মানুষ জীবনে যতো রকম শিক্ষা নিতে পারবে, জীবনকে যতো বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করতে পারবে, তার জীবন ততোই বর্ণাঢ্য হবে এবং অন্যের কাছে অনুকরণীয় হবে। তাদের জীবনের কল্যাণমূলক শিক্ষা অনুসরণ করা হলে দেশ জাতি সমাজ ও বিশ্বমানবতারও উপকার হবে।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম কি করেননি?
শিশুকালে রুটির দোকানে কাজ করা, মসজিদে আজান দেয়া, বড় হয়ে কবি, লেখক,গীতিকার,গায়ক, সুরকার, সৈনিক,পত্রিকা সম্পাদক .অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক এবং বৃটিশদের বিরুদ্ধে কবিতা লিখে পরাধীন ভারতের একমাত্র কারাদন্ড ভোগ করা কবি।
আমার আদর্শের বেশীরভাগ মানুষই বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী। তাদের অনুসরণ করে আমিও জীবনের কোনো ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট গন্ডীতে আবদ্ধ না থেকে বিভিন্ন বিষয়ে যুক্ত হয়েছি। পড়াশোনার ক্ষেত্রে নিয়েছি পরস্পর সম্পর্কহীন বিষয়ে একাধিক ডিগ্রি।
শিশুকাল থেকেই আত্মরক্ষাকৌশল শেখা শুরু করেছিলাম। ১৮ বছর বয়স থেকে শুরু করলাম দেশের জাতীয় দৈনিকগুলিতে লেখালেখি।
১৯৯৯ সালে বইমেলায় প্রথমবারের মতো একইসাথে ৪ টা বই প্রকাশিত হলো। ২ টা মৌলিক রচনা ও ২টা অনুবাদ।
১৯৯৬ সালে একটা রাইফেল ক্লাবে ভর্তি হয়ে পিস্তল ও রাইফেল চালানো শিখলাম। ২০০৩ থেকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ব্যায়ামাগারে শুরু করলাম শরীর গঠন।
ছবি দেখতে দেখতে ছোটোবেলা থেকেই চলচ্চিত্রে অভিনয় করার শখ হয়েছিলো।পরে যখন দেখলাম. হলিউডের ক্লিন্ট ইষ্টউড,ষ্ট্যালোন,কেভিন কষ্টনার এবং আমার ওস্তাদ ব্রুস লি এবং জ্যাকি চ্যান দুজনই একইসাথে অভিননেতা ও পরিচালক এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী পরিচালক মেল গিবসনও তাই,তখন চলচ্চিত্র পরিচালনার শখও হল। প্রথমে ঢুকলাম অভিনয় শেখার জন্য থিয়েটারে, পরে চলচ্চিত্রে উপর এম এ ডিগ্রি নিলাম।
আইন নিয়ে পড়ে এলএলবি ডিগ্রিধারীও হলাম। আর জীবনে যা যা শিখেছি, প্রায় সবকিছুরই শিক্ষক হলাম। এসবকিছু শেখার উদ্দেশ্য একটাই । নিজেকে সৎ, নীতিবান, মাদক ও সবরকম অপরাধমুক্ত রেখে এসব আদর্শ গ্রহণে অন্যদের অনুপ্রাণিত করে একটা উন্নত ও সভ্য জাতি গঠনের চেষ্টা করা।
যেদিন পৃথিবীতে জন্ম হয়েছিলো, সবাই দেখে বলেছিলো, দেবশিশু জন্ম নিয়েছে (যদিও এখন আর সেই অব্স্থা নাই)। দেখতে আসা প্রত্যেকটা নারী এরকম একটা সন্তান কামনা করতো বলে শুনেছি। বড় হওয়ার পর ঠান্ডা ও অন্যান্য রোগে গায়ের রং দিনে দিনে কালো হতে হতে শুরু করলো।
কিন্ত আশ্চর্য্য তারপরও মাধ্যমিক স্তরে পড়ার সময় প্রায় ৬ ফুট লম্বা ও নাক উচু সাদা রং এর আর্য রক্তের ছেলেদের পরিবর্তে স্কুলের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েগুলিকে আমার প্রতিই আকৃষ্ট হতে দেখলাম। এরসাথে যুক্ত হলো টিএ্যান্ডটি ফোনের অসংখ্য না দেখা মেয়ে বন্ধু, যেদিনগুলির কথা ২০০০ এর পর জন্মা নেয়া মোবাইল ইন্টারনেটের যুগের ছেলে-মেয়েরা চিন্তাও করতে পারবে না।
এতো মেয়ে বন্ধু থাকা এবং তাদের বিশ্বাস অর্জনের ফলে ছোটোবেলা থেকেই তাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের সৃষ্টি হয়েছিলো। তাই কোথাও কোনো মেয়েকে বখাটেরা উত্যক্ত করতে দেখলে সবসময়ই প্রতিবাদ করতাম।
চন্দ্রিমা, রমনা ও শিশু উদ্যানে উত্যক্তকারীদের খপ্পর থেকে কতো মেয়েকে যে বাচিয়েছি তার কেনো হিসাব আমারো মনে নাই। এবং প্রতিটা ক্ষেত্রেই আমার সাথে ছিলো মাত্র ২ থেকে ৫ জন বন্ধু ।কিন্ত উত্যক্তকারীদের সংখ্যা ছিলো ২৫-৩০ জন পর্যন্ত। তবে কোনোদিন মারামারি করতে হয়নি। কারণ অপরাধী সবসময়ই ভীতু তাই মেয়েদের উত্যক্ত করার পরও আবার বাধাপ্রদানকারীদের সাথে মারামারি সাহস কেইউ করেনি।
১৯৯৪ সাল। বয়স তখনও ২০ হয়নি। বাংলা একাডেমীর বইমেলা থেকে রাত ৮:৩০ এর দিকে বের হওয়ার পর দেখলাম এক মহিলা এবং তার ৩ সুন্দরী মেয়েকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই একদল ছেলে ভয়ংকরভাবে আক্রমণ করেছে। মেয়েগুলির অতংকিত চেহারা এখনো মনে পড়ে। তারা তাদের ২০০০ সালে বাধনের মতোই হেনস্থা করতে চাচ্ছিলো। আমার সাথে ছিলো মাত্র ১ জন।
সেদিন কিভাবে যে তাদের উদ্ধার করলাম , ভাবলে এখনও অবাক হই। এটা ছিলো সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ কাজ। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসীরা সবসময়ই ভয়ংকর হয়। সেদিন মৃত্যুঝুকিও ছিলো। তবে মনে হয়, আমাকে প্রতিবাদ শুরু করতে দেখে কয়েকজন সাথে যোগ দিয়েছিলো। না হলে শুধু ২ জন মিলে এতোবড় দলকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হতো না।
তাদের বডিগার্ডের মতো হাত দিয়ে আড়াল করে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত আনার পর মেয়েদের মাকে বললাম ,কিছু মনে না করলে একটা কথা বলতাম। তিনি বললেন , বলেন।বললাম, এরপরে মেয়েদের নিয়ে কোথাও বেড়াতে গেলে অনুগ্রহ করে সন্ধার আগেই বাড়ি ফিরে যাবেন।
আরেকটা ঘটনা সেবছরই বাংলা নববর্ষের দিনের। সকালে একদল বখাটে রমনা উদ্যানের প্রবেশ পথে ঢুকতে মেয়েদের বাধার সৃষ্টি করছিলো। আমার আরো ৩ জন বন্ধুর সেখানে আসার কথা থাকলেও তারা তখনও এসে পৌছেনি। সাথে শুধু টারজান নামে এক বন্ধু।তার আসল নাম ফিরোজ। পরিচয় হওয়ার পর তাকে আত্মরক্ষাকৌশল শিখাতাম। শরীরের গঠন অনেকটা টারজানের মতো হওয়ায় তার এই নাম দিয়েছিলাম। সেইসময় প্রায় প্রতিদিন সকাল ৫:৩০ এ বাসা থেকে দৌড়ে সেখানে গিয়ে চর্চা করতাম। শারীরিক ও মানসিক শক্তি ছিলো অসীম।
প্রথমে রাস্তায় পড়ে থাকা একটা লাঠি হাতে নিলাম। তারপর দুইটা লাইন করলাম,একটা ছেলেদের এবং অন্যটা মেয়েদের প্রবেশের জন্য। সবাইকে বললাম, কেউ যদি মেয়েদের গায়ে হাত দেয়ার চেষ্টা করে, মেরে হাত ভেঙ্গে দেবো। কেউ সাহস করলো না। পুলিশ না আসা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে গেলাম।
এই ঘটনাটা ভুলেই গিয়েছিলাম। ২০০৬ সালে বন্ধু টারজান অনেক দিন পর বাসায় এসে মনে করিয়ে দিয়েছিলো।
এতো কম বন্ধু নিয়ে বেশী সংখ্যক উত্ক্তকারীদের খপ্পর থেকে মেয়েদের উদ্ধার করতে যাওয়ার অনেক সময়ই তারা রেগে যেতো।সেটাই স্বাভাবিক। কারণ কে পিটানি খেতে চায়? কিন্ত তারপরও থামিনি।
১৯৯৭ সাল থেকে একা একটা ফ্ল্যাটে থাকি। পরিবারের অন্যরা পাশের ফ্ল্যাটে। ১৯৯৫ সালে টেলিফোনে পরিচয় হওয়া এক মেয়ে পারবিারিক অশান্তির কারণে ১৯৯৯ সালের মে মাসে আত্মহত্যা করতে গিয়েও কোনো ঝামলো হলের আমার বাসায় চলে আসার কথা বলেছিলাম মনে হওয়াতে সত্যি সত্যি এসে পড়েছিলো। তাকে সান্তনা আর পরিবারের পক্ষ থেকে আমার লেখা কয়েকটা বই দেয়া হলো্। একটা কথা বললাম, আমার ফ্ল্যাটে এসেছো ভালো, কিন্ত এভাবে আর কারো বাসায় একা যেওনা। তাহলে বড় বিপদ হবে।
সে কথা শোনেনি।৩ দিন পর আরেক বান্ধবীকে ,যার সাথেও আমার ফোনে কথা হতো,নিয়ে আবার মহৎ ব্যাক্তির দর্শণ লাভের জন্য ফ্ল্যাটে এসেছিলো।
তবে সেই মেয়ে চরম অকৃতজ্ঞ। জীবনের সবচেয়ে বড় বিপদে আমার বাসায় এসে আত্মহত্যা না করে নিজের প্রাণ বাচানোর কথা পরে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছিলো।
২০১২ সালের আগষ্টে দেশের বিরাট অভিনেতার ছবি রাজমণি হলে দেখতে গিয়ে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। একদল বখাটে ছবি দেখতে আসা মেয়েদের উত্যক্ত করছে। নাম কি, বয়স কতো, বাসা কোথায়-্এ সব।একাই ছিলাম। কড়া ধমক লাগিয়ে বললাম, পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেবো। সাথে সাথে মাফ চেয়ে বখাটেরা সোজা।
জীবনে এরকম কতো ঘটনা ঘটেছে, তার কোনো হিসাব মনে নাই্।
একটা প্রবাদ বানিয়েছিলাম। এরশাদ শিকদার জানে না, সে জীবনে কতো নারী নির্যাতন করেছে। আর আমি জানি না, জীবনে কতো নারীকে বখাটেদের কবল থেকে উদ্ধার করেছি।
সর্বশেষ বড় ঘটনা ২০১৬ সালের আগষ্টের। পরিচালকের সহকারী হিসেবে কাজ করছি। পরিচালক সাবান সুন্দরী নায়িকার গায়ে বারবার সবার সামনে হাত দিচ্ছে। মেজাজ ঠিক রাখতে পারিনি। আড়ালে যাই করে করুক, কিন্ত সেটের সবার সামনে অসভ্যতা বন্ধ করতে বললাম। সুতরাং পরিচালকের সাথে ঝগড়া এবং রেগে গিয়ে সেখান থেকে চলে আসা। সেই সাথে মিডিয়ার কাজ বন্ধ।
আজ যখন চারিদিকে এতো ধর্ষণ আর নারী নির্যাতন দেখে এসব ঘটনা মনে পড়ে।
দেশের তরুণ-যুবকদের কারো মধ্যেই কি এসব অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার মানসিকতা কাজ করেনা, যেটা আমি একা বা অল্প কয়েকজনকে নিয়ে ২৬ বছর আগেও করেছি?
এখন সবাই কি মনে মনে একেকটা নীপিড়ক?
আমার বোন নাই। কোনো মেয়েকে বোন মনেও করিনা। কিন্ত তাদের সন্মান করে এসেছি।
কিন্ত দেশের আর কারো কি বোন নাই? নিজের বোনকে কেউ উত্যক্ত করলে যদি ক্রোধে অন্ধ হয়, তাহলে অন্যের বোনের সাথে এসব অসভ্যতা করে কিভাবে?
দেশের সব তরুণ-যুবক প্রতিটা এলাকায় ধর্ষক ও বখাটে প্রতিরোধ সংগঠন করবে সেই দিনই দেশ থেকে নারী নির্যাতনের
অবসান হবে।
শুধু আইন-শৃংখলা বাহিনী এদের দমন করতে পারবে না।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ৩:১১