নৈতিকতা অথবা মূল্যবোধ হলো রীতিনীতি ও আদর্শের মাপকাঠি; যা সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। নীতি ভালো-মন্দের মধ্যে একটা স্পষ্ট পার্থক্য গড়ে দেয়। সুতরাং ভিত্তি যদি নড়বড়ে হয়ে যায়, তাহলে সে সমাজ বা রাষ্ট্রের অনেক কিছুতেই ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে অথবা আরেকটু বাড়িয়ে বললে সাম্প্রতিক বেশ কিছু বছর ধরেই আমাদের দেশে নৈতিকতার স্খলন প্রকট আকারে ধরা পড়ছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়া এই টিউমার এখন ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে। প্রতিনিয়তই আমরা মূল্যবোধ অবক্ষয় জনিত ঘটনা গুলো প্রত্যক্ষ করছি। অবস্থা এখন এমন যে , একটি ঘটনার নির্মমতা ও বীভৎসতা আরেকটি ঘটনাকে হার মানাচ্ছে। সমাজের সর্বস্তরে চরমভাবে বিরাজ করছে অসহিষ্ণুতা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য ও আলোচিত ঘটনাগুলোর দিকে আমরা একবার দৃষ্টিপাত করি। সেই কুমিল্লায় সংঘঠিত ভয়াবহ তনু হত্যাকান্ড , বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ব্ল্যাকমেইলিং এর মাধ্যমে যৌন নির্যাতন , ফেনীতে নুসরাতকে তারই মাদ্রাসা শিক্ষক কতৃক পুড়িয়ে হত্যা , অথবা এর আগে ঘটে যাওয়া ত্বকী হত্যাকান্ড এবং বেশ কিছু শিশু হত্যা, গত বছরের শেষভাগে ভয়াবহ পাশবিক নির্যাতনের মাধ্যমে কলাবাগানে স্কুলশিক্ষার্থী আনুশকাকে হত্যা কৈশোর বয়সে চারিত্রিক অধঃপতনের অন্যতম বড় নজির। কোনো ঘটনার কুলকিনারা কোনোদিন হয়নি। এই গতমাসেই ঘটে যাওয়া গুলশানে কলেজ শিক্ষার্থী মুনিয়া হত্যাকান্ড ও এর সাথে দেশের অত্যন্ত ক্ষমতাবান একজন শিল্পপতির সম্পৃক্ততা আমাদের সমাজের মূল্যবোধজনিত অবক্ষয়ের চরম নজির। সর্বশেষ , গেলো সপ্তাহে ঘটে যাওয়া দক্ষিণখানের এক মসজিদের ইমাম কতৃক পরকীয়া জনিত কারণে এক গার্মেন্টসকর্মীকে ছয় টুকরা করে হত্যা ও পরবর্তীতে সেপটিক ট্যাংকে সেই লাশের টুকরা গুম করে ফেলা যেন বীভৎসতা ও পাশবিকতার সকল সীমা অতিক্রম করেছে।
কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে কেন এমন হচ্ছে ??? কেন আমরা বর্বরতা আর পৈশাচিকতার এই নির্মম দৃশ্যগুলো অবলোকন করছি ?? বাঙালি জাতিসত্তার যে হাজার বছরের বিবর্তন , আমাদের পূর্ব ঐতিহ্য , আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ কোনো কিছুই তো এসব অনৈতিক কার্যকলাপ প্রশ্রয় দেয়না।তাহলে কেন আমাদের এই অস্বাভাবিক পরিবর্তন যেখানে পাশবিকতা একটা শিল্পে পরিণত হতে যাচ্ছে ??? সবকিছুরই কারণ আছে। আমাদের ভেতরের বীভৎস বীরের ছায়াটা যে বেরিয়ে আসছে বেশি করে, কারণ আইন-শাসন-নজরদারি-জবাবদিহি মারাত্মক শিথিল। অনেক ক্ষেত্রে রক্ষকেরাই ভক্ষণের পৈশাচিকতা চালায়। এই সমাজে একটার পর একটা অপরাধ সংঘঠিত হচ্ছে , কিন্তু কোনোকিছুরই বিচার আমরা দেখতে পাচ্ছি না। একটা ঘটনার জের শেষ হতে না হতেই আরেকটা ঘটনা ঘটে , প্রত্যেকটি নতুন ঘটনার তীব্রতা আর বীভৎসতা তার পূর্বেরটা থেকে বেশি। মানুষ অমৃতের সন্তান নয়। আব্রাহামিক ধর্মগুলোর দিকে আমরা যদি তাকাই তাহলে আমরা দেখতে পাই যে , সেসকল ধর্মে বর্ণিত আছে , ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের খুনই আদিতম হত্যাকাণ্ড। হিংস্রতা, জিঘাংসা, অসূয়া আমাদের সহজাত। তা সামলাতে আমরা আইন বানিয়েছি, রাষ্ট্র বানিয়েছি, সংস্কৃতির সাধনা করে আসছি, ধর্ম দিয়ে অধর্ম ঠেকাতে গিয়েছি। ভেবেছি, এগুলোই আমাদের ভেতরের সহজাত হিংস্রতাকে নীতি ও শাসনের শিকলে আটকে রাখবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা কি আমাদের ভেতরকার অসুরকে শুভবোধ দিয়ে বধ করতে পেরেছি নাকি ক্রমাগতই আমাদের অভ্যন্তরীণ অসুরই আমাদের গিলে খাচ্ছে ??
এই সমাজে মানুষ দেখে হত্যা করেও হত্যার কোনো বিচার হয়না , জুলুম নির্যাতন করেও মানুষ সমাজে বুক ফুলিয়ে হেটে বেড়ায় , ধর্ষণের চরম পাশবিকতার সীমা লংঘনের পরেও ধর্ষকের কোনো শাস্তি হয়না , টাকার কাছে সমস্ত আইন -কানুন পরাজিত ও পরিবর্তিত হয়ে যায় , নিয়ম ভঙ্গকারীকে সমাজে বাহবা দেয়া হয় , যেকোনো নিয়মভঙ্গ করে অনৈতিক সুবিধা আদায়কে মানুষ বীরোচিত কাজ বলে মনে করে , সমাজে যে সৎ ভাবে বাঁচতে চায় , সরল ও সাদাসিধা জীবনযাপন করে তাকে বোকা , ভীতু প্রভৃতি বিশেষণে বিশেষায়িত হতে হয়। তাহলে , এই সমাজের মানুষ কি করবে !!! কি চিন্তা ও কি ধারণা নিয়ে এই সমাজের মানুষ বেড়ে উঠবে !!!
অনৈতিকতা , অসততা , বীভৎসতা যখন একটি সমাজের মূল্যায়নের মাপকাঠি হয় তখন মানুষ সেই পথেই অগ্রসর হয়। গ্লোবালাইজেশনের যুগে মানুষে মানুষে প্রতিযোগিতা অনেক বেড়ে গেছে , এই প্রতিযোগিতা অর্থ সম্পদ অর্জনের , এই প্রতিযোগিতা অফিসে কে কার চেয়ে কত আগে উঁচু পোস্টে যেতে পারে তার , এই প্রতিযোগিতা সুন্দরী তরুণীর জন্য একাধিক তরুনের যেখানে কাঙ্খিত প্রেমিকাকে পেতে তরুণটি খুন করতেও পিছপা হয়না , এই প্রতিযোগিতা আরেকজনের স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক গড়ে তাকে ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়া এজন্য স্বামী বেচারাকে শেষ পর্যন্ত জীবনও দিতে হয়। ভালোবাসা এখন শুধুই শরীর নির্ভর যেখানে প্রেমিকাকে চরম পাশবিকতায় জীবন পর্যন্ত দিতে হয় , বিবাহিত পুরুষের আর এক নারীতে মন ভরে না , তার চাই আরো সুন্দরী কমনীয় রক্ষিতা বা উপ-পত্নী।
সমাজের চারদিকেই শুধু চাই চাই আর চাই। আরো টাকা চাই , বাড়ি চাই , সুন্দরী গার্লফ্রেন্ড চাই , আরো উপরের পদবি চাই এজন্য কাউকে ল্যাং মারার দরকার হলেও আপত্তি নেই। বাজার অর্থনীতির তুমুল হাওয়ায় পাতলা মেঘের মতো ছিঁড়ে-ফুড়ে উড়ে যাচ্ছে আমাদের সমাজের নৈতীক মূল্যবোধ । আমাদের অনিঃশেষ চাওয়া পূরণ করতে গিয়ে আমরা ভুলে গেছি নীতি নৈতিকতার সীমা , আমরা ভালো মন্দে আর বাছ-বিচার করছি না। ফলশ্রুতিতে , এক ঘোর অমানিশায় আমাদের সমাজ তলিয়ে যাচ্ছে। একদিন সমাজের সামনে যে আদর্শ ও ব্যক্তিত্ব ছিল, আজ সেগুলো সুবিধাবাদ ও স্বার্থপরতায় ভূলুণ্ঠিত অথবা অকেজো। ভালো মানুষ সব ক্ষেত্রে পরাজিত ও ভীত। দুর্বৃত্ত ও অপরাধীরা রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে। এহেন অবস্থায় সমাজে বীভৎসতা আর পাশবিকতারই জয়জয়কার থাকে।
এর থেকে কিভাবে আর কতদিনে আমরা মুক্তি পাবো ?? আমাদের সমাজের এই পশ্চাৎ যাত্রা কি অব্যাহত থাকবে ??? উত্তর হচ্ছে, আমাদের সমাজে শুধু আইনের নয় আমাদের সমাজে নীতির শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে । এবং সেই নীতিটি হচ্ছে সুনীতি আর সুবোধ চিন্তা। সমাজে অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধীর প্রাপ্য বিচার নিশ্চিত করে সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। আমাদের বিদ্যালয়গুলোকে কি আমরা সঠিক শিক্ষালয় হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছি ??? নীতির শিক্ষা শুধু ছাত্র-ছাত্রী নয় , শিক্ষকদের মাঝেও দিতে হবে। একটি শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা পরিবার থেকেই শুরু হয় , আমাদের ছোটবেলায় আমরা আদর্শলিপি আর আদি বাল্যশিক্ষা পাঠ করে আমাদের বিদ্যার্জন শুরু করেছিলাম। সেসব বইতে খুব ভালো ভালো বেশ কিছু নীতিকথা ছিল , যেমন , দুর্জনের সঙ্গ পরিত্যাগ করো , শঠতা পরিহার করো , হিংসা ধ্বংসের মূল। মনে হচ্ছে যেন , সেই বইগুলিকে আবার আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে হবে। ধর্মীয় মূল্যবোধ সৃষ্টি সমাজে অপরাধ প্রবণতা কমিয়ে নিয়ে আসতে পারে। আমাদের দেশে তো সিংহভাগ মানুষই ধর্মপ্রাণ , নিয়মিত প্রার্থনা ও ইবাদতে অংশ নেয়া মানুষের সংখ্যাও তো কম না। কিন্তু , তারপরেও আমরা উগ্রতা , পৈশাচিকতা পরিহার করতে পারছি না কেন ??? এর মূল কারণ হচ্ছে , আমরা আমাদের ধর্মকে শুধু দৈনন্দিন আচার পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছি কিন্তু ধর্মের মূল বিষয় , মূল শিক্ষা , রিলিজিয়াস প্রিন্সিপাল আমরা আমাদের জীবনে কাজে লাগাই নাই , ধর্মীয় মূল্যবোধ কে আমাদের জীবনঘনিষ্ঠ করি নাই , এবং ধর্মীয় নির্দেশনা আমরা শুধু শুনেছি কিন্তু বাস্তব জীবনে তার প্রয়োগ করি নাই। ধর্মের সঠিক শিক্ষার অভাবে যেমন দেশে বক ধার্মিক লোকের সংখ্যা বেড়েছে , ঠিক তেমনি ধর্মের লেবাসে এমনকি ধর্মীয় ব্যাক্তিত্বের সংশ্লিষ্টতায় অপরাধ ও সংগঠিত হচ্ছে। দক্ষিণখানের ইমাম সংক্রান্ত ঘটনা তারই একটি উদাহরণ।
পরিশেষে , হাজার বছরের লালিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও পারিবারিক আবহে গড়ে ওঠা বাঙালি সমাজ নৈতিক অবক্ষয় জনিত যে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে , নতুন আদর্শ , নীতিবোধ, আইনের শাসন নিশ্চিত করতে না পারলে, গোটা সমাজকে অসুরবিনাশী করতে না পারলে আমাদের আশা নেই।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০২১ দুপুর ১২:০৫