somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অসলো চুক্তি : ইসরাইল -ফিলিস্তিন সংকট নিরসনে ৭৩ বছরের মধ্যে একমাত্র কার্যকর উদ্যোগ

২৮ শে মে, ২০২১ রাত ৮:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ইসরাইল আর ফিলিস্তিনের মধ্যে সংকট নিরসনের লক্ষ্যে বিগত৭৩ বছরে নেয়া সংলাপ উদ্যোগ ও চুক্তি গুলোর দিকে যদি দৃষ্টিপাত করা হয় , তাহলে নিঃসন্দেহে অসলো চুক্তি ছিল সর্বাপেক্ষা কার্যকরী উদ্যোগ। অসলো চুক্তি হচ্ছে ইসরায়েল এবং প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) এর মধ্যে হওয়া একাধিক চুক্তির সম্মিলিত রূপ। এর আওতায় ১৯৯৩ সালে নরওয়ের রাজধানী অসলোতে অসলো চুক্তি ১ সই হয়, এবং তার ধারাবাহিকতায় মিশরের তাবায় ১৯৯৫ সালে অসলো চুক্তি ২ স্বাক্ষরিত হয়।

অসলো চুক্তির পটভূমি
ইসরাইল আর ফিলিস্তিনিদের মধ্যে কি সমস্যা , সমস্যার কারণ , সূত্রপাত এসব হয়তো আমাদের আর কারোরই অজানা নয়। পিএলও প্রধান ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত চিরকালই ছিলেন শান্তিকামী নেতা। তিনি সর্বদাই যুদ্ধ বিগ্রহ এড়িয়ে আলোচনা আর সমঝোতার মাধ্যমেই সমস্যা সমাধানের বিষয়ে আন্তরিক ছিলেন। যদিও একজন গেরিলা নেতা হিসেবেই তার উত্থান ঘটেছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে বিশ্বরাজনৈতিক পরিস্থিতি , ইসরাইলের সামরিক আর অর্থনৈতিক দাপট, যুক্তরাষ্ট্রের ইসরাইলের প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন এবং ইউরোপীয় শক্তিগুলোর ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধিকারের বিষয়ে ক্রমাগত নীরবতা , ইয়াসির আরাফাতকে এটা উপলদ্ধি করায় যে আর যাই হোক যুদ্ধ-বিগ্রহের মাধ্যমে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন সমঝোতার মাধ্যমে একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছানোর। কিন্তু , প্রতিটিবার বাধা হয়ে আসে ইসরাইলি নেতাদের ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে মারাত্মক কট্টর মনোভাব। তারা ফিলিস্তিনিদের স্বায়ত্তশাসন তো দূরের কথা মানুষ হিসেবে ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব পর্যন্ত স্বীকার করতে চাইতো না। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুণঃনির্বাচিত হন আইজাক রবিন । ইসরাইলের রাজনীতিতে আইজাক রবিন একজন উদারনৈতিক নেতা হিসেবে পরিচিত । মার্কিন কূটনীতিবিদ ডেনিস রসের মতে, ইসরায়েলের সর্বাপেক্ষা ধর্মনিরপেক্ষবাদী ইহুদি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আইজাক রবিন । তিনি বেশভালোভাবেই বুঝেছিলেন যে ফিলিস্তিনিদের স্বাধিকার আন্দোলন কোনো বিচ্ছিন্ন আন্দোলন নয় , এবং ফিলিস্তিনি নাগরিকদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার রয়েছে । এবং একারণেই ইয়াসির আরাফাতের পিএলও এবং আইজাক রবিনের নেতৃত্বে ইসরাইল প্রশাসন দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে নরওয়ের রাজধানী অসলোতে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা অসলো চুক্তি নাম পরিচিত ।

কি ছিল অসলো চুক্তিতে
১৯৯৩ সালে নরওয়ের রাজধানী অসলোতে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে স্থির হয়, পশ্চিমতীর ও গাজা উপত্যকা থেকে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী পর্যায়ক্রমে সরে যাবে। পাঁচ বছরের জন্য "অন্তর্বর্তী স্বশাসিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ" গঠিত হবে। এরপর জাতিসংঘের ২৪২ ও ৩৩৮ প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্থায়ী সমাধান হবে। এর মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে লিখিত না হলেও এ ইঙ্গিত থাকে যে একদিন ইসরায়েলের পাশে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠিত হবে। এই চুক্তি অনুসারে ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি হিসেবে পিএলও ইসরায়েল রাষ্ট্র মেনে নেয়। ইসরায়েলিরা মেনে নেয় যে, ফিলিস্তিনি লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছে। অসলো চুক্তি অনুসারে প্যালেস্টাইন অথোরিটি নামে একটি অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠিত হয়; যারা পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকায় স্বায়ত্তশাসন কায়েম করেছিল । এই চুক্তিতে উল্লেখ ছিল যে , পিএলও ইসরাইলের স্বীকৃত স্থায়ী মিত্র হিসেবে বিবেচিত হবে যার ফলে বিবদমান প্রশ্নগুলো গুলো নিয়ে আলোচনা করার দ্বার উন্মুক্ত হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো ছিল ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনের সীমানা নির্ধারণ, ইসরাইলিদের আবাসন প্রক্রিয়া, জেরুজালেমের অবস্থান, ইসরাইলি মিলিটারীদের উপস্থিতি এবং ফিলিস্তিনের স্বায়ত্তশাসন স্বীকার করে নেওয়ার পর মিলিটারীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কী করা হবে ও ফিলিস্তিনিদের ফিরে আসার অধিকারের ব্যাপারে আলোচনা করা। তবে এটাও সত্য যে অসলো চুক্তিতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন নিয়ে কিছু বলা হয় নি। শুধুমাত্র ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল।

আসলো চুক্তি পরবর্তী প্রতিক্রিয়া
অসলো শান্তি চুক্তির পর নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন এবং পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত। সমগ্র বিশ্বনেতারা এই চুক্তিকে সাদরে গ্রহণ করে এবং প্রধানমন্ত্রী রবিন এবং ইয়াসির আরাফাত ব্যাপকভাবে প্রসংশিত হন। প্যালেস্টাইন অথোরিটি নামে ফিলিস্তিনে একটি অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠিত হবার ফলে ফিলিস্তিন আপাত দৃষ্টিতে একটা শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে আসে। ইসরাইলের উদারপন্থী ররাজনীতিবিদদের মধ্যেও এই চুক্তি প্রসংশিত হয়। এই চুক্তির ফলে দীর্ঘদিন ধরে আরব ভূখণ্ডে চলে আসা সংঘাত নিরসনে একটা আলোর দেখা পাওয়া গিয়েছিলো।

অসলো চুক্তি ব্যার্থ হবার কারণ
যাই হোক শেষ পর্যন্ত অসলো চুক্তি সফলতার মুখ দেখেনি। ইসরাইলের ইহুদিপন্থী কট্টর রাজনীতিবৃন্দ এই চুক্তির তুমুল সমালোচনায় নেমে পড়ে। তারা প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিনকে বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৫ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তেল আবিবে ঈগল আমির নামে এক কট্টরপন্ধি ইহুদি গুপ্তঘাতকের গুলিতে প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন নিহত হন। আর , এর পর পরেই অসলো চুক্তির ভবিষ্যৎ অন্ধকারের দিকে যেতে থাকে। অন্যদিকে , ফিলিস্তিনি কট্টর পন্থী রাজনৈতিক দল হামাস চুক্তির পরপরেই এই চুক্তি প্রত্যাখ্যান এবং ইয়াসির আরাফাতের কঠোর সমালোচনা করে। এর মধ্যে দিয়েই ফিলিস্তিন পশ্চিম তীর আর গাজা উপত্যকা এই দুই শাসনতান্ত্রিক অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে পরে। পশ্চিম তীর ইয়াসির আরাফাতের ফাতাহ পার্টির নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং পিএলও এর প্রধান কার্যালয় সেখানে স্থাপিত হয়। অন্যদিকে , হামাসের আয়ত্তাধীন থাকে গাজা উপত্যকা। ফিলিস্তিনি ঐক্য শেষপর্যন্ত বিলীনের দিকে যেতে থাকে। সর্বশেষ , চুক্তির আওতাধীনে একাধিক চুক্তি সই হয়, যদিও এ চুক্তির কার্যক্রম ২০০০ সালের ক্যাম্প ডেভিড সম্মেলনের ব্যর্থতা ও দ্বিতীয় ইন্তিফাদার (গণঅভ্যুত্থান) পরে ভেঙে যায়।

অসলো চুক্তি সফল হলে কি হতো
আসলো চুক্তি এমন একটা সময়ে হয়েছিল যখন , ফিলিস্তিন , ইসরাইল , আর যুক্তরাষ্ট্র তিনটি দেশেই উদারনৈতিক ব্যাক্তিবৃন্দ রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে ছিলেন। ইয়াসির আরাফাত , আইজাক রবিন এবং বিল ক্লিনটন তিনজনেই সকল প্রকার স্বার্থ আর সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের উর্ধে ওঠে শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি স্থাপনের জন্য এই চুক্তির পক্ষে কাজ করেছিলেন l এই চুক্তি সফল হলে অন্তত আজ ফিলিস্তিন আলাদা একটি রাষ্ট্রের মর্যাদা পেতো। তা না হলেও ব্যাপকভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করতো যেমন করছে হংকং কিংবা তাইওয়ান। কিন্তু , ফিলিস্তিন আর ইসরাইল দুই দেশের কট্টরপন্ধীদের বিরোধিতায় আর বিদ্বেষে তা আর হয়ে উঠলো না।

আজ ২০২১ সালে এসেও কিন্তু কার্যকরভাবে দুই রাষ্ট্র সমাধান কে সংকট উত্তরণের মূল হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনায় পরিস্থিতি এখন অনেক জটিল কারণ ফিলিস্তিনে প্রভাব বিস্তার করে আছে চরমপন্থী হামাস আর ইসরাইলের ক্ষমতায় আছে কট্টরপন্থী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন লিকুদ পার্টি। দুই পক্ষের চরম আক্রমণাত্মক মনোভাবের কাছে কোনোধরনের ছাড় কিংবা চুক্তি আশা করা দূরাশারই নামান্তর।

কট্টর মনোভাব পোষণ কখনোই শান্তি আন্তে পারে না। পৃথিবীর বড় বড় সমস্যা উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই সমাধান করা হয়েছে।




সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০২১ রাত ৯:২০
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×