কোনো কোনো আঘাত আমাদের শক্ত করে তোলে, আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস জোগায়। কিছু কিছু আঘাত আমাদের সামনের দিকে নতুন করে চলার আশা জোগায়। কিন্তু এমন কিছু কিছু আঘাত আছে যা আমাদের শক্ত নয় বরং একদম বিধ্বস্ত করে দেয়। আর সেটা এমন কি আত্মহত্যা পর্যন্ত গড়ায়। কারোর কারোর এমন অবস্থায় দাঁড়ায় যে মৃত্যু ছাড়া সে অন্য কিছুতে শান্তির কথা চিন্তাই করে না। আর সেই অবস্থা হলো বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন।
কিছুদিন আগে এক ব্লগে ডিপ্রেসড এক কিশোরের বক্তৃতা শুনেছিলাম- যেখানে সে বলেছিলো, “ডিপ্রেশন এমন এক রুমমেট, যাকে আপনি লাথি দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিতে পারবেন না আবার সাথে নিয়েও থাকতে পারবেন না”।
ডিপ্রেশন আসলে অদ্ভুত একধরণের ইমোশনাল ইলনেস এবং এ রোগে ব্যক্তির মন-মেজাজ বা মুড দিন দিন অবনতি ঘটে দারুণভাবে। ডিপ্রেশন হলো মানসিক রোগের মধ্যে সর্বাধিক কমন ও মহামারি রোগ। এটি এমন এক রোগ যার সাথে জড়িয়ে থাকতে পারে অতিরিক্ত উদ্বিগ্নতা এবং বাধ্যতাধর্মী গোলযোগ। তবে উদ্বিগ্নতা এবং বাধ্যতাধর্মী গোলযোগ আলাদাভাবেও রোগের মাধ্যমে প্রকাশ পেতে পারে। যারা উদ্বিগ্নতায় সচরাচরভাবে ভুগতে থাকে তাদের মাঝেও ডিপ্রেশন অনেক সময় দেখা দেয়। ডিপ্রেশন দেখা দিতে পারে বিভিন্ন মাত্রায়, গভীরতায় ও পরিসরে। এ রোগটি প্রায়ই দীর্ঘমেয়াদি হয়ে থাকে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির জীবন দুর্বিষহ ও অর্থহীন করে ফেলে এবং মৃত্যুর মতো ভয়ানক চিন্তায় মগ্ন থাকেন। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ভেঙে পড়েন, অলস হয়ে যান, হয়ে যান অকর্মঠ, নিস্তেজ, শক্তিহীন ও মানসিক ভারসাম্যহীন।
জানা যায়, আমেরিকায় প্রতি ২০ জনে একজন মারাত্মক ধরনের ডিপ্রেশনে আক্রান্ত।প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন তাদের জীবনে কখনো না কখনো ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হন।
ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা আসলে কী?
এই প্রশ্নের উত্তর এককথায় বুঝানো সম্ভব না। ডিপ্রেশন খুবই কমন কিন্তু মারাত্মক একধরণের মানসিক ব্যাধি যা আপনার অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা ও কাজকর্মের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমরা অনেক সময় দুঃখবোধ ও বিষণ্ণতাকে এক বলে মনে করি। এ দুটো কিন্তু এক নয়। দুঃখবোধ হলো সাময়িক মন খারাপ যা অল্প কিছু সময় পরেই ঠিক হয়ে যায়। এর জন্য কোন চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। অন্যদিকে, ডিপ্রেশন দীর্ঘকালীন সমস্যা। যা থেকে মুক্তি পাবার জন্য উপযুক্ত চিকিৎসার ও পরামর্শের প্রয়োজন হয়ে থাকে।
ডিপ্রেশন কিংবা বিষণ্ণতার বিপরীত কখনোই আনন্দ নয়, বরং সক্ষমতা। কথাটা হয়তো একটু জটিল শোনাচ্ছে তাইলে আরেকটু ভেঙে বলি- আপনি তো ডিপ্রেসড নন, তার মানে এই না যে, আপনি সারাদিনই খুব ফুর্তিতে আছে, আনন্দে আছেন। বরং আপনি ডিপ্রেসড নন, তার মানে হচ্ছে আপনি স্বাভাবিক বা চিন্তামুক্তভাবে জীবন যাপন করছেন।
ধরেন, আপনি সকালে ঘুম থেকে উঠছেন, বাসা থেকে বের হয়ে অফিসে যাচ্ছেন। সেখানে সহকর্মীদের সাথে কথা বলছেন, বসের সাথে মিটিং করছেন, আড্ডা দিচ্ছেন। তারপর আবার দিনশেষে বাসায় এসে স্বামী কিংবা স্ত্রীর সাথে কথা বলছেন, বাচ্চাদের সাথে খেলছেন,ঘুরছেন ইত্যাদি। ডিপ্রেশন আপনার এই দৈনন্দিন সক্ষমতাকে শেষ করে দেয়। আপনাকে আপনার দৈনন্দিন কাজ কর্ম থেকে দূরে ঠেলে দেয়। তাদের শরীর থাকে সুস্থ, কিন্তু তারা মনের বিরুদ্ধে ঘরের বাইরে বের হতে পারেন না। তারা তাদের শরীরকে মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে অফিসে নিয়ে যান, মিটিং করেন,সবার সাথে কথা বলেন ইত্যাদি। কিন্তু সে যেন বিরক্ত। তারপর একদিন আর এসবও পারেন না। আশে পাশের মানুষের সাথেও কথা বলেন নাহ। চুপচাপ ঘরের ভিতরে কাটান। তখন আমরা উনাকে অসামাজিক ভদ্রলোক/ভদ্রমহিলা খেতাব দেই।
জানা যায়, ডিপ্রেশনের একটি কী-ফিচার হচ্ছে, শূন্যতা। এরকম ডিপ্রেশনে ভুগছেন অনেক ব্যাক্তিই জানিয়েছেন যে, তারা বুকের মধ্যে এক ধরনের ব্যাপক শূন্যতা অনুভব করেন। একদম নিরন্তর শূন্যতা। আর এই শূন্যতার অনুভূতিই সবচেয়ে ভয়ংকর। দীর্ঘসময় ধরে ধারণ করা এই শূন্যতাকে বুকের মাঝে আটকে রাখেন এরপর সেই ডিপ্রেসড মানুষ একদিন নিজেকে নিজেই বুঝান যে, তার এই জীবন সম্পূর্ণ অর্থহীন, এবং সর্বশেষ আত্মহত্যার মাধ্যমে তার ভিতরের এই যন্ত্রণা একবারেই বন্ধ করে ফেলা সম্ভব। ডিপ্রেশন এবং আত্মহত্যা প্রবণতা বা সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি তাই খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
ডিপ্রেশন সম্পর্কে আমাদের ভাবনা-
এই লেখার ভাবনা শুরু হয়েছিলো মূলত সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে একটা পোষ্ট দেখে। পোষ্টটাতে ডিপ্রেশনে ভুক্তভোগিদের তাচ্ছিল্য করে ব্যাপক আঘাত করা হয়। এটা বুঝে পাই না যে, আধুনিক যুগে এসে এখনো একজন মানুষ কেন ডিপ্রেশনের ভুক্তভোগিকে এভাবে তাচ্ছিল্য করতে পারে।
ডিপ্রেশনে ভুক্তভুগির প্রতি সাধারণ মানুষের মন্তব্য এরকম যে,‘‘অমুক কত কষ্টে আছে, তমুকে কত কষ্ট করে জীবন পারি দিচ্ছে। আর তুমি কত আরামে আছো! তাও এমন করছো কেন? আবার কেউ কেউ একে তাচ্ছিল্য করে বলে ডিপ্রেশন হলো আধুনিক জগতের বিলাসিতা আবার কেউ এমনও মন্তব্য করে থাকেন যে, যে মরতে চায় মরুক। এমন মানুষ আমাদের দরকার নেই।’’
আমরা সাধারণত আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়েই সব বিচার করতে চাই। আমরা বুঝতে চাই না যে আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরেও আরও জটিল অভিজ্ঞতা থাকতে পারে। প্রতিটা মানুষের সংগ্রামই তার নিজস্ব, আত্মকেন্দ্রিক বা তার জন্য ইউনিক। প্রত্যেকের চিন্তায় কিন্তু খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার স্ট্রাগলই তার একমাত্র স্ট্রাগল নয়। হয়তো তার পরিবার কিংবা কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক তাকে অসুখী করে তুলেছে। কিংবা সবকিছু ঠিক থাকার পরও শুধুমাত্র মস্তিষ্কের রাসায়নিক সামঞ্জস্যের অভাবে সে অসুখী। যেকনো কারণে একজন মানুষ ডিপ্রেশন হতে পারে আর তার কষ্টটুকুও কিন্তু মেকি নয়!
কেন হয় ডিপ্রেশন?
ডিপ্রেশন একটি জটিল রোগ। কেন এ রোগ হয় নির্দিষ্ট করে কারো পক্ষেই তা বলা সম্ভব না। তবে অনেকের ক্ষেত্রেই কিছু কমন কারণ থাকে যার জন্য এ রোগের উৎপত্তি হতে পারে। এই যেমন অপমানবোধ, মৃত্যুশোক, ব্যার্থতা, জীবনযাপনে ব্যাপক ধরণের পরিবর্তন,বংশগত প্রভাব,নিরাপত্তাহীনতা বা একাকীত্ব,ইত্যাদি। আবার দেখা যায় নির্দিষ্ট কিছু ঔষধ সেবনের ফলেও কেউ কেউ বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়। যেমন, ব্রণের চিকিৎসায় ব্যবহৃত আইসোট্রেটিনিয়ন বা অ্যান্টিভাইরাল “ইন্টারফেরন-আলফা” জাতীয় ঔষধ সেবনেও অনেকে বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়। এছাড়াও আরও বিভিন্ন কারণে মানুষ বিষণ্ণতায় ভুগে থাকে। ব্যক্তিভেদে বিষণ্ণতার কারণে পার্থক্য দেখা যায়।
কী করে বুঝবেন যে আপনি ডিপ্রেশনে ভুগছেন?
দেখা যায় আপনি প্রিয় কাজ গুলো থেকেও ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। মন বসে না সে কাজে, আবার অন্য কিছু করতেও মন বসে না। আবার দেখা যায় আপনার প্রিয় খাবার থেকেও মুখ সরিয়ে নিচ্ছেন। মন চাচ্ছে না আর খেতে। হয় বেশি খাবেন, না হয় কম খাবেন। তবে ডিপ্রেশনের অন্যতম লক্ষণ হলো অনিদ্রা। আপনার হাজার চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারবেন না। তাছাড়াও অন্য সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়া ফেলা, কাজে অনিহা, সব বিষয়ে নেতিবাচক প্রভাব ইত্যাদি লক্ষè যখন নিজের ভিতর দেখবেন তখনই নিশ্চিত হতে পারেন আপনিও ডিপ্রেশন রোগী (!)
ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির উপায়
ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির একদম নির্দিষ্ট সঠিক উপায় নাই। তবে কিছু উপায় আছে। আর এটা হলো নিজের সাথে যুদ্ধ। রুটিন মাফিক চলা, লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা, সঠিক সময়ে খাওয়া, অনিদ্রা দূর করা, ব্যায়াম করা, সর্বদা ইতিবাচক চিন্তা করা, আনন্দে ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি নিয়মিত নিজে নিজে করতে পারলে অবশ্যই ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে কিছু কিছু পর্যায়ে এ রোগের চিকিৎসাও সম্ভব। এ ছাড়া মেডিটেশন কিংবা কাউন্সিলিং এর সাহায্যেও ডিপ্রেশন মুক্ত হওয়া সম্ভব।
তবে আশার কথা যে, ডিপ্রেশনের বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসাও কিন্তু রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, রাতারাতি বিষণ্নতামুক্ত হওয়া কখনোই সম্ভব নয় বরং এ জন্য ধৈর্য ধরতে হবে। মনোরোগ চিকিৎসককে সময় দিতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিষণ্নতার চিকিৎসায় বিষণ্নতারোধী ওষুধ ও সাইকোথেরাপি (ধারণা ও আচরণের পরিবর্তনের চিকিৎসা) দুই-ই প্রয়োজন পড়ে। কেবল ওষুধ প্রয়োগে এটি পুরোপুরি দূর করা সম্ভব না। এ জন্য চিকিৎসক যদি একটু সময় নিয়ে রোগীকে সাইকোথেরাপি দেন, তবে নিরাময় ভালোভাবে দ্রুত হয়। চিকিৎসকের যদি সময়ের সংকট থাকে, তবে তিনি রোগীকে মনোবিজ্ঞানীর কাছে সাইকোথেরাপির জন্য পাঠাতে পারেন। আবার অনেক অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরও (মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বাদে) বিষণ্নতার চিকিৎসা নিয়ে ভুল ধারণা রয়েছে। তাঁরা মনে করেন, ওষুধ বাদে কেবল সাইকোথেরাপি দিয়ে বিষণ্নতা দূর করা সম্ভব। অথচ গবেষণায় দেখা গেছে, এর চিকিৎসায় ওষুধ ও সাইকোথেরাপি উভয়ই দিলে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়। কেবল ওষুধ দিলে মাঝারি ফল পাওয়া যায় আর শুধু সাইকোথেরাপি গুরুতর বিষণ্নতায় তেমন কোনো ফল দিতে পারে না। তাই বিষণ্নতার পরিপূর্ণ চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন ‘বায়ো-সাইকো-সোশ্যাল’ মডেলধর্মী চিকিৎসা। অর্থাৎ, রোগীকে ওষুধ খাওয়াতে হবে, সাইকোথেরাপি দিতে হবে আর পারিবারিক ও সামাজিক সহায়তা দিতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, ঊনবিংশ শতাব্দী বিশ্বের জন্য রেনেসাঁসের শতাব্দী হয়ে থাকে, তবে আমি বলব একবিংশ শতাব্দীকে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, ভয়, বিকারের শতাব্দী! একবিংশ শতাব্দী নিয়ে এসেছে বিরাট অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক ব্রেক এবং বিশ্বব্যাপী নানা সংকট। আমরা যত সৃষ্টিমূলক কাজে নিয়োজিত থাকবো, ব্যর্থতাকে বাদ দিয়ে , অতীতকে বিদায় জানিয়ে দিতে পারবো , আমরা ততই টেনশনমুক্ত থাকা যাবে। অশুদ্ধ প্রতিযোগিতা আর অহেতুক অধিক দুঃচিন্তা দুটোই ডিপ্রেশনের জন্ম দেয়। তাই ডিপ্রেশন থেকে আমরা যথাসম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করবো। তাহলে আমরা জাতি হিসেবেও উন্নয়নের চূড়ান্ত শিখায় পৌঁছাবো।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৮:৫৭