আজ ১৪ই মে রাতে ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টির ৭৩ বছর পূর্তি হলো। এমন এক মুহূর্তেই ইসরাইল তাদের রাষ্ট্র সৃষ্টির ৭৩ বছর পালন করছে যখন ইসরাইলি বাহিনীর ক্রমাগত স্থল আর বিমান হামলায় ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা ধ্বংসের শেষ সীমায় এসে পৌঁছিয়েছে। আজকের দিন পর্যন্ত গত কয়েকদিনের হামলায় ১১৩ জনের বেশি ফিলিস্তিনি বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। আজকের দিনটিকে ফিলিস্তিনিরা পালন করবে "আল নাকবা" অর্থাৎ দুর্ভাগ্য সূচনার দিন হিসেবে।
ইসরাইল সৃষ্টির পূর্বাপর
ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদি জাতির ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী সেই রোমান শাসনামল থেকেই বসবাস করে আসছিলো। শুরুর দিকে মুসলমানদের সাথে তাদের ভালো সম্পর্কই ছিল। বস্তুত ইহুদিদের শত শত বছর যাবৎ কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ছিলোনা। মূলত ইউরোপের বড় একটি অংশ জুড়ে বেশিরভাগ ইহুদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করতো। মূলত এদের মূল পেশা ছিল সুদের ব্যবসা। এই সুদের কারবার করেই ইউরোপে তারা আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছল অবস্থানে চলে যায়। তাছাড়া তাদের মধ্যে জাতিগত ঐক্য ছিল অত্যন্ত ভালো।
থিওডোর হার্জল , ইসরাইল রাষ্ট্রের ধারণা যিনি প্রথম একটি নাটকের মাধ্যমে দিয়েছিলেন
এবার আসা যাক ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড প্রসঙ্গে , ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দীর্ঘকাল থেকে তুর্কি শাসনের অধীন ছিল। ১৯১৭ সালে ব্রিটেন তুর্কিদের বিতাড়িত করে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের দখল নিয়ে নেয়। এরপর থেকেই ব্রিটিশরা চিন্তা ভাবনা শুরু করে যে ইউরোপের ইহুদিদের ধীরে ধীরে ফিলিস্তিনে নিয়ে আসার মধ্যে দিয়ে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে ইহুদি ও মুসলমানদের মধ্যে দুইভাগ করে দেয়া। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে , ইহুদিদের ইউরোপে খুব একটা ভালো চোখে দেখা হতো না , এবং অনেক সাধারণ ইউরোপীয়রা ইহুদিদের ঠগ এবং প্রতারক হিসেবে জানতো। এসব দিক বিবেচনা করেই ব্রিটেন চিন্তা করেছিল ইহুদিদের আরবে ট্রান্সফার করার। এই চিন্তা থেকেই , ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর ১৯১৭ সালে ইহুদি আন্দোলনের নেতা ব্যারন রথস চাইল্ডকে একটি চিঠি লিখে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে স্বাধীন ইসরাইলি রাষ্ট্র সৃষ্টির পরিকল্পনা জানান। তার এই চিঠিটি মূলত ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টির ভিত্তি হিসেবে নেয়া হয় যা কিনা ইতিহাসে বিখ্যাত "বেলফোর স্টেটমেন্ট" নামে পরিচিতি লাভ করে। তার এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইউরোপের ইহুদিরা ধীরে ধীরে ফিলিস্তিনে আসা শুরু করে। প্রথম দিকে ফিলিস্তিনের মুসলমানেরা সরল বিশ্বাসে তাদের স্বাগত জানায় এবং তাদের কাছে জমি বিক্রি করা শুরু করে। একপর্যায়ে তাদের এই আসা এটি বৃদ্ধি পায় যে সয়ং ব্রিটিশ প্রশাসন ইহুদিদের আরব ভূখণ্ডে এভাবে চলে আসায় উদ্বিগ্ন হয়ে পরে। ফিলিস্তিনি মুসলমানেরা অবশেষে বুঝতে পারে যে ইহুদিদের কাছে জমি বিক্রি করে তারা ভুল করেছে। পরে ব্রিটিশ প্রশাসন একটি ডিক্রি জারি করে যে বছরে ৭৫০০০ এর বেশি ইহুদি ইউরোপে থেকে ফিলিস্তিনে আসতে পারবে না। কিন্তু , ইহুদিরা ব্রিটিশ সরকারের এই নির্দেশ মানেনি।
লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর
বেলফোর স্টেটমেন্ট
এরপর এলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকেই এখানে আরব ইহুদি জাতিগত দাঙ্গা শুরু হয়। এরপর হিটলার কতৃক ইহুদি নিধনযজ্ঞ সমগ্র বিশ্বাসীর ইহুদিদের প্রতি সহমর্মী করে তোলে আর তৎকালীন ইহুদি নেতৃবৃন্দ এই সুযোগ লুফে নেয়। তারা পরাশক্তি গুলোকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া কখনোই ইহুদি জাতি টিকে থাকতে পারবে না। ফলশ্রুতিতে , ইসরাইল রাষ্ট্র তৈরির প্রক্রিয়া আরো গতিলাভ করে।আরব ইহুদি জাতিগত দাঙ্গা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। বাধ্য হয়ে ব্রিটেন ১৯৪৭ সালের নভেম্বর কি ডিসেম্বরে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ভাগ সংক্রান্ত বিষয়কে জাতিসংঘে নিয়ে যায় এবং , জাতিসংঘ কতৃক পৃথিবীর অন্য সকল পরাশক্তি দেশগুলোর মধ্যস্ততায় ফিলিস্তিন প্রথমবারের মত ভাগ হয়।
মজার বিষয় হল। ইহুদিরা তখনকার সময়ে ফিলিস্তিনের মোট জনসংখ্যার দশ ভাগ হলেও সমস্ত ভূখণ্ডের ৫৬ শতাংশ মালিকানা দেয়া হয় তাদের। মুসলমানদের জনসংখ্যা ফিলিস্তিনিদের থেকে বহু গুন্ বেশি হলেও তাদের দেয়া হলো ৪৬ শতাংশ মালিকানা। সমস্যা ও দীর্ঘ মেয়াদি সংঘাতের শিকড় প্রোথিত হল এখানেই। যৌক্তিক ভাবেই আরবরা এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। তারা তাদের ন্যায্য হিস্সা দাবি করে জাতিসংঘের কাছে। জেরুজালেমকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণাধীনে রাখে। কিন্তু , মুসলিম , ইহুদি এবং খ্রিস্টান এই ধর্মের কাছে গুরুত্বপূর্ণ জেরুজালেম এর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ কোনো পক্ষই মেনে নেয়নি। সব পক্ষই এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে।
আরব ইহুদি জাতিগত দাঙ্গা চলতেই থাকে। এহেন পরিস্থিতে ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে ব্রিটেন ফিলিস্তিনে তাদের শাসনের অবসান ঘটিয়ে চলে যায়। ওই দিন রাতে ইহুদি নেতারা তেল আবিবে একত্রিত হয়ে এক তরফাভাবে সরকার গঠন করে ইসরাইল নামের রাষ্ট্র সৃষ্টির ঘোষণা দেয়া হয়। ব্রিটেন অবশ্য তাদের দাবি অস্বীকার করে। শুধু তাই নয়, ব্রিটেন এ-ও ঘোষণা দেয়, আরবরাও যদি অনুরূপ সরকার গঠন করে তাহলেও তা তারা অস্বীকার করবে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র ঐদিন রাতেই ইসরাইলকে স্বীকৃতি জানায়। এরপর স্বীকৃতি দেয় গুয়াতেমালা। বিচক্ষণ ইহুদি নেতারা জানতো যে তারা রাষ্ট্র সৃষ্টি করলে আরবরা কখনো তা মেনে নেবে না এবং তাদের নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করবে , তাই বহু বছর থেকেই তারা সামরিক দিক দিয়ে নিজেদের শক্তিশালী করে গড়ে তোলে। ১৯৪৮ সালের ১৫ই মে মিশর , ইরাক লেবানন , জর্দান ও সিরিয়া এই পাঁচটি দেশ একযোগে ইসরাইল আক্রমণ করে। কিন্তু আশ্চর্যজনক মাত্র ছয়দিনের যুদ্ধে ইসরাইল এই পাঁচটি দেশকে এক সাথে পরাজিত করে সিরিয়ার বিস্তীর্ণ গোলান উপত্যকা এবং মিশরের সিনাই উপত্যকা দখলে নিয়ে পৃথিবীতে সুপার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভুত হয়। এর পর পরবর্তীতে ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে আরো তিনবার আরব ইসরাইল যুদ্ধ হয়। প্রতিবারই ইসরাইল যুদ্ধে জয় লাভ করে । সিরিয়া গোলান উপত্যকা পুরোপুরি আর ফিরে পায়নি। মিশর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সিনাই ফেরত পেলেও বাধ্য হয় ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি করতে এবং ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে।
ডেভিড বেন গুরিওন কতৃক ইসরাইল রাষ্ট্রের ঘোষণা
যুদ্ধ অদ্যাবধি চলছে। ৭৩ বছরে কয়েক প্রজন্ম চলে গেছে কিন্তু যুদ্ধ শেষ হয়নি। এখনো সহিংসতায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নাগরিক নিহত হচ্ছে। মোটা দাগে আজকের এই সমস্যার জন্য ঐতিহাসিক ভাবে কিছু বিষয় কে কখনোই এড়িয়ে যাওয়া যাবে না সেগুলো হচ্ছে :
১। ইহুদিরা আসার আগেই ফিলিস্তিনিরা ছিল স্বাধীন জাতি , হয়তো ব্রিটেন ফিলিস্তিন দখল করেছিল যেমন করেছিল আমাদের ভারতবর্ষকে কিন্তু তারপরেও মুসলমানরা সেখানে সংখ্যাগুরু ছিল। ইউরোপিয়ানদের কাছে ইহুদিরা বোঝা হতে পারে , কিন্তু তাই বলে ব্রিটেনের কখনোই উচিত হয়নি ইহুদিদের ফিলিস্তিনে ট্রান্সফার করানো। একটি স্বাধীন দেশে অন্য জাতিগস্থর অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে দেশকে দুই ভাগ করার পরিকল্পনা করা।
২। মুসলমানদের উচিত হয়নি ইহুদিদের সরল মনে বিশ্বাস করা , তাদের কাছে জমি বিক্রি করা। মুসলমানদের বোঝা উচিত ছিল , কেন এবং কি কারণে ইউরোপিয়রা ইহুদিদের ইউরোপ থেকে বিতাড়ন করতে চায়।
৩। জাতিসংঘ কতৃক ইহিদীদের মোট ভূমির ৫৬ শতাংশ প্রদান ছিল অন্যায় , যুক্তিহীন এবং পক্ষপাত মূলক একটি সিদ্ধান্ত। স্বভাবতই মুসলিম সংখ্যাগুরুরা এই সদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। সংঘাতের বীজ সেদিন থেকেই রোপন করা হয়েছিল। এবং ৭৩ বছরে সেই বীজ আজ একটি বিশাল বিষ বৃক্ষে পরিণত হয়েছে (আজ যদি বাংলাদেশের বেশির ভাগ ভূমি রোহিঙ্গা জনগোষ্টিকে দেয়া হয় আপনি কিংবা আমি কেউ তা মেনে নেবো না।
৪। সর্বোপরি মুসলিম বিশ্বের অনৈক্য ও বিচক্ষণ ইহুদি নেতৃত্ব ছিল ইসরাইল সৃষ্টির বড় প্লাস পয়েন্ট। ১৯৪৮ সালে পাঁচটি দেশ ইসরাইলকে আক্রমণ করে বটে , কিন্তু তা ছিল বিচ্ছিন্ন আর অপরিকল্পিত। অন্যদিকে ইসরাইলি নেতৃত্ব ছিল অত্যন্ত বিচক্ষণ। অনৈক্য মুসলমানদের দুর্দশার একটা বড় কারণ।
ইসরাইল হতে পারে তথ্য , প্রযুক্তি , শিক্ষা ,দীক্ষা , বিজ্ঞান ও সমরাস্ত্রে ঈর্ষণীয় সফল একটি দেশ। কিন্তু , যে দেশের ভিত্তি হচ্ছে মিথ্যা , প্রতারণা আর উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা , সে দেশ কখনোই নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করতে পারে না।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০২১ রাত ১০:৫৫