somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অব্যক্ত (১ম খণ্ড)

১৫ ই জুন, ২০১০ দুপুর ১২:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[গল্পটা ক্যাডেট কলেজে থাকতে লেখা। তখন দ্বাদশ শ্রেণীতে উঠেছি মাত্র। কলেজ বাংলা সাময়িকীতে প্রকাশও হয়েছিল। তবে ব্লগে দেবার সময় শুধু গল্পের মূল দুটো চরিত্রের নাম পালটে দিয়েছি। কারণ দ্বিতীয়বারের মত আর ঝাড়ি খেতে চাই না। ]


আরো একটি দিন শুরু হল আমার। সেই ছকবাঁধা গদবাঁধা জীবন।আর ভাল লাগে না এসব। কার ভাললাগে এই কোলাহলময় পৃথিবীতে চুপচাপ-নিঃশব্দ হয়ে পরে থাকতে, অন্যের করূণা হয়ে বেঁচে থাকতে।

ঘর থেকে বের হয়ে ছাদে আসলাম। কী সুন্দর ঝলমলে আকাশ। সাদা টুকরো টুকরো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আপন মনে, ছুটে চলছে দূরের কোন অজানায়। ভোরের পাখিরা কিচিরমিচির করে মুখরিত করে তুলছে সমস্ত প্রকৃতি। বাড়ির দেয়াল ঘেষে বেড়ে ওঠা নাড়িকেল গাছটার যে ডালটা ছাদের ভেতর চলে এসেছে তাতে এখনো বিন্দু বিন্দু শিশির কণা জমে আছে। একটু পরে আলো পড়লেই তা মুক্তোর মত দেখাবে, আমি জানি। কারণ প্রতিদিন এসব দেখেই তো সময় পেরিয়ে যায় নিঃসংগ এই আমার।

আমি জানি, এখন নাড়িকেল গাছের ডালের ফোকর হতে একজোড়া চড়ুই বের হবে। তারপর তারা একসাথে কিচিরমিচির করবে কিছুক্ষণ। ছাদের রেলিংএ এসে বসবে। এদিক ওদিক ডানা ঝাপটাবে। তারপর ওদের ভাষায় বিদায় নিয়ে দুজন দুদিকে চলে যাবে, তবে সারাজীবনের জন্য নয়। সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবে , প্রিয়জনের কাছে-প্রিয়জনের জন্য। কী সুন্দর গোছালো, সাজানো তাদের জীবন। কী আনন্দময় তাদের বেঁচে থাকা, কী মধুর আবেগ, তাদের ভাষা। তারা এত সুন্দর করে কিচির মিচির করে নিজের হৃদয়ের কথাগুলো সঙ্গীকে এমনভাবে বোঝায় যে তা দেখে আমার বড্ড হিংসা হয়। ঈর্ষা হয়, কারণ তারা ছোট সৃষ্টি হয়েও মনোভাব প্রবলভাবে প্রকাশ করতে পারে অথচ আমি সৃষ্টি সেরা হয়েও তা পারিনা।

তাই মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে হয়, যদি চড়ুই হতে পারতাম। ডানামেলে সঙ্গীকে নিয়ে উড়াল দিতাম বিশাল শূন্যলোকে, নীলাকাশে। যেখানে আমার সঙ্গী শুধু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকবে আমার পানে আর আশ্চর্য হয়ে শুনবে আমার মনের সকল অব্যক্ত কথা, আমার সমস্ত স্বপ্ন, তাকে নিয়ে ভাবা আমার সব শখ, কল্পনা করা হাজারো কবিতার প্রথম চরণ।

এমন সময় বাবা ছাদে আসলেন। হাতে এক মগ পানি। ছাদের কোনায় লাগানো মানিপ্ল্যান্ট গাছের টবে পানি সেচ দিবেন। কিন্তু তার আগে তিনি রুটিন মাফিক আমাকে জিজ্ঞেস করবেন , “কেমন লাগছে শিহাব এই সুন্দর সকাল?” করলেনও তাই। আমিও মাথা ঝাকিয়ে বুঝিয়ে দিলাম অত্যন্ত চমতকার। যা প্রতি সকালেই করে থাকি এখন। বাবা আমার দিকে তাকালেন মমতার চোখ দিয়ে। আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। বাবার করুন চাহনি আমার সহ্য হয় না। অবশ্য প্রতিদিন দেখে একটু সয়ে গেছে ইদানিং। তারপরও খারাপ লাগে, প্রচণ্ড কষ্ট হয়। আমাদের তিন ভাইবোনের জন্য বাবা কিনা করেছেন। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে নিয়মিত অফিস করেছেন, কখনো কাজে ফাঁকি দেননি। তারপরও সংসারে পরিপূর্ণ স্বচ্ছলতা দেখতে পারলেন না।

মা তো একবার রেগে গিয়ে বলেই ফেলেছিলেন, “আচ্ছা তোমার সব কলিগরাই তো ঘুষ খেয়ে বড়লোক হয়ে গেছে, তুমি ঘুষ খাও না কেন?” বাবা ঠোটের কোণায় মুচকি হাসি এনে বললেন, ” কে বলল খাইনা; আমিতো সবার চেয়ে বেশি খাই তাই আমার উন্নতি সবচেয়ে কম কিংবা উন্নতি হয়ই না।” কথাটা বলেই তিনি হো হো করে হেসে উঠেছিলেন।

এক মাঝরাতে তিনি আমাদেরকে ছাদে ডেকে আনলেন। গোল করে বসালেন আমাদের সবাইকে। জ্যোসনা ভেজা সেই মধ্যরাতে তিনি আমাদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আচ্ছা বাবা হিসেবে তোরা আমাকে একশতে কত দিবি?” বড় আপা আর সুপ্তি চিতকার করে রাতের নিরবতাকে চুর্ণ করে বলেছিল, “একশতে একশ এক”। যেন পরীক্ষায় তারা প্রশ্ন কমন পেয়েছিল। অবশ্য আমি কিছু বলিনি। চুপ করে ছিলাম। দেখছিলাম চাদের আলোয় চকচক করে ওঠা বাবার কৌতূহলী মুখখানি, উতসুক চোখযুগল।

আজকে বাবাকে সে প্রশ্নের উত্তর দিতে খুব ইচ্ছে করছে। “বাবা তুমি কখনোই একশোতে একশ পাবে না। তুমি অর্ধেক পাবে, মানে পাবে পঞ্চাশ। কারন বাবা হিসেবে তোমার উচিত ছিল তোমার সন্তানদের শাসন ও ভালবাসা উভয়ই করার। কিন্তু তুমি তা করনি। তুমি কেবল ভালোইবেসেছ, শাসন করোনি।” তাই একশোতে পঞ্চাশ। কিন্তু আমি জানি , এ কথা আমি বাবাকে কোন সময়ই জানাতে পারব না। তা আর সম্ভব নয়।

তাই আমি বাবার সামনে থেকে সরে গেলাম।

আমি নারকেলের পাতা ধরে দাড়ালাম। পেছনে পায়ের শব্দ। জানি সুপ্তি এসেছে। স্কুলে যাবে এখন, ভাইয়াকে তাই বলতে এসেছে। আমি পিছন ফিরলাম। ও আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মিহি স্বরে বলল, “দাদা আমি পড়তে গেলাম, ঠিকমত খেয়ে নিস কিন্তু।” আমি মাথা নাড়ালাম, বাধ্য ছেলের মত।

আমি প্রায়ই সুবুরি বলে ডাকতাম যখন ছোট ছিল ও। খুবই রাগ করত আর ক্ষেপে যেত। তখন আমি আরো বেশি বলতাম। বলতাম, “তোর জন্য একটা বুড়ো বর এনে দেব।” ব্যস, মার কাছে নালিশ। মাতো হেসেই অস্থির। “ঠিক আছে বুড়ি, আমি ভাইয়াকে আচ্ছা করে বকে দেব”।

এখন আর ওকে বুড়ি বলে ডাকিনা, বলিনা বুড়ো বরের কথা। সবাইকে তো আর সারাজীবন সবকথা বলা যায় না। ও এখন বড় হয়েছে, বুঝতে শিখেছে। তাই ইচ্ছে থাকলেও আর বুড়ি বলিনা। শুধু চেয়ে দেখি আমার চোখের সামনে বেড়ে ওঠা আমার ছোট দিদিটাকে। যে একদিন শুধুই কাদত, আর এখন সবসময় কথা বলে প্রাণ চঞ্চল করে রাখে আমাদের পুরো পরিবারকে।

অবশ্য আমার সামনে নিতান্তই কম কথা বলে। কারণ আমি যে আর তাকে সুবুড়ি বলে ডাকিনা। কয়েকদিন আগে সে কাদতে কাদতে মাকে গিয়ে বলেছিল, “জান মা,দাদা না আমাকে আর বুড়ি বলে ডাকে না। আমার না খুব শুনতে ইচ্ছে করে” । আমি কথাটা শোনার পর সারারাত কেদেছি, বালিশে মুখ গুজে। মনে মনে তাকে জানানোর চেষ্টা করেছি, “তুইত জানিস দিদি, তোকে কেন বুড়ি বলিনা”।

সুপ্তি আমার সামনে থেকে চলে গেল। আমি উলটা ঘুরলাম। খুব সুন্দর হয়েছে ও, আগের থেকে। মেয়েদের নাকি সুন্দর বললে খুব পুলকিত হয়। আচ্ছা আমি কি সুপ্তিকে কোনদিন বলতে পারব, “তুই খুব সুন্দর হয়েছিস দিদি। আমি তোর জন্য বুড়ো বর নয় রাজপুত্র এনে দেব”।

হাতের পিছন দিয়ে চোখ মুছলাম। কারন মা আসছে খাবার নিয়ে ।কোন কথা বলবে না। চেয়ে চেয়ে আমার খাওয়া দেখবে। খাওয়া শেষে আচল দিয়ে মুখ মুছে দেবে। যাবার আগে আমার মুখের দিকে চেয়ে ডুকরে ডুকরে কেদে উঠবে। কোনদিন ব্যতিক্রম হয় নি, আজো হল না। সেই পরিচিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি।

দুপুর পর্যন্ত ছাদেই পায়চারি করে কাটালাম। দুপুরের পর সূর্য পশ্চিমাকাশে হেল দিল। কোলাহলময় পৃথিবী তার ব্যস্ততম সময় পার করেছে। এখন তার ব্যস্ততা আস্তে আস্তে কমে যাবে। আর সন্ধ্যেবেলা নিঝুম হয়ে যাবে।

চুপচাপ ভাবছি; অনেক কথা , অনেকের কথা। এমন সময় সুপ্তির কণ্ঠ শুনে চমকে উঠি আমি। “দেখ দাদা, কাকে নিয়ে এসছি”। আমি পাশ ফিরে তাকালাম। দেখলাম আমার একসময়ের অতি পরিচিতজন দাড়িয়ে আছে। আচ্ছা ওর তো আর আমাদের বাড়িতে আসার কোন প্রয়োজন নেই।

[চলবে]
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০১০ রাত ১০:৪৮
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

হামাস বিজয় উৎসব শুরু করেছে, ইসরায়েল বলছে, "না"

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:০৮



গতকাল অবধি হামাস যুদ্ধবিরতী মেনে নেয়নি; আজ সকালে রাফাতে কয়েকটা বোমা পড়েছে ও মানুষ উত্তর পশ্চিম দিকে পালাচ্ছে। আজকে , জেরুসালেম সময় সন্ধ্যা ৮:০০টার দিকে হামাস ঘোষণা করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:৩১


আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।

প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।

ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×