somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অপেক্ষা

০১ লা নভেম্বর, ২০১১ রাত ৯:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১।
ঘরটির দেয়াল হালকা নীল। জানালা দিয়ে আকাশের চাঁদ দেখা যাচ্ছে। অকৃপণ জোছনার বন্যা এসে আলোয় ভাসিয়ে দিচ্ছে চারদিক। ঘরের আলো নেভানো। জানালার ধারে বসে একমনে নিজের ছায়া দেখছিলো নীলা। বিছানার সাদা ধবধবে চাদরের ওপর যেন কোনো জীবন্ত শিল্পকর্ম সে। ভাঁজ করা হাঁটুর ওপর থুতনি ভর করে এখন একনিষ্ঠ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে নিজের আবছা কালো প্রতিবিম্বের দিকে। তবে দৃষ্টি সেখানে নিবদ্ধ নয়; কোথায় যেন কোন অসীমে হারিয়ে গেছে সে দৃষ্টি। এরকম জোছনাভাসা আলোমাখা রাতে ভালোবাসার মানুষটি সাথে না থাকার বেদনামাখা উদাস সে দৃষ্টি। পায়ের পাতার ওপর ছড়ানো রুপোলী নুপুরের হালকা টুংটাং কখনো জানান দিচ্ছে তার দেহে প্রাণের উপস্থিতির। এমন কোনো জোছনাভাসা রাতের কাদম্বরী দেবীকে নিয়ে কবিগুরু লিখেছিলেন, ‘ওই জানালার কাছে বসে আছে, করতলে রাখি মাথা। তার কোলে ফুল পড়ে রয়েছে, সে যে ভুলে গেছে মালা গাঁথা’। ঈমন কবিতা লিখতে পারেনা, গান গাইতে পারেনা। তবে কখনো কোনো মধুর অন্তরঙ্গ মুহুর্তে নীলার কোলে মাথা রেখে ওর গান শুনতে ও বেশ পারে। গাইতে গাইতে সে ঈমনের চুলে বিলি কেটে দেয়; কখনো হয়তো ওর হাতটা কাছে টেনে নিয়ে আলতো করে চুমো খায় ঈমন।

আজকের রাতটাও হতে পারতো সেরকম কোনো অন্তরঙ্গ রাতগুলোর একটা। তবে সে হবার নয়। সন্ধ্যের সময় অফিস থেকে ফোন এলেই নীলা বুঝে নেয়- আজ তার ভাগ্যে আছে রাতজাগা, আর না খেয়ে মানুষটির জন্য অপেক্ষা করা। অফিসের ফোন রোম্যান্স বোঝেনা, জোছনা চেনেনা। সেই ফোনের ডাক হাইকোর্টের সমনের চেয়েও অমোঘ, অগ্রাহ্য। তাইতো রাতবিরেতে হরহামেশাই মাইনে দিয়ে কেনা ভৃত্যরা ছুটে চলে, খেটে চলে, রাত জেগে চলে। আর বাড়িতে তাদের প্রত্যেকের জন্যই কেউ না কেউ অপেক্ষায় ক্ষণ গোণে, লাল চোখে ক্ষুধা পেটে অপেক্ষায় থাকে। তবুও তারা সুখী, তারা দম্পতি। আমাদের নীলা আর ঈমন এমন অসংখ্য নাগরিক অণুসংসারগুলোর একটি। মৌমাছি যেমন শুকনো ফুল থেকে টকটকে তাজা মধু শুষে এনে তার ঘর গড়ে, তেমনি জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত, ঘাত-প্রতিঘাত, হাসি-কান্না থেকে বেঁচে থাকার, ছুটে চলার রসদ নিয়ে এরা দিনাতিপাত করে। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর বাড়ি ফিরে একে অন্যের চোখে চেয়ে আলতো হেসে, অথবা হালকা জড়িয়ে ধরে নিজেদের শ্রান্তিগুলো মাখামাখি করে নিয়ে ওরা ভুলে যায় সবকিছু। মিলনের ওই ক্ষণস্থায়ী ক্ষণগুলোই তাদের জন্য হয়ে ওঠে একেকটি মহাকাল। একে অন্যের বুকের ভেতরই খুঁজে পায় সব আনন্দ, খুশি, ভালোবাসা।

২।
ঘন্টাতিনেকের পরিশ্রমের পর সব হিসেব মিলিয়ে ফাইলটা বসের রুমে পৌঁছে দিয়ে তবেই ছুটি মিললো ঈমনের। রাত দশটা। রাতের বেলায় একা একা বসে নীলা কি করছে কে জানে! ওরই কি বা ভালো লাগে এভাবে রাতবিরেতে কাজ করে বেড়াতে? এখন একটা ডাইরেক্ট বাস ধরে মতিঝিল থেকে মীরপুর ফিরবে সে। ধীরে ধীরে শাপলা চত্ত্বরের দিকে পা বাড়ায় সে। রাত দশটা মেট্রোপলিটান জীবনে কেবল সন্ধ্যে। জিরো পয়েন্টের ভীড় তো কখনোই হালকা হয়না। মানুষের ভীড় সেখানে কখনোই কমেনা- কি রাত দশটা, আর রাত দু’টা। তাই বাসের আনাগোনারও কোনো কমতি নেই। দিনভর কাজ করা তার মত অসংখ্য মানুষের স্রোতে, তাদের ঘামের গন্ধে আর পরিশ্রান্ত আলাপচারিতার মাঝে মিশে গিয়ে সে এগিয়ে চলে। এই লোকগুলো তার খুব আপন। এদের কাউকেই চেনেনা সে। প্রত্যেকদিনই রাস্তায় বেরোলে এমন অসংখ্য লোক মেলে। তাদের প্রায় কারো সাথেই নিয়মমাফিক পরিচয়পর্ব হয়না। তবে তারপরও এরা সবাই তার চিরচেনা। আসলে ওদের সবার একটিমাত্র চেহারা, একটিমাত্র শরীর। শতসহস্রের ভীড়ে যেদিকে চায়, প্রতিটি মানুষকেই তার কাছে একই রকম লাগে। সবার মুখে একটা ক্লান্তির রেখা, ঠোঁটে একটুকরো বিরক্তি আঁকা, শরীরের সর্বশেষ শক্তিটুকু জড়ো করে বাসস্টপে অপেক্ষা করা, তারপরও চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসা একচিলতে চঞ্চলতা, বাসা ফেরার জন্য হালকা অধীরতা। সবার চেহারাই সেই একই রকম। হয়তো তারও!

সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে সে চলার গতি বাড়ায়। বাস চলে এসেছে, তাকে দৌড়েই উঠতে হবে সীট পেতে হলে। হঠাৎ করে পেছন থেকে একটা কর্কশ বেসুরো হর্নের শব্দে একটু থমকে থামে সে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবকিছু কেমন যেন কালো অন্ধকার হয়ে যায় হঠাৎ। ষাটের দশকের সিনেমার মত সাদাকালো চারদিক, আর সবাই কেমন যেন স্লো-মোশনে ছুটছে। খানিক বাদেই বুঝতে পারে- সবাই আসলে তার দিকে ছুটে আসছে। কেন? কিছুই ভেবে পায়না ঈমন। প্রায় অনন্তকাল পর হঠাৎ অসম্ভব তীব্র ভয়াবহ একটা ব্যাথা সবকিছু ছাপিয়ে, সবকিছু ভেঙেচুরে উঠে আসে। অনেকটা ষাটের দশকের নায়কের মতই রক্তাক্ত কলেবরে ধীরে ধীরে জ্ঞান হারায় সে।

৩।
চাঁদটা এখনো জেগে। ঘুমোয়নি নীলাও। হাসপাতালের দেয়ালে গাঁথা কাঁচের জানালা দিয়েও চাঁদটাকে দেখতে একই রকম লাগে। কান্না চেপে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও হালকা কেঁপে কেঁপে উঠছে পিঠ। চোখ দিয়ে অঝোরে ঝরে চলছে অশ্রু। ডাক্তাররা নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেনি। বলেছে, চেষ্টা চলছে। বাসের ধাক্কায় কয়েকটি হাড় ভেঙে গেছে। রক্তাক্ত দেহে মৃতপ্রায় অবস্থায় হাসপাতালে পৌঁছেছিলো ঈমন। তারপর থেকে অনেক যন্ত্রপাতি আর ডাক্তার পরিবেষ্টিত সময় কাটাচ্ছে সে আইসিইউতে। এরই মধ্যে ঈমনের কিছু সহকর্মী এবং বন্ধু চলে এসেছে হাসপাতালে। কেউ কেউ আবার নীলাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। এত কথা, হৈচৈ, মানুষের ভিড় অসহ্য লাগছে নীলার। বিকেল থেকে অপেক্ষা করে ছিলো ওর সাথে কয়েকটি মধুর মুহুর্তের জন্য। এত কাছে এসেও ওদের মাঝের একটি দেয়ালের বাধা পেরোনোর সামর্থ নেই নীলার। অনুমতি নেই ওকে ছুঁয়ে দেখার। ওর ইচ্ছে করে সবার কাছ থেকে লুকিয়ে ঈমনকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে। এমন কোথাও, যেখানে এত শোরগোল থাকবেনা। যেখানে দেয়ালের বাধা থাকবেনা। যেখানে ঈমন হালকা হেসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলবে, ‘ভালোবাসি’।

হঠাৎ নীলা মনের সবটুকু শক্তি এক করে এক ঝটকায় নিজেকে টেনে সরিয়ে নিয়ে যায় এসবকিছু থেকে অনেক দূরে। এত কোলাহল, ডাক্তার-নার্সদের ব্যস্ত পদচারণা- সবকিছু অস্পষ্ট হয়ে দূরে সরে যেতে থাকে। চোখের সামনের দৃশ্যপট বদলে যায় ধীরে ধীরে। হাসপাতালের দেয়াল রুপ নেয় ঝিরঝিরে বালির সমুদ্রতীরের। তার পেছনে গাঢ় নীল পানি। চাঁদটা এখনো আলো বিলাচ্ছে অকৃপণ। সেই চাঁদকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে অনেক দূর থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ঈমন। মুখে তার মৃদু হাসি, ভালোবাসা। দু’হাত দু’দিকে ছড়ানো, ওকে বুকে জড়িয়ে ধরার জন্য ব্যাকুল। দুধারে সারি সারি নারকেল গাছ, সবুজ আর ধূসরের মিশ্রণ। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ঈমন। বালির বিছানায় বসে আছে নীলা। পরনে হালকা নীল শাড়ি, পায়ে নুপুর, কপালে ছোট্ট একটা লাল টিপ। একদৃষ্টে চেয়ে থাকে দূর থেকে হেঁটে আসা ঈমনের দিকে। অপেক্ষা করে ওর কাছে আসার। অপেক্ষা করে।
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×