রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ইতিমধ্যেই প্রায় দুই সপ্তাহ পার হয়েছে । এই যুদ্ধ সম্ভবত একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে পরিণত হতে যাচ্ছে ।যুদ্ধ নিয়ে নানা হিসাব নিকাশের মধ্যে এখনো কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট হয়নি যে আসলে এই যুদ্ধের মূল কারণ কি ?? কিংবা এই যুদ্ধের জন্য দায়ী প্রভাবক গুলো কি কি?? অবস্যই আগ্রাসন কখনো স্বাগত কিংবা সমর্থন জানানোর মত বিষয় না , কিন্তু তারপরেও প্রতিটা যুদ্ধের পেছনে একটা পটভূমি থাকে । এই যুদ্ধ নিয়ে পুরো বিশ্ব দুটো শিবিরে ভাগ হয়ে শুধু নিষেধাজ্ঞা আর হুমকি ধামকি দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু গভীরভাবে যুদ্ধের কারণ অনুসন্ধানে খুব কম পর্যবেক্ষককেই সক্রিয় হতে দেখা গেছে । আসুন মোটাদাগে এই যুদ্ধের মূল কারণ গুলো অনুসন্ধান করা যাক :
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে সেই সতেরো শতক থেকেই কৃষ্ণ সাগরের উত্তর ভূমির নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখে আসছে । রাশিয়া সবসময়ই এই অঞ্চলকে তাদের নিজেদের প্রভাব বলয়ে রাখতে চেয়েছিলো । ইউক্রেন আসলে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নেরই একটি অংশ ছিল । সোভিয়েত ইউনিয়নের সবচাইতে অগ্রসরমান অঞ্চল ছিল এইটাই , সেটা কৃষি , শিল্প কিংবা পরমাণু প্রযুক্তি সবদিক থেকেই । কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সময় , ওই সময়টাতে বেলারুশের মিনস্কে একটা চুক্তি সই হয়েছিল পশ্চিমা দেশ গুলোর সাথে রাশিয়ার , যার অন্যতম মূল পয়েন্ট ছিল যে, ন্যাটো জোট সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যেই দেশ গুলো হবে তাদেরকে কখনোই জোটে অন্তর্ভুক্ত করবে না । এই চুক্তির পরেই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের একেকটা বিশাল অঞ্চল ভেঙে স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল । কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো এবং তাদের ন্যাটো জোট কথা রাখেনি , ধীরে ধীরে অনেক সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্রকেই তাদের জোটভুক্ত করে নেয় । সবশেষ যখন রাশিয়ার নাকের ডগার ইউক্রেন ন্যাটো জোটে যোগ দিতে গেলো গন্ডগোল লাগলো তখনই । কেউ যদি রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণ নিয়ে গবেষণা করে , এর পেছনে শতকরা ৫০ ভাগ দায়ী হচ্ছে ইউক্রেনের ন্যাটো জোটে যোগ দিতে চাওয়া । এটি অন্যতম কারণ । কিন্তু কথা হচ্ছে অনেক দেশই তো গেলো তাহলে ইউক্রেন গেলে সমস্যা কি ?? ইউক্রেন ন্যাটোতে গেলে মূল সমস্যা হচ্ছে রাশিয়ার সামরিক নিরাপত্তায় মারাত্মক বিঘ্ন ঘটা । একটু পেছনে দেখলেই দেখা যাবে যে , হিটলার কিন্তু এই ইউক্রেনের মধ্যে দিয়েই রাশিয়ায় ঢুকেছিলো । একটি অনুগত ইউক্রেন রাশিয়ার সামরিক নিরাপত্তার পূর্বশর্ত যা কিনা প্রেসিডেন্ট পুতিন খুব ভালো করেই জানে । ন্যাটোতে যোগ দিলে রাশিয়ার প্রতি আনুগত্যের আর সামান্যই অবশিষ্ট থাকবে ।
আমরা সবাই জানি রাশিয়া পৃথিবীর শীর্ষ তেল ও গ্যাস যোগানদানকারী দেশ । ইউরোপের মোট গ্যাসের চাহিদার শতকরা ৬৫ ভাগ আসে রাশিয়া থেকে । এই রাশিয়ার গ্যাসই পাইপলানের মাধ্যমে ইউক্রেন হয়ে ইউরোপের আর সব দেশে যায় , গ্যাসের এই পাইপ গেছে ইউক্রেনের মধ্যে দিয়ে । সোভিয়েত জমানায় ইউক্রেন বৃহত্তর রাশিয়ারই একটি অংশ ছিল , তাই এই গ্যাস পাইপের জন্য ইউক্রেনকে রাশিয়ার কোনো চার্জ দিতে হতোনা । কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর যখন স্বাধীন ইউক্রেন জন্ম নিলো তার পর থেকেই ইউক্রেন রাশিয়ার এই গ্যাস পাইপলানের জন্য চার্জ আরোপ করে । লক্ষ্য করুন পাঠক , ১০০০ ঘনফুট গ্যাস ১০০ কিলোমিটার যেতে পোল্যান্ড যেখানে নেয় ১ ডলার , সেই একই সমপরিমাণ গ্যাসের জন্য ইউক্রেন রাশিয়ার কাছ থেকে নেয় ২.৫ ডলার !!! রাশিয়াকে চাপে ফেলে ইউক্রেনের এরকম সুবিধা নেয়া মোটেই উচিত হয়নি । শুধু তাই না ইউক্রেন এই পাইপলাইন থেকে গ্যাস চুরির দায়ে বেশ কয়েকবার অভিযুক্ত হয়েছে এবং ইউক্রেন সেটা স্বীকারও করেছে ।
ইউক্রেন হামলার পরিকল্পনা কিন্তু প্রেসিডেন্ট পুতিনের এখনকার না । এই যুদ্ধ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু সেই ২০১৪ থেকে । ২০১৪ সালেই প্রেসিডেন্ট পুতিন একরকম বিনা বাধায় ক্রিমিয়া দখল করে নিয়ে ইউক্রেনকে সতর্কবার্তা দিয়েছিলো । মূলত ক্রিমিয়া দখলের পেছনে পুতিনের আরো উদ্দেশ্য ছিল , ক্রিমিয়ার বেসিনে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন গ্যাসের মজুদ রয়েছে , এই গ্যাসের দখল রাশিয়ার চাই । এছাড়াও ক্রিমিয়ার সমুদ্রবন্দর সেভাস্তোপোল এর এক বিশেষ গুরুত্ত্ব রয়েছে রাশিয়ার কাছে । সেভাস্তোপোল বন্দরের একটা বিশেষ দিক হচ্ছে এই বন্দর শীতের সময় বরফ আচ্ছাদিত হয়না । ইউরোপের অন্য সব বন্দর যেখানে শীতের মধ্যে বরফে আচ্ছাদিত হয়ে যেখানে জাহাজ চলাচলই বন্ধ হয়ে পড়ে সেদিক দিয়ে সেভাস্তোপোল বন্দর সারা বছরই চালু থাকে । এই বন্দর ঘরেই রাশিয়ার ছিল শক্তিশালী নৌবহর গড়ে তোলার , কিন্তু এখানেও বাঁধ সাধলো ইউক্রেন । ক্রিমিয়ার মূল সমস্যা হচ্ছে এদের পান যোগ্য খাবার পানির বেশ অভাব । ক্রিমিয়ার পানির একটা বড় অংশ আসতো ইউক্রেন থেকে , কিন্তু রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল নেবার পরপরেই ইউক্রেন থেকে যেই উৎস দিয়ে খাবার পানি ক্রিমিয়ায় আসতো সেই উৎস ইউক্রেনিয়ান সরকার বাঁধ দিয়ে বন্ধ করে দেয় যা প্রেসিডেন্ট পুতিনের ইগোতে মারাত্মক আঘাত হানে । রাশিয়াকে ইউক্রেনের প্রতি চরমভাবে বীতশ্রদ্ধ করে তোলে , এবং এসব কারণই ধীরে ধীরে প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ইউক্রেন এ হামলার দিকে নিয়ে গেছে ।
মোটাদাগে এগুলোই ছিল রাশিয়া কতৃক ইউক্রেন আক্রমণের বড় কিছু কারণ , এছাড়াও আরো ছোট ছোট কিছু কারণ রয়েছে , সর্বোপরি বলা যায় যে রাশিয়া ইউক্রেন দুই দেশেরই কম বেশি দোষ আছে এবং দুই পক্ষের কোনো পক্ষই বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়নি । ইউক্রেন সবসময় রাশিয়াকে কিভাবে খেপিয়ে তোলা যায় স্বাধীনতার পর থেকে সেদিকেই মেতে ছিল । শেষমেশ পশ্চিমা উষ্কানিতেও ব্যাপক ভাবে তাল মিলিয়েছে । অন্যদিকে রাশিয়ার উচিত হয়নি এভাবে একটা সার্বভৌম দেশের উপর হামলা চালানো । কে কোন জোটে যাবে তা সার্বভৌম দেশ হিসেবে একমাত্র সেই দেশের বিষয় , এর কারণে কোনো দেশের সার্বভৌমত্বকে পায়ে পিষে আগ্রাসন চালানো মোটেই কাম্য না । পশ্চিমা দেশগলোর ক্রমাগতই প্রেসিডেন্ট পুতিনকে কষ্ট চোখে দেখা , তাকে অবজ্ঞা , ধীরে ধীরে পুতিনকে আগ্রাসী করে তুলেছে । সে এখন তার শক্তিমত্তার স্বীকৃতি চায় , রাষ্ট্রনেতাদের কাছ থেকে সমীহ কিংবা ক্ষমতাশালীর অভিধা পেতে চায় ।
প্রেসিডেন্ট পুতিনের ভাষায় সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গন মানব ইতিহাসে সবচাইতে বিপর্যয়কর ঘটনা , উনি প্রবলভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন এর পুনপ্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিশ্বাসি । এটাও সত্য যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির উপর চাপিয়ে দেয়া ভার্সাই চুক্তি যেমন জার্মানিকে আগ্রাসী করে তুলেছিল , ঠিক তেমনি মিনস্ক চুক্তি এবং ক্রমাগতই এই পশ্চিমা দেশগুলো কতৃক এই চুক্তির শর্ত ভঙ্গ রাশিয়াকে খেপিয়ে তুলতে তুলতে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসছে । এর প্রতিকার করা না গেলে তা সমগ্র মানবজাতির জন্য ভয়াবহ বিপদ নিয়ে আসবে ।
এর বাহিরেও কোনো স্পেসিফিক কারণ থাকলে ব্লগারদের কাছ থেকে তা জানতে চাচ্ছি ।
ছবিসূত্রঃ ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০২২ বিকাল ৪:২০