-নীতি- সবই যেন অন্যগ্রহের মতো। যখন তার কাছে মনে হতো , পৃথিবীটাই যেন এক গোলোক ধাঁধা। তারপর আবার নানা কারনে, সেসময়ই খুব দ্রুততার সাথে ব্যবস্থা করতে হয়েছিল একটা থাকার জায়গার।
কোনদিন সকালে হয়তো বের হয়েছি কেবল পাতলা সোয়েটার গায়ে। জানা ছিলনা strong Wind এর জন্য আগের সর্তকীকরন। strong Wind কতোটা strong হতে পারে তা কেবল এইসব মেরু এলাকায় বোঝা যায়। আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানা না থাকলে, এমন দিনে কোন কিছুই করার নেই, ঘরে ফেরা ছাড়া। এসব সমস্যার সম্মুখীন হবার একটাই কারন বাসা খোজা, একা একা।
মনে পরে কোন একদিন, ইউনিভার্সিটির খুব কাছেই একটা বাসা দেখতে যাবার কথা। কোন রকমে বাসা খুজে বের করার পর, আমি আর বাসার ভেতরে ঢোকার সাহস পাইনি , কেবল বাড়িওয়ালার মনোভাব (attitude) দেখে। এখন যদিও জানি এদের দেশটা ছোটখাটো কারনে খুবই নিরাপদ, বিশেষ কিছু এলাকা ছাড়া।
আরো একদিন, ঘন্টা খানেক খোজাখুজির পর যখন বাসা পেলাম, দেখি বাড়িওয়ালী চলে গেছেন আমি এপয়েনমেন্ট মিস্ করেছি বলে। নতুবা অনেক দুরের পথ পারি দিয়ে গিয়েছি, কোন ঘর দেখতে। যেয়ে দেখি বাসায় সিগারেটের গন্ধে টেকা দায়। নতুবা কুকুর বেড়াল, যাদের আকার আমার কোমড় সমান। কোথাও বাসা পচ্ছন্দ হবার পরের দিন গিয়েছি অগ্রীমের টাকা দিতে। টাকা দেওয়া শেষে কি ভেবে আরেকবার ঘর দেখতে যাবার সময় দেখি অন্যঘর থেকে খালি গায়ে- হাফ প্যান্ট পরা এক ছেলে হাসি মুখে বের হয়ে এলো। পরে জানা গেল, তিনি কোন রুমের বাসিন্দার বয়ফ্রেন্ড। তবে সেক্ষেত্রেও বাড়িওয়ালাটি ছিল অসাধারন, কোন কথা না বাড়িয়ে সে আমার টাকা ফেরত দিয়ে ছিল, আমার থাকতে অসুবিধা হবে জানার পর।
দেশ-কালের ব্যবধান ছাড়াও, যে মেয়ের অবসরটা কেবল কাটিয়েছে মায়ের সাথে রান্না ঘরে। ইংলিশ মুভি, ইন্টারনেটে সারাক্ষন সময় পাড় করে দেওয়া হয়নি কোন দিন। যতটুকু কম্পিউটারের ব্যবহার জানা ছিল তা কেবলই লেখাপড়া নির্ভর। তার কাছে ছোট্ট পৃথিবীটা যেন হঠাৎ করেই মহাবিশ্ব হয়ে সামনে দাড়িয়ে ছিলো সেসময় । মনে হয়েছিল, সে যেন শেষ বিকেলের দিশেহারা এক ঝড়া পাতা যেন ।
পৌছবার পরের দিন সকালে প্রথম ক্লাস, তাই ইউনিতে যেতে হবে একা। জানিনা কোন কিছু, চিনিনা এই শহরকে। ইউনিতে পৌছালাম কোন মতে, হাতে কেবল একটা ম্যাপ। দেখা হলো এক পৌড়ের সাথে, যার বদান্যতায় আমার এই সাতসমুদ্র পাড়ি দেয়া, আমার প্রফেসর। অজানা ভালো লাগায় ভরে গেল মন যখন তিনি জানতে চাইলেন সকল কিছু আন্তরিকতায় । আস্থার আরেক প্রকাশ পরিচয়ের পাঁচমিনিটের মাথায়। নিজের ব্যবহারের ল্যাপটপটা যখন দিলেন সাময়িকভাবে কাজ চালানোর জন্য। মনে পরে, বাংলাদেশে ল্যাবের কম্পিটারের পাসওয়ার্ড পেতেও, আমাকে আগে পাশ করতে হয়েছিল ৩টা থিউরী কোর্স আর থিসিসের শেষভাগে এসে ভাইরাসের কারনে কি সমস্যা হওয়ায় সেই কম্পিউটারটাও ছিল ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়া। স্যার আস্থা করতে পারেননি, ইন্টারনেটের পাসওয়ার্ডটি দিতে, ইতিমধ্যে যখন আমার ভর্তির কাগজও হাতে পেয়ে গিয়েছিলাম। আর কত ভাবে আস্থা জয়ের প্রত্যাশা করা যায় একজন মানুষের কাছ থেকে আমার জানা ছিলনা, তাই হয়তো সেদিন থেকে এই পৌড় হয়ে রইলো আমার পৃথিবীর গুটিকতক শ্রোদ্ধাভাজনের মাঝে একজন।
হয়তো এটাও একটা কারন আমার স্বজাতি বিদ্বেষের, আর সাদা চামরা প্রীতির। হ্যা, আমি স্পষ্ট ভাষায় সজাতি বিদ্বেষী, চলার পথে নিজের গোত্রের কারোর সাথে দেখা হয়ে গেলে, অপরপক্ষের পরিচয়ের জন্য আগ্রহ প্রকাশের পর আমার উত্তর কেবলই একটা "ও, আচ্ছা।" তারপরও কোন কথা এলে, কেবল ভেংচি কাটার মতো করে, কৃত্বিম হাসি টেনে রাখা। এর চাইতে একটা শব্দ বেশি ব্যবহারেও আছে আমার অরুচি। অথচ রাস্তায় দাড়ানো কোন বিজাতীয় মানুষের প্রতিও যে সৌজন্যের হাসিটা আমার ঠোটে শোভা পায়, তাতেও আন্তরিকতার ঘাটতি থাকেনা।
এমনি হাজারো কারন আমাকে যেন নিজের অজান্তেই প্রভাবিত করেছিল সেদিন। কোন বিদেশী যেন কোন কারন ছাড়াই আমার সংকোচের ধাপগুলো পার হতে পেরে ছিল অনায়াসে। এ্যলেন এসে ছিল সংস্কারের ঘেরাটোপ থেকে বেড়োনো এক বাঙ্গালী মেয়ের সহানুভূতির ছায়ায়।
[ছবি: নেট থেকে সংগ্রকৃত।]
চলবে....।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


