মানুষটির সাথে আমার যেদিন দেখা সেদিন আমার আমেরিকায় আসার কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার দিবস। ভিসা লাগানো পাসপোর্ট নিতে গিয়েছিলাম। যেখান থেকে আনতে হবে সেখানে পৌঁছে দেখি দীর্ঘ লাইন। দুইতলা থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত। দেখে মনে হলো বাংলাদেশের সব মানুষ আমেরিকা চলে যাচ্ছে।
সেই লাইনের মাঝে পেলাম মানুষটিকে। অনেকদিন ধরে তাকেই মনে মনে খুঁজছিলাম। আমেরিকা যাচ্ছি, এই খবরটা তাকে জানানো প্রয়োজন মনে করছিলাম। জীবনের একটি সংকটময় মুহুর্তে মানুষটি আমার নীতির কম্পাস হিসেবে কাজ করেছেন। কোন নতুন সংকট আসার আগেই কম্পাসের উত্তর দক্ষিণ সিধে করে নেয়া দরকার ছিলো।
মানুষটিকে যেখানে খুঁজে পেলাম, সেটিই আমার নীতির কম্পাসের কাঁটা অনেকটুকুন ঠিক করে দিলো। আমি তাকে খুঁজে পেলাম সেই ভাপসা গরমঅলা চিপা করিডোরে আর দশ বিশজন মানুষের সাথে দাঁড়িয়ে ঘামতে। অনেকেই তাকে জায়গা ছেড়ে সামনে যেতে দিচ্ছিলেন। তিনি সামনে গেলেননা। নিজের যে ন্যায্য স্থান সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় রইলেন। সবার মতন তিনিও এসেছেন তার পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে। তার মাঝে জাদুকরী কিছুই নেই।
আমি অনেক আমি তার কাছে এগিয়ে গেলাম, তাকে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার, কেমন আছেন?
মানুষটি আমাকে দেখে চমকে গেলেন, আরে আরে অনুপম! বড় হয়ে গেছো! শেষ কবে দেখেছি তোমায়।
এতো বড়মাপের লোক, অথচ কতো ছোটবেলার আমাকে ঠিক মনে রেখেছেন। আমি অবাক হলাম।
মানুষটির সাথে আমি প্রায় ঘন্টাখানেক দাঁড়িয়ে ছিলাম। এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে আমি ওনাকে আমার মনের যত প্রশ্ন আর যত খটকা-সব একে একে জিজ্ঞেস করলাম। আর সেই ঘন্টাখানেকে দীর্ঘলাইন একধাপ একধাপ করে স্লথ সারিটি এগিয়েছে আর সেই ঘন্টাখানেকে মানুষটি আমাকে সারা দুনিয়া ঘুরিয়ে এনেছেন। আমি ওনার সাথে একবার ওনার গ্রামে চলে গেলাম। সেখানে হাজার হাজার মানুষের সামনে তাকে সংবর্ধনা দেয়া হচ্ছে। এক চিলতে মাঠে অগুনতি মানুষ উপচে পড়ছে- পুরুষ মহিলা বাচ্চা-সকলে স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে মানুষটিকে একবার দেখবে বলে। আবার চলে গেলাম আরো কিছুদিন আগে। লুঙ্গি পরে ওনার সাথে চলে গেলাম মাছের বাজারে-যেখানে মাছের ব্যাপারি বামহাতে পয়সা দেয়াতে মনে দুঃখ পায়। এরপর চলে গেলাম আটলান্টিক। স্টার্লিং পাখিদের সাথে ওড়াওড়ি করলাম-প্রকৃতির জাদুখেলা দেখে এলাম নিজের দু'চোখে। চলে গেলাম লাস ভেগাস-রক্ত চনমন করে গেলো পয়সার ঝনঝন আর খলখল হাসির শব্দে- যেখানে মানুষের মন্যুষত্ব রোজ কাচা পয়সায় বেচাকেনা চলে।
মানুষটি নিজের মনে গল্প করছিলো আর একেকটি গল্প গেঁথে যাচ্ছিলো আম্মার ভেতরে। একটি গল্প ঠিক করে দিচ্ছিলো আমার নীতির উত্তর মেরু,একটি হলো নীতির দক্ষিন, একটি হলো পূর্ব আর আরেকটি পশ্চিম।
এই আট হাজার মাইল দূরের পরবাসে থেকে আমি আজও সেইদিন ঠিক করে নেয়া নীতির কম্পাসে নিজের ভালোমন্দ হিসেব করে নেই।
হয়তো সবসময় মাস্তুল স্থির থাকেনা, দুলে দুলে যায়। তবু আমি হাল ধরে রাখি। আমার কম্পাস আমাকে দেখিয়ে দেয় আমি কে? আমি কোথা থেকে এসেছি-আর আমি কোথায় যেতে চাই। আমার মাস্তুন ঠিক থাকতেই হবে। কারণ আমি জানি আমি যেই সুযোগটি পেয়েছি-সেটি খুব কম মানুষই পায়। আমি একজন বিশ্বনন্দিত তারকাকে তার ঝলমলে আলোর গহীনের মানুষ হিসেবে পেয়েছি। আমি অনেক অনেক দিনের আগে শিক্ষকতা ছেড়ে আসা একজন মানুষকে আবার একজন শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। এই সুযোগ হেলায় হারাবার নয়।
এই বইটি সেই মানুষকে উৎসর্গ করছি যিনি না থাকলে ভাঙ্গাচোরা একটা ছেলে আজকের অনুপম হতে পারতো না।
এই বইটি মানুষ জুয়েল আইচের উদ্দেশ্যে।