somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেওয়াল(কল্পবিজ্ঞানের গল্প)

১০ ই অক্টোবর, ২০১৯ রাত ১১:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




দেওয়াল

__________

সারা পৃথিবীর খবরের কাগজ, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, ইন্টারনেটে একটাই খবর তোলপাড় করছে, গত কয়েকমাস ধরে। না, যুদ্ধ না। রাজনীতি না, বিজ্ঞান না। এমন কী কোনও মানুষের খবরও না। নাম না জানা কিছু গাছের খবর।
একই সাথে দ্রুত বেড়ে উঠছে কয়েকটা নাম না জানা গাছ। পৃথিবীর কুড়ি ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে প্রথমে দেখা যায় সেই দ্রুত বেড়ে ওঠা গাছগুলো। যেন গ্লোবের ওপর আঁকা পৃথিবী দেখতে কেমন নিখুঁত জানে সেই গাছেরা। সেই মত উত্তর থেকে দক্ষিণে, দুই মেরুর কাছে যেখানে কোনও দেশে হয় তো প্রবল শীত, আবার নিরক্ষরেখার কাছে সেই একই দ্রাঘিমাংশে তখন চামড়া পোড়ানো গ্রীষ্ম, কোথাও বা মরুভূমি। আবহাওয়ার এই সব তফাৎকে গ্রাহ্য না করে ওই গাছেরা লোকচক্ষুর আড়ালে বেড়ে উঠেছে। ওই কুড়ি ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশ বরাবর। লোকচক্ষুর আড়ালেই বা বলছি কেন? আসলে পৃথিবীর মানুষেরা প্রথমে খেয়ালই করেনি। কিছুদিন পর যখন সভ্য মানুষের খেয়াল হল ততদিনে ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে। অবশ্য লাভ না ক্ষতি, তাই বা কে বলবে?
এই নতুন গাছের জঙ্গল বেড়ে উঠছে, এগোচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি। কেটে শেষ করা যাচ্ছেনা ওদের। আজ একশ’টা গাছ কাটলে আগামী কাল, একলক্ষ নতুন গাছসৈনিক এগিয়ে আসছে রাতের অন্ধকারে গুঁড়ি মেরে। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কেটে ফেলে, বুলডোজারে মাটি ওলটপালট করে , আগাছানাশক রাসায়নিক ছড়িয়েও ওদের সর্বনাশা অগ্রগতি রোধ করা যায়নি।
কিছু মানছেনা ওরা। রাস্তাঘাট, কল কারখানা, নালা নর্দমা,শপিংমল, এরোড্রাম, কিছুই না। পিচ, কংক্রিট, পলিথিন, এমনকি ধাতুর আস্তরণও। সমস্ত কিছু ভেদ করে গাছেরা নামিয়ে দিচ্ছে সর্বনাশা শেকড় আর ওপরে মেলে দিচ্ছে আকাশমুখী ঘন সবুজ পাতার চাঁদোয়া, যেন পৃথিবীর ওপর নেমে আসা সূর্যের সবটুকু আলো শুষে নিতে হবে আজই, এক্ষুনি! ঢেকে যাচ্ছে আক্রান্ত এলাকার গ্রাম গঞ্জ শহর।
কিন্তু একই সাথে এও ঘটনা যে, ওই গাছেরা ঘন জঙ্গল বানিয়েছে যেখানে যেখানে, বাতাসে অক্সিজেনের ঘনত্ব বেড়ে গেছে। সবাই জানে, বায়ুমন্ডলের অক্সিজেন বেশির ভাগটাই আসে বনাঞ্চল আর সমুদ্রের অণু- উদ্ভিদের কাছ থেকে। সারা বিশ্বে বনাঞ্চল যখন কমেই চলেছে, বিশেষ করে উষ্ণায়ন আর রাসায়নিক দূষণের জন্য সমুদ্রের অক্সিজেন ফ্যাক্টরিও কাজ কমাচ্ছে দ্রুত, তখন এই অক্সিজেন বাড়ার সুসংবাদ সারা পৃথিবীতে এক ঝলক স্বস্তির হাওয়া বওয়াবে, এতে আর সন্দেহ কি?
এই গাছেরা মাটিতে মিশে থাকা জঞ্জাল পলিথিন প্লাস্টিক এমনকি কংক্রিট সমস্ত কিছুকে বায়োডিগ্রেডেবল করে নতুন মাটি বানিয়ে নিচ্ছে কি যেন কি অজানা উপায়ে। এই সব নতুন গাছের ফল, কেউ কেউ সাহস করে খেয়ে দেখেছে। যারা খেয়েছে, বলছে দিব্যি খেতে! রাসায়নিক বিশ্লেষণ করেও ওসব গাছে, আর তাদের ফুলে ফলে প্রাণনাশক কিছু পাওয়া যায়নি।
আরও এক অসাধারণ তথ্য জানা গেছে ততদিনে। এদের এত দ্রুত বংশবিস্তারের একটা সম্ভাব্য কারণ, এরা নিজেরাই মাটিকে উর্বর করে নিতে জানে। এই নতুন গাছেদের শেকড় তো বটেই পাতাও নাইট্রোজেন ফিক্সেসনে অসম্ভব দক্ষ। এই নতুন অরণ্যের মাটি অন্য জায়গায় ছড়ালে খুব ভাল সারের কাজ পাওয়া গেছে, বিভিন্ন কৃষি গবেষণাগারে।
তবু, মানুষের কি হবে? মানে তাদের এই সভ্যতার কি হবে? ওই অতিরিক্ত অক্সিজেন কোন কাজে লাগবে? আজ যে যাত্রা শুরু করেছে এই নাম না জানা নতুন আগ্রাসী গাছেরা, সেটা কুড়ি ডিগ্রি অক্ষাংশ ছেড়ে ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে। এরপর ছড়াবে তিরিশ তারপর চল্লিশ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশে। তারও পরে সারা ভূগোলকের পূর্ব আর পশ্চিমদিকে। যেন এই গাছ সৈনিকেরা একধরণের যুদ্ধই ঘোষণা করেছে।
তখন? তখন কোথায় যাবে মানুষ আর তার এত সাধের সভ্যতা? এই ভেবে সারা পৃথিবীর ঘুম নেই। পৃথিবীর সমস্ত দেশের রাষ্ট্রনায়কেরা, বৈজ্ঞানিকদের নিয়ে আলোচনায় বসেছেন ... কিংকর্ত্তব্যবিমুঢ় ...

***
(১)

মিঠাইএর সাথে বুড়ো মানুষটার অদ্ভুত বন্ধুত্বটা হয়েছিল পার্কে বসে। পার্কের মাঠে অন্য বাচ্চারা সবাই খেলা করে। মিঠাইএর ওইসব দৌড়ঝাঁপ করা বারণ। ওর ছোটবেলায়, নাকি জন্মের সময় থেকেই হার্টে একটা ফুটো ছিল। একটু বড় হতে অল্প অল্প শ্বাসকষ্ট শুরু। ডাক্তারের কাছে যখন যাওয়া হল তখন বেশ দেরি হয়ে গেছে। অপারেশনের টাকা জোগাড় করতে আরও কিছু দেরি হল।
শহরের একমাত্র হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল, রাধাবিনোদ সিং স্মৃতি বিদ্যালয়ে ক্লাস এইটে পড়া মিঠাইকে একমাস মতন আগে হাসপাতাল থেকে ছেড়েছে। সেই অপারেশনের পর ডাক্তারেরা বলেছেন সব কিছু ঠিক হয়ে গেছে। সব আবার আগের মতন করা যাবে। স্কুল পড়াশুনো সব।
শুধু আপাতত বেশি শারীরিক পরিশ্রম করা যাবে না। মা তাই তাকে রোজ বিকেলে পার্কে নিয়ে আসেন, ইস্কুল থেকে ফেরার পর। বন্ধুরা খেলে, চিৎকার করে, ধুলো মাখে। মিঠাই বেঞ্চিতে চুপ করে বসে শুধু দেখে। চোখের সামনে হলুদ বিকেলটা ছায়া ছায়া হয়ে যায়। মা বলেন এই সময়টা হল গোধুলি। মিঠাই আর মা তখন বাড়িতে ফেরে। এ’বার পড়তে বসতে হবে।
পার্কে আরও অনেকে আসে। মা তাদের সাথে গল্প করে দু’এক পা হাঁটতে হাঁটতে। মিঠাই বেঞ্চিতে বসে থাকে। ডাক্তারের বারণ মেনে। মিঠাইর পাশে এসে বসে কেউ কেউ। তারা কৌতুহলি গলায় জিজ্ঞেস করে,
-এ কি খোকা, তুমি খেলছ না?
মিঠাই মুখ ফিরিয়ে নেয় অভিমানে। এই প্রশ্নটা শুনতে ভাল লাগে না। বার বার একই উত্তর দিতে দিতে সে ক্লান্ত!
সেদিনও সেইরকম। কেউ এসে পাশে বসছে। আবার একটু জিরিয়ে নিয়ে হাঁটতে চলে যাচ্ছে।
নতুন মানুষটি পাশে বসলেন। মৃদু গলায় কে যেন ডাকল,
-মিঠাই!
মিঠাই ঠিক বুঝতে পারলনা, ডাকটা কানে শুনল নাকি মাথার মধ্যে কেউ ডেকে উঠল। পাশে তাকাতেই দেখে, ভদ্রলোক যেন অনেকদিনের পরিচিত এ’রকম চোখে তার দিকে তাকিয়ে।
বললেন,
-আমার সাথে হাঁটবে নাকি এক পাক?
-মা বকবে। ডাক্তারবাবু জানতে পারলে রাগ করবে।
আঙ্গুল দিয়ে মাকে দেখিয়ে হতাশভাবে ঠোঁট ওলটাল মিঠাই।
মা একটু দূরে তখন রুবি কাকিমার সাথে পায়চারি করতে করতে গল্প করছেন।
ভদ্রলোক মা’র কাছে গিয়ে কি যেন বললেন। মিঠাই দেখতে পেল মা মাথা নাড়লেন। বারবার।
ভদ্রলোক ফিরে এসে আবার পাশে বসলেন।
-হল না হে, পারমিসন পাওয়া গেল না। ভারি কড়া মা’টি তোমার।
মিঠাই জানে, কড়া না আরও কিছু। আসলে মিঠাইকে খুব ভালবাসে মা। বাবাও। সব গয়নাগাটি বিক্রি করে, বাবার অফিস থেকে লোন নিয়ে, আরও কি কি ভাবে যেন টাকা জোগাড় করে, অপারেশন হয়েছে। তাই তো পাছে নতুন কিছু গন্ডগোল হয়ে যায় এই ভয়ে এত সাবধানতা।

-কাল কিন্তু আমরা দুজন গল্প করতে করতে অল্প একটু হাঁটব, কেমন?
উনি চলে গেলেন। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। মিঠাই আর মা এবার ঘরে ফিরবে।
-তুই ওই লোকটাকে আমার কাছে পাঠালি কেন, মিঠাই? তোর না খাটাখাটুনি দৌড়োদৌড়ি করা একদম বারণ!
-না মা আমি পাঠাই নি। উনি নিজেই গেলেন তোমার কাছে। আবার বলে গেলেন, কাল থেকে নাকি আমি হাঁটব পার্কে। সত্যি মা? তুমি তাই বললে ওনাকে?
-মোটেই না। দাঁড়া, আজ বাবা অফিস থেকে ফিরলে, তোর এই সব দুষ্টুমি সব বলছি!
বাবার আজ ফিরতে বেশ দেরি হল। গত দিন তিনেক আগে হাসপাতালে যাওয়া হয়েছিল চেকআপে। ডাক্তারবাবুরা দেখলেন সবাই মিলে। কতরকম পরীক্ষা হল। ইকোকার্ডিওগ্রাফি, ইসিজি, রক্ত। বাবা আজ তার রিপোর্ট আনতে হাসপাতালে গেছিলেন।
-জানো, আজ ডাক্তার বিদ্যার্থী আমাকে বেশ বকুনি দিলেন।
মাকে বলবার সময় বাবার মুখচোখ কিন্তু ঝলমল করছিল। মোটেই বকুনি খেলে যেমন হয় তেমন না।
মার চোখভরা জিজ্ঞাসা দেখে, বাবা আবারও বললেন,
-ইকো, ইসিজি সব পারফেক্টলি অলরাইট, বুঝলে তো। ও কে নাকি ওরকম একদম বসিয়ে রাখতে মোটেই বলা হয়নি। খালি খুব বেশি ছুটোছুটি করা বারণ ছিল।
-তার মানে, ও পার্কে গিয়ে একটু হাঁটবে বেড়াবে? ও মা তাহলে তো ভদ্রলোক ঠিকই বলে গেছেন আজ, নারে মিঠাই?
-ভদ্রলোক? তিনি আবার কে?
ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করলেন বাবা।

***
পরের দিন সেই বৃদ্ধ মানুষ পাশে বসে চুপিচুপি যখন জিজ্ঞেস করলেন,
-কি, আজ আমরা যাচ্ছিতো,একটু খানি হাঁটতে?
মা লজ্জায় প্রায় লাল হয়ে বললেন,
-আসলে আমাদেরই বোঝবার ভুল, জানেন। অল্পস্বল্প হাঁটতে নাকি ডাক্তাররাই বলেছিলেন। তা যাক না, আপনি যদি ওকে পার্কের চারপাশটায় নিয়ে একটু বেড়ান।
মিঠাই তো একপায়ে খাড়া।
-দাঁড়াও, আগে আলাপ পরিচয়টা সেরে নিই। আমি হলাম শ্রীযুক্ত মহাকাল বসু। নিবাস প্রাকটিক্যালি অনির্ধারিত। আসলে প্রচুর ঘোরাঘুরি করতে হয়, আমাকে।
- মেসোমশাই, মানে মাসীমা কি ...
মায়ের প্রশ্ন শেষ হবার আগেই আঁত্‌কে উঠলেন উনি।
-উঁ হু হু! আমাকে ওই মেসোমশাই বলে ডাকা চলবেনা না বাপু ! আমি সারাজীবন ব্যস্ততার মধ্যে কি বলে ওই মাসিটি সংগ্রহ করে উঠতে পারিনি। তুমি বরঞ্চ আমাকে মামাবাবু ডেকো মা। আর মিঠাই আমাকে বলবে মামাদাদু।
-খুব ঘোরাঘুরি করতে হয় আপনাকে, এই এত বয়সেও?
মায়ের প্রশ্নের জবাবে, মামাদাদু বললেন,
-কাজ না করলে কেউ খেতে দেয় রে মা? আর কাজটাও দারুণ গোলমেলে। যত রাজ্যের ভুলভাল কাজ করছে লোকজন নানান সময়। পরে যখন ধরা পড়ছে তখন হইহই করে ওপরওয়ালারা আমার মত কটা দুর্ভাগাকে পাঠাচ্ছে মেরামত করতে।
-এখানে আমাদের শহরেও কি তেমন কোনও কাজে এসেছেন?
-কাজেই তো। কত যে ভুল জড়িয়ে আছে সময়ের ভাঁজে! এই যেমন ভুল করে এই ছেলেটাকে তোমরা হাঁটাচ্ছিলে না, সেই ভুলটা ধরা পড়ল আরও দু’চারটে বড় ভুলের সাথে। সব কটা ভুল সারিয়ে, তবে যাবো।
কেমন যেন ধোঁয়াটে উত্তর দেন মামাদাদু। সব কথার মানে বোঝা যায় না।
মা ভাবলেন, একলা মানুষ। একা থাকতে থাকতে হয়তো সামান্য গোলমাল হয়ে গেছে মাথা। বয়স্ক মানুষদের ওরকম হয়।
মিঠাই ছটফট করছিল বেড়াতে যাবার জন্য। মামাদাদু ওর হাত ধরে পার্কের রাস্তার দিলে এগোলেন। কত গল্প বললেন, এক বিকেলেই। পার্কের গেটের পাশে চিনেবাদামওয়ালার কাছ থেকে বাদাম কেনা হল। অন্য পাশে গ্যাস বেলুন। সিলিন্ডারের সাথে চার পাঁচটা বেলুন বাঁধা। উল্টো দিকের চায়ের দোকানে, ভিড়। উনুন থেকে ধোঁয়া পাক দিয়ে উঠছে। পার্কের ভেতরে জায়গায় জায়গায় ঘাস উঠে গিয়ে ন্যাড়া মাটি বেরিয়ে পড়েছে। সেরকম একটা জায়গায় দুটো বাচ্চা মেয়ে দু’চাকার সাইকেল শেখার চেষ্টা করছে। ছোট সাইকেল। দুপাশে স্ট্যান্ড দেওয়া।
মায়ের মত বয়সের একজন মহিলা চেঁচাচ্ছেন
-ওরে, পড়ে যাবি রে!
মিঠাইয়ের খুব ইচ্ছে করছিল ও’দের মত সাইকেল চড়া শিখতে। কিন্তু না, এখনই অতটা চাওয়া ঠিক হবে না। মিঠাইর মনে হচ্ছিল, আজকের এই বিকেলটা যেন শেষ না হয়।
রাতে বাবা ফিরলে, তিনজন মিলে সারাদিনের গল্প করে ওরা। সংসারের গল্প। অফিসের গল্প। ইস্কুলের গল্প।
নতুন পাওয়া দাদুর কথাও উঠল।
তার মধ্যে সব শুনে বাবা মাকে বললেন,
-দেখো, সাবধান কিন্তু! কতরকম লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে। কার মনে কি আছে কে জানে। নজর রেখো!
-সেতো নজর রাখিই। তবে সেরকম কিছু মনে হলনা, জানো। মানুষটা সংসারে একা। ভালবাসা দেবার কেউ নেই বোধ হয়। খালি নামটাই কেমন যেন অদ্ভুত।
-হুঁ, নামটা আনকমন।
বাবার মন্তব্য।
মা শব্দ না করে হাসলেন,
-নাম শুধু না, ওনার কথাবার্তাও কেমন যেন অদ্ভুত। সব কথার থই পাওয়া যায়না সবসময়।

কিন্তু কয়েকদিন এ’রকম আলাপ আর মেলামেশা হবার পর বোঝা গেল, মানুষটা ভালো। ভারি ভালো। আর কত যে অদ্ভুত আর আশ্চর্য গল্প জানেন, তার শেষ নেই। এমন ভাবে বলেন যেন সব ওই অদ্ভুত ঘটনাগুলো ওনার চোখের সামনে ঘটেছে। বেশিরভাগটাই মিঠাইকে শোনান হাঁটতে হাঁটতে। মিঠাই আবার সেগুলো মাকে বলে বাড়ি ফিরে। কোনও কোনওদিন মাও একসাথে শোনেন। বাবা মিঠাই আর মা’র মুখে এত সব শুনে খুব আগ্রহ নিয়ে বললেন,
-একদিন ওনাকে তবে নেমন্তন্ন করো না, ছুটির দিন দেখে। এতো ভালোবাসেন যখন মিঠাইকে।
নিমন্ত্রণ করতে যা দেরি। মামাদাদু একপায়ে খাড়া।
মাকে বললেন,
-আরে, তোমার ওই ছেলেটার জন্যই তো আমার সব কাজ ফেলে এতদূরে আসা। তোমাদের বাড়ি যাব। কিন্তু তার আগে তোমরা একদিন আসবে আমার বাড়িতে। কবে যেন ছুটি তোমার কর্তাটির?

***

-বলতো মিঠাই, এইযে পার্কের মধ্যে হাঁটছি আমি আর তুই, এর মধ্যে সবচেয়ে জরুরি ব্যাপার কোনটা?
হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্নটা যেন দাদু ছুঁড়ে দিলেন বাতাসে। মিঠাই বুঝতে না পেরে, তাকালো ওঁর মুখের দিকে।
উনি আবার বললেন,
-সবচেয়ে জরুরি হল বুঝলি, আমরা দুজনেই বেঁচে আছি, এই ব্যাপারটা।
-বেঁচে তো আছিই। নইলে হাঁটব কি করে।
-কিন্তু বেঁচে কি থাকতাম, যদি বাতাসটা ঠিক এই রকমের না হত। সেটা ভেবেছিস কখনও? যদি চারপাশটা হত খুব গরম কি খুব ঠান্ডা আমরা বাঁচতাম?
-কেন? মরুভূমিতে আর গ্রীনল্যান্ডে মানুষ যেভাবে বাঁচে, সে ভাবে বাঁচতাম!
-গরম মানে যদি হয় পৃথিবীর যে কোনও জায়গার চাইতে গরম ধর ওই বুধ নইলে শুক্রগ্রহর মত, আর ঠান্ডা মানে যদি হয়, ইউরেনাস বা প্লুটো, তবে?
-তবে আবার কি? আমি আর তুমি বেঁচেও থাকতাম না, হাঁটতামও না। আমাদের ভূগোল স্যার, বলেছেন, জানো দাদু, আমরা বাঁচবও না। পরিবেশ নষ্ট হতে হতে, আমাদের পিঠ নাকি দেওয়ালে ঠেকে যাবে একদিন।
মামাদাদুর দু চোখ যেন ঝিলিক দেয়।
-ঠিক। কিন্তু এমনতো হতেই পারে, ওই দেওয়ালটাই বাঁচাবে। আমাদের বেঁচেও থাকতে হবে। হাঁটতেও হবে। সেই জন্য বাতাসটা ঠিক রাখতে হবে, টেম্পারেচারটা ঠিক রাখতে হবে। তাই না? জানিস মিঠাই, এই পৃথিবীর ছোট্ট জানালাটা দিয়েই শুধু প্রাণ দেখা যায়। আমি সমস্ত ঘুরে দেখেছি।
মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে মিঠাইএর।
-সব ঘুরে দেখেছ? ওই বুধ শুক্র ইউরেনাস নেপচুন প্লুটো সব? তুমি জানো মানুষ এখনও চাঁদেই পৌঁছেছে শুধু, তাও অনেক ঝামেলা করে?
গলায় মজা এনে জিজ্ঞেস করে মিঠাই
-দূর, সে তো তোদের এই সময়ে, যখন মানুষ রয়েছে। আমি তো নেই-মানুষের সময়ও ঘুরে এসেছি।
এই শুরু হল মামাদাদুর উল্টোপাল্টা কথা বলা, ভাবল মিঠাই। এই রকমের কথা মা বাবার সামনে বললে, তারা ভাববে না যে মামাদাদুটা আসলে পাগল? তবু এই অদ্ভুত কথাগুলো শুনতে বেশ লাগে। মিঠাই জানে কপাল ভাল থাকলে হয়তো এর পরপরই বেরিয়ে আসবে একটা আধটা দারুণ গল্প।
-কদ্দুর গেছিলে দাদু, ওই ইয়ে মানে নেই-মানুষের সময়ে?
-সে অনেক দূর রে বাপু। এক বিগ ব্যাং থেকে আরেক বিগ ব্যাং। কোত্থাও মানুষ নেই। মাঝের এই ক’বছর ছাড়া। মাঝে মধ্যেই ঘুর্ণিটান দিচ্ছে দু একটা অন্ধকার গর্ত। ইতিহাস বইয়ের অক্ষরগুলো গলে ঢুকে যাচ্ছে সে সব গর্তে। আর কি গরম আর ঠান্ডা সে সব সময়গুলো, মানুষ বাঁচবে কি করে সেখানে?
-বিগ ব্যাং কি দাদু?
-সে এক শুরুর সময়, যখন সৃষ্টি আদিতে ছিলেন ব্রহ্ম ... শেষে প্রলয় হবে ... তারপর আবার বিগ ব্যাং ... সময়গুলো পুরো গোল হয়ে ঘুরছে ...
মামাদাদুর আর এক বাতিক, এই যে কঠিন কথা বলে গুলিয়ে দেওয়া, মাঝে মাঝেই এই যে ‘জায়গাগুলো’ না বলে সময়গুলো বলা। কিন্তু গল্পটা সবে শুরু হতে যাচ্ছে। এ’সময় বাধা দেওয়াটা ঠিক হবেনা, মিঠাই ভাবল।
কিন্তু আজ বোধহয় গল্পের মুডে নেই দাদু।
আবার জিজ্ঞেস করলেন,
-তুই রোপ আ ডোপ কথাটা শুনেছিস কখনও?
-রোপ আ ডোপ? দাঁড়াও দাঁড়াও ... কোথায় যেন ... কিসে যেন ...
ইন্টারস্কুল কুইজ চ্যাম্পিয়ন মিঠাইএর মাথার মধ্যে টিকটিক করে প্রশ্নটা,
-মনে পড়েছে, মহম্মদ আলি মানে ক্যাসিয়াস ক্লে। বক্সিংএ ...
-ব্যাপারটা জানিস?
-না, সেটা ঠিক ...
- শোন তবে। ওই বক্সিংএরই একটা কায়দা এটা। মহম্মদ আলির আবিষ্কার। তোর ভূগোল স্যার বলেছেন না, ওই যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া, ওই দেওয়ালটাকে খুঁজে বার করে, ব্যবহার করার নিয়ম।
-বক্সিংএর মধ্যিখানে দেওয়াল?
মিঠাই অবাক। দাদু বোঝালেন,
-বাঃ, ওই যে চারপাশটা ঘেরা থাকে দড়ি দিয়ে বক্সিং রিংএ। ওটাতো রিংএর দেওয়াল মানে শেষ সীমা, না? তো এই রোপ-আ-ডোপএ বক্সার করে কি জানিস? হারতে হারতে পিছোতে পিছোতে, ওই দেওয়াল মানে দড়িটা যখন পিঠে ঠেকে যায়, সেখান থেকে ঝাঁকিয়ে শক্তি নিয়ে সামনের দিকে একশ’গুণ তেজে এগিয়ে যায়। জিতেও যায়। যে কোনও লড়াইতেই জানবি, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়াটা কোনও লজ্জার ব্যাপার না, বরং ওই দেওয়ালটা খুঁজে বার করাও একটা কাজ, ভারি শক্ত কাজ। যে দেওয়াল থেকে নতুন করে লড়াই শুরু করা যায়। পৃথিবীকে বাঁচানোর লড়াই যদি করতে চাস, ওই দেওয়ালটা খুঁজে বার করতেই হবে!

***
(২)
আজ নগার প্রমোশন হল। এতদিনে সে অ্যাসিস্টেন্ট তোলাবাজ হিসেবে কাজ করছিল। ঝাড়খন্ডে যেতে হয়েছিল, ওই তোলা পৌঁছে দেবার ব্যাপারেই। মাত্র গতকাল ফিরেছে। আজ থেকে তাকে ডেকে এই এলাকার পুরো দায়িত্ব দিয়েছে জিমি। জিমি মানে জীমুতবাহন চাকলাদার। সে সামনের ভোটে জিতে নতুন কাউন্সিলর হবে। তার দাদারা তাই তাকে এ’সব তোলাবাজি, পিস্তল ছুরি তলোয়ার হাতে নিয়ে প্রকাশ্যে দৌড়োদৌড়ি নিষেধ করেছে। এটা একটা বিরাট সিঁড়িভাঙ্গা অঙ্ক।
বড়দাদা আছে সবার ওপরে। জিমির পজিসন এখন একেবারে তলার দিকে তা’ না। সিঁড়ির দু’তিন ধাপ ওপরে উঠে এসেছে,অনেক লেগে থাকবার পর। থানার ওসি এখনও স্যার বলেনা বটে, তবে থানায় গেলে মেজবাবু চেয়ারটেয়ার এগিয়ে দেয়। জিমিরও বয়স হচ্ছে। সে বোঝে তাকে এবার ক্রমশ পাল্টে যেতে হবে, ওই কি বলে যেন, নব ভাবমূর্তিতে।
তাই আজ নগার নতুন পোস্টে অভিষেক হল। কাঁপা কাঁপা হাতে জিমির হাত থেকে পিস্তলটা নিল নগা।
জিমি ওর হাত কাঁপছে দেখে ধমকে উঠল
-হাত স্টেডি কর। এত কাঁপলে কেউ তোকে মানবে?
কান এঁটো করে হাসল নগা। নিজেকে প্রবোধ দিলও বলা যায়।
-ও কিছু না। সেই ছোটবেলায় আমার টাইফয়েড হয়েছিল কি না! তাই হাত কাঁপে। ঠিক সময়ে এই নার্ভ পুরো ইস্পাতের মত শক্ত হয়ে যায়। দেখে নিয়ো জিমিদা’।
মুখে যাই বলুক, নগা জানে ও একটু ঘাবড়ানো টাইপের রোগে ভোগে। তোলাবাজির আগে বাড়িতে ফাটা আয়নায় কতবার রিহার্সেল দেয়, কিন্তু ঠিক সময়ে ডায়ালগ ভুলে যায়।
জিমি ও’কে প্রথম পাঠ দিল।
-শোন, তুই একটা কাজ করবি আজ থেকে। হাত স্টেডি হতেই হবে। যাকে তাকে যখন তখন চমকাবি। দরকারে, অদরকারেও। তবে না কনফিডেন্স বাড়বে!
বাধ্য ছাত্রের মত মাথা নাড়ে নন্দলাল গায়েন ওরফে নগা।
-কিন্তু জিমিদা’, এখন এ’সব চমকাচমকি করলে, পরে যখন তোমার মত অনেক বড় হব, তখন লোকে মানবে?
-আরে পাঁঠা, লোকজন মানে জনগণ তো? জানবি এই পাব্লিক খুব জাগ্রত ভোলানাথ। সব ভুলে যায়। আমি যে কত কত বডি ফেলেছি হরিসভার খালে মনে রেখেছে কেউ? আমার মত বড় হ’ ...
আশীর্বাদের ভঙ্গীতে হাত বাড়ায় জীমুতবাহন, জনগনের আশাআকাঙ্খার মূর্ত্ত প্রতীক।
উপদেশমাফিক নগা আজ স্টেডি হবার থুড়ি মানুষজনকে চমকানোর সাধনায় মেতেছে। কাউকে সঙ্গে নেয় নি। নিজের কাজ নিজে করতে হবে। কবে, সেই ছেলেবেলায় নগা পড়েছিল, চালাকির দ্বারা মহৎ কার্য সাধিত হয় না। পাড়ার মোড়ে পা দুটো ক্রস করে ল্যাম্পপোস্টের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চঞ্চল চোখে টার্গেট খুঁজতে লাগল নগা।
প্রথম শিকার বিষ্ণু সামন্ত। ব্যাটা বাস্তুঘুঘু কিপটের জাসু। একমাত্র ছেলে বাইরে থাকে। আমেরিকা না সৌদি আরব কোথায় যেন। মোড়ের মাথায় পাঁচ কাঠা জমিতে বাড়ি। বুড়োবুড়ির আস্ত একখানা বাড়ি কি দরকার, কে জানে রে বাবা। ভেঙ্গে ফেললে দিব্যি প্রমোটিং করা যায়। জিমিদা’ চেষ্টাও করেছিল। ওটাকেই প্রথম চমকানো যাক। জিমিদা’র অসমাপ্ত কাজগুলো সব কটা করতে হবে তাকেই। স্টেডিও হতে হবে।
বাজার থেকে ফিরছেন বিষ্ণুবাবু। খুব কায়দা করে নগা একটা সিগারেট ধরাল । ল্যাম্পপোস্টে হেলান দেওয়া শরীরটা। চেঁচিয়ে ডাকল,
-এ্যাই যে বিষ্ণুকাকা ! বাড়িটা ছাড়ছো কবে? নাকি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করতে হবে?
বেচারা বিষ্ণুবাবু সত্যিই বেশ কৃপণ। কানে শুনতে পাননা বলে ছেলে হিয়ারিং এইড দিয়ে গেছে। সেটা বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছেন বলে ব্যাটারি বাঁচাবার জন্য অফ করে রেখেছেন।
ডাক শুনতে পেলেন না।
অবধারিত ভাবে নগার প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে গেল। মাথা ঝনঝন করে উঠল, যেমনটি হওয়া উচিত। আড়মোড়া ভেঙ্গে এগিয়ে এসে, বাঁহাত দিয়ে বিষ্ণুবাবুর শার্টের কলার ধরে ঝাঁকুনি দিল নগা,
-কি রে ব্যাটা শকুনি, কানে শুনেও সাড়া দিলি না ? দেব একটা হুড়ো?
হাতের থেকে বাজারের ব্যাগটা পড়ে গেল। কতকগুলো আলু ছিটকে পড়ল এদিক ওদিকে।
ডানহাতে বুড়োর থুতনি নেড়ে একটা লাথি কসাবে কসাবে ভাবছে, এমন সময় দোতলার ব্যালকনিতে কার যেন ছায়া দেখতে পেল নগা। বুড়োর বৌ সুখলতা। খান্ডারনি মহিলা। পাড়ার পুরোনো বাসিন্দা। ছোটবেলায় ঘুড়ি ধরতে এ'দের ছাদে উঠে পাইপ বেয়ে উঠে এই মহিলার হাতে চ্যালাকাঠের বাড়ি খেয়েছিল, মনে পড়ে গেল। সাথে সাথে ঘাম বের হয়ে হাত কাঁপতে লাগল। নার্ভাস নগা মানে মানে কেটে পড়ল।
দিনের প্রথম অ্যাটেম্পটটাই ফেল।
অবাক বিষ্ণু সামন্ত নীচু হয়ে বাইশ টাকা কিলোর দামি আলু কুড়োতে কুড়োতে ভাবলেন, ফেলারাম গায়েনের অকালকুষ্মান্ড ছেলেটার হল কি? পাগলা কুকুরটুকুর কামড়াল না তো?

***
(৩)
কুনাল, অলকা আর ওদের একমাত্র ছেলে মিঠাই আজ বেড়াতে গেছে, মিঠাইএর মামাদাদুর বাসায়। শহরের একটেরে একটু ফাঁকায় একতলা একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকেন ভদ্রলোক। ওরা বারবার বলা সত্ত্বেও উনি জেদ ধরলেন, ওঁর বাসায় আগে আসতে হবে তবে উনি ফিরতি নেমন্তন্ন নেবেন। বাড়িতে রান্নাবান্না করার বালাই নেই। বাইরে থেকে খাবারদাবার এনেছেন মহাকাল বসু।
ভালো, মানে বেশ ভালো ব্যবস্থাই করেছেন, মোটামুটি নামী হোটেল থেকে। কুনাল আপত্তি করতে উনি আবার সেই ধোঁয়াটে উত্তর দিয়েছেন,
-বাঃ, যার জন্য আমার এত কষ্ট করে এত দূর আসা, সেই মিঠাইদাদুকে ভালো করে খাওয়াব না ?
দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ হবার পর,বাবা আর মা’কে মামাদাদু বললেন,
-এবার তোমরা তবে বিশ্রাম নাও একটু। আমি আর মিঠাই আমার ছাদের বাগান ঘুরে আসি । ছাদে উঠে মিঠাই দেখল, রাশি রাশি টবে অনেক কি সব গাছ।
-কি গাছ এগুলো দাদু, ফুলের?
-ফুলের গাছ আছে, ফলেরও আছে। কিন্তু এখনও এই পৃথিবীর জন্য তৈরি হয়নি ঠিকমত। ঠিকঠাক কাজে লাগানো মুশকিল। এগুলো দিয়ে দেওয়াল তৈরি করতে হবে একটা। সেদিন তোকে যে দেওয়ালটার কথা বলছিলাম। আপাতত এগুলিকে ফিরিয়ে দিয়ে আসব যেখান থেকে এনেছি সেখানে। আরও কিছু পরে দেখি ঘষে মেজে গাছগুলোকে তৈরি করে দিতে পারে নাকি ওরা।
-ওরা মানে কারা দাদু?
-কারা আবার, মালীরা, যারা অনেক কাল পরের এক বাগানে বসে গাছগুলোকে বানাচ্ছে।

আবার সেই গোলমেলে ভাষা। মিঠাই বুঝে গেছে দাদুকে টেন্স মেনে বাংলা ভাষা বলানো তার সাধ্য নয়। গাছই বা বানায় কি করে কে জানে।
দাদু ফেরত দিয়ে আসবেন বললেন। মিঠাই হুমড়ি খেয়ে গাছগুলো দেখতে দেখতে ভাবল, বেশ ভালো তো! আমিও ছাদে এই রকম একটা বাগান করব।
দাদু যেন ওর মনের কথা বুঝতে পেরে বললেন,
-তুই বড় হতে হতে আমার এই দেওয়ালবাগানটাও তৈরি হয়ে অনেক বড় হয়ে যাবে। তখন তুইই এটার দেখাশুনো করবি। করবি তো মিঠাই! ভালো কথা, বলতেই ভুলে গেছি, সারাদিনে। আমি কিন্তু চলে যাব শিগগিরই। ডাক এসেছে। হাতের কাজটাও এগিয়ে এসেছে।
দাদু চলে যাবার কথা বলছেন শুনে মিঠাইএর তখন মন খারাপ, মন ভারি খারাপ!
-চলে যাবে? সত্যি চলে যাবে তুমি?
-চলে যাব মানে কি একেবারে চলে যাব নাকি? আবার আসব, বার বার আসব, দেখিস।
সান্ত্বনা দিলেন দাদু।
মিঠাই দুচোখ ভরা জল পেরিয়ে আবছা হওয়া দাদুর দিকে তাকিয়ে রইল।

***

বিকেলে দাদুর ওখান থেকে ফেরার সময়, কুনাল কলকাতা গেল অফিসের কি একটা ফাংশনএ, মহাজাতি সদনে। বাড়ি ফেরবার পথে, দাদু সাথে এলেন কিছুটা পথ এগিয়ে দিতে।
একটু বাদেই বিপত্তি। পার্কের কাছাকাছি এসেছেন সবাই এমন সময় রাস্তা আটকে দাঁড়াল, নগা। তার এই চমকানো প্র্যাকটিসে সে আর ছোটবেলার চেনা কারুর সামনে যাবেনা ঠিক করেছে।
এই মুখগুলো শহরে নতুন। মেয়েছেলেটা আর ওর বরটা ভাড়া এসেছে কয়েকবছর মোটে, একটাই ছেলে। আর সঙ্গের এই বুড়োটা তো উটকো। কোত্থেকে এলো কে জানে। সহজ টার্গেট। চুটিয়ে চমকানো যাক এদের।
একমুখ সিগারেটের ধোঁয়া মিঠাইএর মুখের ওপর ছেড়ে খুব কৃতিত্বের হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল রাস্তা জুড়ে।
- ওর হার্টের অসুখ! ওর মুখের কাছে পাগলের মত সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছেন কেন?
আচমকা আক্রমনের মুখে হিসহিস করে উঠল অলকা।
এই সুযোগটুকুই যেন খুঁজছিল নগা। নগা জানে মেয়েদের বিরক্ত করা, মানে ইভ টিজিংএর বাজার এখন বেশ চড়া।
সাথে সাথে অলকার আঁচল চেপে ধরে বলে উঠল,
-আর, আমার যে হার্টের অসুখ তোমাকে দেখে দেখে সারতে চাইছে না, সেটার কি হবে মাইরি!
মিঠাই ছোট হলেও বুঝল লোকটা মা’র সাথে অসভ্যতা করছে। দাদুর পেছন থেকে সে ছিটকে ঝাঁপিয়ে যেতে চাইল নগার দিকে। দাদু ওকে হাত ধরে টেনে সরিয়ে নিলেন। দাদুর চোখ নগার চোখের ওপর। নগাকে জিজ্ঞেস করলেন,
- মুখটা চেনা চেনা লাগছে! তোমার সাথে পরশুদিন দেখা হল না?
হ্যা হ্যা করে হাসল নগা
-খিল্লি করছিস ব্যাটা বুড়ো। গত পরশুতো আমি ছিলাম ঝাড়খন্ডে। গুল মারার যায়গা পাসনি, না?
-আমি গত পরশুর কথা বলিনি তোমায়। আগামী পরশুর কথা বলেছি।
-ওই সব উলটোপালটা কথা বলে মালটাকে নিয়ে সটকাবি সেটা হচ্ছেনা চাঁদু
মিঠাইয়ের মার দিকে তাকিয়ে অশ্লীল চোখের চাউনি দিয়ে বলল নগা।
দাদু অল্প হেসে বললেন,
-ঠিকই ধরেছ হে। সটকাব এখন ঠিকই, তবে সেটা তোমাকে নিয়ে।
দাদু নগার হাতটা ধরতেই ওর আঙ্গুলগুলো কেমন যেন আলগা হয়ে গেল মায়ের আঁচল থেকে।
দাদু মাকে বললেন,
-তোমরা সাবধানে এটুকু রাস্তা চলে যাও মা। আমি এটাকে একটু দূরে ছেড়ে দিয়ে আসি।
নগার কব্জিটা দাদুর মুঠোয়। বিনা বাক্যব্যয়ে দাদুর সাথে চলে গেল নগা। ওর মুখটা ব্যথায় একটু নীলচে দেখাচ্ছিল কি?

***
(৪)
ভোর হতে না হতেই পিলু এসে নগার বাড়িতে হানা দিল,
-নগা, তোকে জিমিদা এক্ষুনি ডাকছে। শিগগিরি চল।
দাঁত না মেজে, মুখটা অব্দি না ধুয়ে নগা দৌড়োলো
-বল জিমিদা, ডাকলে কেন?
-আয় আয়

নগাকে ভেতরের ঘরে নিয়ে গেল জিমি। সেখানে আগে থেকেই হারু, পিলু আর একটা দাড়িওয়ালা লোক বসে। নগা হালকা করে চেনে দাড়িওয়ালাকে। ও হল শম্ভু। ও নাকি জিমির কিডন্যাপিং সেলের মাথা।
জিমি বলল,
-শোন সবাই, নওলকিশোর আগরওয়ালাকে চিনিস তো? ওর ছেলে অনুজ, রাধাবিনোদে পড়ে ক্লাস ফাইভে। ওটাকে হাপিস করার বরাত পেয়েছি। ওই ঝাড়খন্ড থেকেই। লাখ লাখ টাকার কেস। কাল শনিবারই কাজ সারতে হবে। এই শম্ভু চেনে ওই বাচ্চাটাকে। ওদের বাড়িতে ড্রাইভার হয়ে ঢুকেছিল ছ’মাস আগে। ইস্কুল শুরুর আগে বাচ্চারা আসবে যখন, পেটো টপকে দিবি। স্কুল গেটের মুখে। হৈ হৈ হবে খুব। তোরা গণ্ডগোলের মধ্যে তখন বাচ্চাটাকে বগলদাবা করে, মারুতি ভ্যানে তুলে কেটে পড়বি, সোজা উত্তর মুখে এন এইচ থার্টি ফোর ধরে জাগুলির দিকে। পরে কি করতে হবে, কোন রাস্তায় যেতে হবে, কোথায় রাখতে হবে, সে আমি বলে দেব’খন।
শম্ভু পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে সামনের টেবিলের ওপর বিছোলো। ওই রাধাবিনোদ স্কুলের আর চারপাশের একটা ম্যাপ। দীর্ঘদিন এ’সব কাজ করতে করতে শম্ভু এখন খুব মেথডিক্যাল। সব অপারেশন গুছিয়ে করে।
পুরো তির চিহ্ণ এঁকে, সময় উল্লেখ করে প্ল্যান ছকা। মায় কে কোথায় কখন দাঁড়াবে, সেটা অবধি লেখা। নগা একটু পেছনে ছিল। ডিঙ্গি মেরে ম্যাপটা একচোখ দেখল।
শম্ভু ততক্ষণে ম্যাপের ওপর আঙ্গুল রেখে প্ল্যান বোঝাতে শুরু করেছে।
- ইস্কুলগেটের উল্টো দিকে খেলার মাঠে, এই যে এখানে জিমিদা’র ইলেকশন মিটিং হবে বিকেলবেলা। সকাল সাড়ে ন’টার থেকে সেখানে মাইক্রোফোন টেস্টিং শুরু হবে। আগরওয়ালার গাড়িটা ছেলেকে নিয়ে ঢুকবে পৌনে দশটা থেকে দশটার মধ্যে। সেই সময়টায় মাইকের ভলিউম বাড়িয়ে প্রবল আওয়াজ করে হ্যালো হ্যালো শুরু করা হবে। ছেলেটা বাঁদিকের দরজা খুলে নামবে। রোজই তাই নামে। তক্ষুনি পেটো টপকাবি পিলু আর হারু। স্প্লিন্টার ছাড়া, ধোঁয়াপেটো। মাইকের আওয়াজে পেটোর আওয়াজ ঢেকে যাবে। স্কুলের কতকগুলো বাচ্চা আর তাদের বাপ মা ছাড়া স্কুলের গেটে সেসময় আর কেউ থাকেনা।
-মেশিন কিন্তু মোটে দুটো থাকবে। নগা আর শম্ভুর কাছে।
বলল জিমি।
শম্ভু ঘাড় নেড়ে সায় দিল,
-মেশিন থাকবে বটে, দরকার লাগবে না। ধোঁয়ার মধ্যে নগা ছেলেটাকে টেনে নিয়ে গাড়িতে তুলবে। ধৈর্যপ্রসাদ স্টার্ট দিয়ে বসে থাকবে নম্বর বদলান মারুতি এইট সিটারে। অন্যরাও তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে উঠে পড়বি, সবাই। তারপর জিমিদা’র খেলা।

-সিম পালটানো মোবাইলে বলে দেব সব, পর পর কি করতে হবে। নো প্রবলেম!
আত্মপ্রসাদের হাসি হাসল জীমুতবাহন।
-হেডুটা কিন্তু স্কুলে তাড়াতাড়ি আসে জিমিদা, গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। সেটা খেয়াল আছে তো ?
মনে করিয়ে দিল নগা। কবছর আগেও হেডস্যারের কাছে গোবেড়েন খাবার কথা মনে আছে তার।
-আরে এলেও তোকে চিনবে নাকি? একটা আধবুড়ো হেডমাস্টারের ভয়ে কিডন্যাপ হবেনা? বলিস কিরে পাগলা! সবার মুখে কালো রুমাল বাঁধা থাকবে তোদের, ভুলে গেলি? যা, যা, আজকের দিনটা সব গুছিয়েগাছিয়ে নে। কাল সকালে পিলুর বাড়িতে জমা হবি, সাড়ে ছ’টার মধ্যে। মনে থাকে যেন!
সবাই চলে যেতে, জীমুতবাহন আগামীকালের বক্তৃতাটার খসড়া করতে বসল।
খুব আবেগ মিশিয়ে কাঁপাকাঁপা গলায় বলতে হবে
-আজ যে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেল সকালে ইস্কুলের সামনে থেকে ছাত্র অপহরণ, চিন্তার অতীত। এই কিডন্যাপিং, প্রমোটারি, আর তোলাবাজির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হলে, আমাকে ভোট দিন, কাউন্সিলার করুন। আপনাদের সেবক জীমুতবাহনকে কাজ করার সুযোগ দিন।

***

(৫)

শনিবার, সকাল ন’টা আটচল্লিশে, আগরওয়ালাদের নীল স্যান্ট্রো এসে লাগল স্কুল গেটে। এই স্কুলে আর কোনও ছেলেই গাড়ি করে আসে না। নওলকিশোর ঠিক করেছে ছেলেকে সামনের বছরই কলকাতায় বাড়িতে রেখে, বড় কনভেন্ট স্কুলে ভর্তি করা হবে। অনেক হল, মফস্‌সলের স্কুলে আর না।

হিসেব মিলিয়ে বাঁদিকের গেট খুলে নামল মোটাসোটা অনুজ। বাড়ির থেকে একজন, কাজের মেয়ে বোধহয়, বাচ্চাটাকে নিয়ে এসেছে। সেও নামল। দুজনে এ’বার এগিয়ে যাবে রাস্তা পেরিয়ে স্কুলগেটের দিকে। শম্ভু এগিয়ে এসে মহিলার পায়ের সামনে নিজের পা এগিয়ে দিল। সহজ কায়দা। হুমড়ি খেয়ে সামনে পড়তে পড়তে অনুজের হাত ছেড়ে দিয়ে, কালো মুখোস পরা লোকগুলোকে দেখে,
-আই বাপ রে ...বলে আর্তনাদ করে উঠল মেয়েটা।
পিলু আর হারু দুটো ধোঁয়াবোমা ছুঁড়ল মাটিতে। চারিদিক ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় অন্ধকার। নগা অনুজের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল স্টার্ট দেওয়া মারুতির দিকে। গাড়ির গেট খুলে রেডি হয়ে রয়েছে মলয়। বাচ্চাটা পৌঁছোলেই ওকে তুলে পুরে দেবে গাড়িতে।
কিন্তু আর একটা হিসেবের বাইরের ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। অলকা আর মিঠাইও রিক্সা থেকে নামল স্কুলের সামনে এক্ষুনি। অনুজের হাত ধরে টানতে থাকা নগার মুখে কালো মুখোশ থাকা সত্ত্বেও ওকে চোখ দেখে, নাকি কি করে কে জানে যেন চিনে ফেলল মিঠাই।
চিনতে পেরেই হিতাহিত জ্ঞান শূণ্য হয়ে মিঠাই মা’র হাত ছাড়িয়ে নগার দিকে দৌড়োল । নগার কোমর পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করতে লাগল পরিত্রাহি। প্ল্যানের বাইরে এই ব্যাপারটা ঘটতেই প্রবল ঘাবড়ে গেল ছিনতাই টিমের দু’জন পিস্তলধারী লিডারের একজন, মানে স্বয়ং নগা। প্রথমে শরীর দুলিয়ে আর অন্ধের মত উল্টোদিকে পা চালিয়ে, ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল। হাতে সময় মোট তিরিশ সেকেন্ড সময়। বাঁহাতে আগরওয়ালার বাচ্চাটা। ডানহাত প্যান্টে গুঁজে রাখা পিস্তলটা বার করল।
জিমি যে বারবার বলেছিল মেশিন ব্যবহার না করতে বিলকুল ভুলে গেল নার্ভাস নগা। ঝটকা দিয়ে পেছন ফিরল। কে ধরেছে তাকিয়েও দেখল না। সটান বুকে লাগিয়ে পিস্তলের ট্রিগার টেনে দিল। ঝলকে ঝলকে রক্ত বেরিয়ে এল মিঠাইএর ইউনিফর্ম ভিজিয়ে। অলকা ওকে বাঁচাবার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল। ছেলেকে রক্তে ভেজা দেখে অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়ল রাস্তায়।
কিছুদূরে দাঁড়িয়ে পুরো দৃশ্যটা দেখলেন মামাদাদু। সামান্য হেসে মাথা নাড়লেন। এগিয়ে এসে অলকাকে হাত ধরে তুললেন। বললেন,
-ওঠো মা, খুব প্রয়োজন না হলে ইতিহাস বদলানোর ঝুঁকি নেওয়া বারণ। এবার আমাকে সেই ঝুঁকির কাজটাই করতে হবে, যে জন্য আসা।



(৬)
শনিবার আবার একবার ঘড়িতে ন’টা আটচল্লিশ বাজল। এ’বার কিছুক্ষণ আগে মহাকাল বসু এসে স্কুল গেটে হেডমাস্টারমশাইএর সাথে আলাপ জমিয়েছেন। স্যারকে বলছেন তাঁর নাতিটি নাকি খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য জন্মেছে। একে ঠিকঠাক বড় করতে হবে তাই।
তিনি নিজে অবশ্য ততদিন থাকতে পারবেন না। আর কিছুক্ষণ বাদে কি একটা অতি দরকারি কাজ সেরে তিনি আজই চলে যাবেন নিজের জায়গায়। স্যার এরকম বহু বাতিকগ্রস্ত গার্জিয়ানের কথা শোনেন রোজ। আজও শুনছেন। আর ভুরু কুঁচকে ভাবছেন, কিছু দূরে দাঁড়ানো কালো মারুতিটা ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? আবার কোন ছাত্র গাড়িতে চেপে স্কুলে আসা শুরু করল! মারুতিটা স্টার্টই বা বন্ধ করেনি কেন?
আগরওয়ালাদের গাড়িটা এসে দাঁড়াল। গেট খোলার আগে পজিশন নিল, নগার টিম। মহাকাল রাস্তা পেরিয়ে এলেন তাড়াতাড়ি। ওনার ঠেলা লেগে শম্ভু সামান্য বাঁদিকে সরে গেল। গাড়ির থেকে নামা মহিলার দিকে পাটা ঠিক মত বাড়াতেই পারলনা। নগাও কাছে এসে পড়েছে। মহাকাল কি কায়দায় যেন মুখে কালো কাপড় ঢাকা শম্ভু আর নগা দু’জনের কনুইএর ওপরে চেপে ধরলেন দুহাতের শক্ত আঙ্গুলে। ভিড় ঠেলে হতভম্ব লোকদুটোকে টেনে নিয়ে চললেন। কোথায় কে জানে। এক মুহূর্ত শুধু দাঁড়ালেন, অলকা আর মিঠাইএর সামনে। মিঠাইকে বললেন,
-চলি গো দাদু। যে কাজের জন্য এ’বার আমার আসা শেষ হল এতদিনে ...
বাকি দু’টো কালো মুখোশ পড়া লোক দৌড়ে মারুতিটায় বসতেই গাড়িটা তিরবেগে উধাও হয়ে গেল।
হেডস্যার একটু দূর থেকে দেখে পুরো ঘটনাটার কোনও ব্যাখ্যাই পেলেন না।

বিকেল বেলা জীমুতবাহন মিটিংএ খুব চেঁচাল,
-এই যে দু দু’টো তরুণ সমাজসেবীকে তুলে নিয়ে লোপাট করে দিল একটা দুষ্কৃতকারী, এর একটা বিহিত করতেই হবে। এই নির্বিচার কিডন্যাপিংএর বিরুদ্ধে ...
সবাই জিমিকে ভয় পায় বলে জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেল, সমাজসেবীদের মুখে মুখোস আঁটা ছিল কেন আর কোন সমাজসেবা করতে গেছিল স্কুলের গেটে!

***
(৭)


রাষ্ট্রনায়ক আর বৈজ্ঞানিকদের সভায় কিছুতেই একমত হওয়া গেল না । রাষ্ট্রপ্রধান আর সেনাপতিরা বেশিরভাগই শেষতম চরম ব্যবস্থা নেবার পক্ষপাতী। সেই ব্যবস্থা হচ্ছে পারমানবিক অস্ত্র দিয়ে নির্মূল করে দেওয়া হোক এই নতুন আগ্রাসী সভ্যতা-বিধ্বংসী ভূতুড়ে জঙ্গল।
আরও একদল রয়েছে, তারা সংখ্যালঘু।
তারা বলছে ,
পৃথিবী যখন নিজেই অরণ্যায়নের উপায় খুঁজে বার করেছে, নিজেই পরিবেশকে পরিশ্রুত করে নিচ্ছে অজানা গাছেদের দিয়ে, মানুষ বরং তথাকথিত সুসভ্য নগরজীবনের বদলে সেই অরণ্যজীবনকে মেনে নিক আংশিকভাবে। এতে লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই।
একটা ছোট কমিটি তৈরি করা হয়েছে, সিদ্ধান্ত নেবার জন্য। তার প্রধান হচ্ছেন বিখ্যাত পরিবেশবিদ বৈজ্ঞানিক প্রফেসর মিত্রসেন সান্যাল। সত্তরের ওপর বয়স তাঁর। এক দিনে সিদ্ধান্ত হবে না। কমিটি মোটামুটি দায়িত্ব দিয়েছে এই প্রফেসরকেই।
রাশি রাশি ছোট টবে নতুন অজানা গাছের চারা জোগাড় করে, পাঠানো হয়েছে কমিটির কাছে। প্রফেসর সান্যাল গাছগুলোকে খুঁটিয়ে দেখছেন। আর কেউ না চিনলেও, তিনি ওদের চিনতে পেরেছেন।
এদের প্রত্যেকটাকে তিনি দেখেছেন তাঁর ছোটবেলায়। মামাদাদুর ছাদের বাগানে। সেই দেওয়াল তৈরি করার গাছ। তিনি বুঝতে পেরেছেন, এদেরই দাদু ভবিষ্যতকালে ফেরৎ পাঠিয়েছিলেন আরও শক্তপোক্ত করে দেবার জন্য। নিশ্চয়ই এদের জিন হাজার হাজার বছরের প্রাকৃতিক আর কৃত্রিম বিবর্তনের রাস্তা পেরিয়ে এখন পৃথিবীর প্রকৃতিকে রক্ষা করার মত যথেষ্ট তেজী। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, সভ্যতার।

এতদিনে মানুষ লড়াইএর আসরে সঠিক দেওয়াল খুঁজে পেল! এই গাছের দেওয়াল থেকে শক্তি নিয়ে লড়াই করেই মানুষ আর পৃথিবী বেঁচে যাবে।


সে’দিনের মিঠাই মানে আজকের এই মিত্রসেন জানেন ওই নতুন জঙ্গলের ভেতরে গিয়ে দাদু বলে ডাক দিলে সময় পেরিয়ে ভ্রমণশীল সেই মানুষটাকেও খুঁজে পাওয়া যাবে হয়তো। হয়তো নয়, নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে!
নইলে এই গাছগুলো পৃথিবীতে নিয়ে এল কে?
প্রফেসর সান্যাল কমিটির অন্য সদস্যদের কাছে খবর পাঠালেন।
সিদ্ধান্ত খুঁজে পাওয়া গেছে!






সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০১৯ রাত ১১:০১
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×