somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুসং দুর্গাপুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার এক সুপ্রাচীন জনপদ

১৩ ই জুন, ২০১৪ রাত ১০:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
[img|http://cms.somewhereinblog.net/ciu/image/194285/small/?token_id=91e64a6daa05987f3c734b15f79578e1

বাংলাদেশের সুদুর উত্তর সীমান্তের এক নিভৃত জনপদ সুসং দুর্গাপুর। প্রাচীন নাম সুসং রাজ্য অনেক অনেক কাল আগে ১২৮০খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে মাঘমাসের শীতকালীন অবসরে ভারতেরকান্যকুব্জ থেকে একদল সাধুবেরিয়েছিলেন তীর্থ ভ্রমণে।বিভিন্ন তীর্থস্থান ঘুড়তে ঘুড়তে একসময় তারা উপস্থিত হন গৌহাটিরনিকটস্থ পাহাড়ে অবস্থিতকামাখ্যা মন্দিরের পূন্যপীঠে।কিছুদিন সেখানে অবস্থানের পরনদীর তীরে বিগ্রহলক্ষ্মী নারায়ণজীর আবাসে আশ্রয়গ্রহণ করেন এবং সেখানে মগ্ন হন ঈশ্বরআরাধনায়। এভাবেই কেটে যাচ্ছিলদিন। নিরব পাহাড়ি পরিবেশতাদেরকে বেশ প্রশান্তি দিচ্ছিল।হঠাৎ একদিন একদল দরিদ্র ধীবরসেখানে উপস্থিত হয়


সাধুদেরজানালেন যে ‘পাহাড় মুল্লুকে’ বৈশ্যগারো নামে এক দুর্ধর্ষ ওঅত্যাচারী রাজা তাদেরউপরে ক্রমাগত নির্যাতনেরকরে চলেছে । এ হেনঅবস্থা থেকে তারা পরিত্রাণ চায়।ধীবরদের মুখে এ নির্যাতনেরকাহিনী শুনে এক প্রবীণ সাধুরমনে দয়ার উদ্রেক হয়। তিনি তারকনিষ্ঠ সাধু সোমেশ্বর পাঠককে বলেন,সোমেশ্বর তুমি ‘এই অরণ্যভূমি অধিকারকরে এখানে একটি রাজ্য স্থাপন কর!তাতে তোমার অভীষ্ট সিদ্ধি ওধীবরদের মঙ্গল হবে। জ্যোষ্ঠ সাধুরনির্দেশকে শিরোধার্য ভেবে আরওকয়েকজনসন্ন্যাসীকে নিয়ে সোমেশ্বর পাঠকথেকে গেলেন নিবিরপাহাড়ি অরণ্য এ জনপদে। আরবাকি সাধুরা চলে গেলেন পূর্বেরগন্তব্যে।তারপর সোমেশ্বর পাঠক অন্যান্য সহচর ওধীবরদের নিয়ে একটি দল সংঘঠনকরেন এবং অত্যাচারী বৈশ্যগারো রাজাকে পরাজিতকরে তিনি নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করলেন নতুন এক রাজ্য।যার নাম দেন ‘সুসং রাজ্য। রাজ্যপ্রতিষ্ঠার পর রাজ্যের পাশদিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছ জলধারায়প্রবাহিত পাহাড়ি নদীটির নাম দেন‘সোমেশ্বরী।’ ৩,৩৫৯ বর্গমাইলএলাকা ও প্রায় সাড়ে নয়শত গ্রামনিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় সুসং রাজ্য।সুসং রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু এক বিরানভূমিকে করা হয় রাজধানী।রাজধানীর নাম রাখা দুর্গাপুর।বর্তমানে সেই দূর্গাপুর জনপদটিইনেত্রকোনার জেলার সুসঙ্গ দূর্গাপুরউপজেলা নামে পরিচিত।
সুসং রাজবংশের কথাঃ সুসং রাজ্যের প্রথম রাজা হন সোমেশ্বর পাঠক তিনি প্রায় ৬০বৎসরের মতো রাজত্ব করেন ১৩৫০খ্রিষ্টাব্দে তিনি মারা যান। তারমৃত্যুর পরবর্তী সময়ে রাজা হন তারবংশধররা। তার বংশধরদেরমধ্যে উল্লেখ যোগ্য রাজা ছিলেনরাজা রঘুনাথ সিংহ সুসঙ্গরাজবংশের রাজাগণেরমধ্যে তিনি ছিলেন সর্বাধিকপরাক্রমশালী। তার জীবন অত্যন্তঘটনা বহুল। তিনি তার পিতার মৃত্যুরপূর্বেই রাজ্যভার গ্রহণ করেছিলেন।সে সময় বাংলার বার ভূঁঞাদেরনেতা ঈশা খাঁ-র সাথে রাজ্যেরসীমা নিয়ে বিরোধ সৃস্টি হয়েছিল।তাই ঈশা খাঁ সুযোগ মতরাজা রঘুনাথকে কৌশলে বন্দী করেন।রঘুনাথ সিংহ তার গারো ওহাজং বাহিনীর প্রচেষ্টায় রাতেরআধারে পলায়ন করে সুসঙ্গরাজ্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি মোগলসেনাপতি মানসিংহের সহায়তায়দিল্লীতে মোগল সম্রাটেরদরবারে হাজির হন। রঘুনাথের সুঠাম ওবলিষ্ঠ দেহ অবলোকন করে সম্রাটআকবর তার প্রাসাদের দ্বাররক্ষী নিয়োগ করেন। এরপর সম্রাটআকবর রঘুনাথ সিংহকে চাঁদ রায় ওকেদার রায়েরবিরদ্ধে যুদ্ধাভিযানে প্রেরণেরকরেন সেসব যুদ্ধে জয়লাভের জন্যপুরস্কার স্বরূপ সম্রাট আকবর সুসঙ্গরাজ্যকে ‌-মুলকে সুসঙ্গ- নামকরণকরে তাকে শাসনভারপুনঃ প্রতিষ্ঠার অনুমতি প্রদান করেন। সুসং রাজ্যের রাজাদেরমধ্যে রাজা রঘুনাথের পরউল্লেখযোগ্য রাজা হলেনরাজা রাজ সিংহ : তিনি বাংলা ওসংস্কৃতি ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন।রাজা রাজসিংহ রাজশাসনেরসাথে সাথে সাহিত্য চর্চায় অত্যন্তআগ্রহী ছিলেন। সাহিত্যসমাজে তিনি প্রাচীন সুসঙ্গের উচ্চশ্রেণীর কবি হিসেবে পরিচিত লাভকরেছিলেন। ভারতী মঙ্গঁল, রাগমালা,মানস পাঁচালী,ঢাকা বর্ণনা ইত্যাদি গ্রন্থাবলী প্রণয়নকরে সাহিত্য জগতে রাজা রাজসিংহ অমর হয়ে আছেন।রাজা রাজসিংহের আমলেইসুসং রাজ্যে সর্ব প্রথম আর্যপ্রভা”নামে একটি মাসিকপত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল।এবং সেটি নিয়মিত ছিল। সর্বশেষসুসং রাজ্য থেকে ১৮৭৫খ্রীস্টাব্দে “আর্য প্রদীপ” ও “কৌমুদী”নামক দু’টি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিতহয়।যেভাবে সুসং রাজ্যের পতন ঘটলোঃসোমেশ্বর পাঠকের প্রতিষ্ঠিতসুসং রাজ্যটি রাজ্য নিয়ন্ত্রণ হারায়রাজা রাজকৃষ্ণের শাসনামল থেকে।গোটা রাজ্যটাকে তারশাসনামালে চার ভাগে ভাগ করা হয়এবং প্রতিষ্ঠিত হয়চারটি রাজবাড়ী বা প্রাসাদ।বাড়িগুলো ‘বড় বাড়ি’, ‘মধ্যম বাড়ি’,‘আবু বাড়ি’ ও ‘দু’আনি বাড়ি’নামে পরিচিত লাভ করে। আর ভাগহয়ে যাওয়া রাজ্য ক্রমশই তার জৌলুশহারায়। ৪৭-এর দেশ বিভাগ এবং ‘৫৪সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ আইনপাস হবার পর রাজবংশেরসদস্যরা ভারতে চলে যান।ফেলে রেখে যান শাসন বিহীনসুসং রাজ্য। ১৩০৪ খ্রিস্টাব্দের ভয়াবহভূমিকম্পে সুসং রাজ্যের অনেক অংশমাটির অভ্যন্তরে বিলীন হয়ে যায়।আর এভাবেই অবসান ঘটে শৌর্য-বীর্যখ্যাত সুসং রাজ্যের। সোমেশ্বরপাঠক ও তার বংশধরেরা প্রায় ৬৬৭ বছরধরে শাসন করেছিলেন সুসং রাজ্য।সুসং রাজ্য থেকে সুসঙ্গ দূর্গাপুরঃসুসং রাজ্যেটি তৎকালীন সময়েরউল্লেখ যোগ্য দৃষ্টিনন্দন একটি রাজ্যছিল। মোহনীয় পরিখাবেষ্টিত রাজবাড়ির অভ্যন্তরে ছিল সৈন্যআবাস, বিচারালয়, কারাগৃহ,অস্ত্রাগার, চিড়িয়াখানা,হাতিশালা, রাজপরিবারেরসদস্যদের প্রাসাদ, শয়নকক্ষ, কাছারি,বৈঠকখানা ইত্যাদি। সুসং রাজাদেরনির্মিত বড় বাড়ি’রসামনে তিনতলা একটি বড় ঘর ছিলযেটিকে ‘রংমহল’ বলা হতো। দেশবিভাগের পরও সেই ঘরটি ছিল। ১৯৭০সালে সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়সুসং ডিগ্রী কলেজ ।বর্তমানে সেখানে একটি পানিরইঁদারা ও সীমানা প্রাচীর ছাড়া বড়বাড়ির আর কোন স্মৃতিচিহ্ন নেই। ‘মধ্যমবাড়ি’র বাইরের পূর্ব দিকের একটি ঘরএখন দুর্গাপুর সদর ইউনিয়ন ভূমি অফিসহিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।এবং একটি কাছারি ঘর ব্যবহৃতহচ্ছে দুর্গাপুর সরকারী প্রাথমিকবিদ্যালয় হিসেবে। ১৯৬৯ সালে মধ্যমবাড়ির অভ্যন্তরের কয়েকটি ঘরনিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় দুর্গাপুরবালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।সুসং রাজ্যে সর্বশেষ বসবাসকরেছিলেন সুসং রাজ বংশেররাজসদস্য অমরেন্দ্র সিংহ শর্মা। ‘আবুবাড়ি’তে ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের সময়তিনি বসবাস করতেন। সুসং দূর্গাপুরতিনি ‘মিনি বাহাদুর’নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁরদেশত্যাগের পর ওই বাড়িরকয়েকটি ঘর বিভিন্ন সময়সরকারী কর্মকর্তাদেরবাসাবাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।বর্তমানে সেটি ম্যাজিস্ট্রেট বাসভবন হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।দু’আনি বাড়ির কিছু স্মৃতিচিহ্ন এখনওঅক্ষত আছে। বর্তমানে ওইবাড়িতে বসবাস করছেন গোপাল দাসনামে এক ব্যক্তি। তিনি রাজবাড়িরসাবেক কর্মচারী সাধুচরণ দাসেরপৌত্র। তৎকালীন সময়ে কাঠেরতৈরি এ ঘরগুলোর নির্মাণশৈলীওবেশ নান্দনিক। এছাড়াও দুর্গাপুরেরসুসঙ্গ রাজাদের স্মৃতিচিহ্নহিসেবে টিকে আছে ১৯১৮সালে স্থাপিত মহারাজা কুমুদচন্দ্রমেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়। এটিইসুসং দূর্গাপুরের প্রথম বিদ্যাপীঠ।এছাড়া সোমেশ্বর পাঠক এর প্রথমস্থাপনাকৃত ধর্মীয়উপসনালয়টি বর্তমানে দশভূজা মন্দিরনামে পরিচিত। সুসঙ্গ রাজ্যের আরেকরাজা জানকীনাথ, রানী:কমলা রানীর অনুরোধে নির্মাণকরেছিলেন এক মস্ত দীঘি যার নামছিল সাগর দীঘি।কিংবদন্তী ইতিহাস নিয়ে এদীঘিটি পরিচিত হয় ‘কমলা রানীরদীঘি’ নামে। কয়েক বছরআগে ঐতিহাসিকদীঘিটি সোমেশ্বরী নদীগর্ভে বিলীনহয়ে যায়।এভাবেই প্রতিনিয়ত একটু একটুকরে বিলীনহয়ে যাচ্ছে সুসং রাজ্যেরধ্বংসাবশেষ। হয়তো একসময় সুসং রাজ্যশুধু লোকের মুখে আর কাগজে-কলমেইথাকবে তার আর কোন উপাদানরবে না সুসং জনপদে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০১৪ রাত ১০:৫০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×