এই পুরো সপ্তাহটাই কেটেছিল ওভাবে। বুধবার ছিল আমাদের পানি-যুদ্ধের দিন। পানি যুদ্ধের প্রধান অস্ত্র ছিল পানি বোমা। পানি বোমা বানানোর নিয়ম হল, ছোট বেলুনে পানি ভরে গিট লাগানো। তারপরে সেটা কারও গায়ে ছুঁড়ে মারলে বেলুন ফেটে পানির ফোয়ারা বের হয়। কাজটা করতে হয় ক্ষ্রিপ্ততার সাথে, দ্রুত গতিতে। কারণ প্রতিপক্ষ সরে যাওয়া মানেই একটা মহা মূল্যবান পানি-বোমা নষ্ট হওয়া। তারপরে, কলের কাছে গিয়ে পানি বোমা বানানোর সময়ের সুযোগ নিয়ে প্রতিপক্ষ পানি-বোমায় ঝলসে ফেলে। যুদ্ধের অলিখিত নিয়ম হচ্ছে দলাদলি করা। চোখের ইশারায় কারও সাথে জোটবদ্ধ হয়ে একজনকে বেছে নিয়ে নাজেহাল করে ফেলা।
মারাত্মক মজা হচ্ছিল। আমি গা বাঁচিয়ে চলছিলাম ভালই। শেষ মুহুর্তে, একদম শেষ মুহুর্তে... যখন পানি বোমা শেষ, কলের কাছে দাঁড়িয়ে বেলুনে পানি ভরছি... তখন, অস্ত্রহীন অসহায় আমার পিছনে দাঁড়িয়ে দিনোজা ঠান্ডা মাথায় ঠিক মাথার উপর একটা বোমা ফাটালো। স্কার্ফ গলে পানি ঠুকে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। আমি অবশ্য প্রতিশোধ নিলাম পুরো পানির বোতল ওর মাথায় ঢেলে।
যুদ্ধ শেষে মাথায় বুদ্ধি আসল। মিস্টার ইনগ্রাডিকে পানিতে চুবাবো। নিজেদের মধ্যে আর কত! নতুন শত্রু লাগবে। মিস্টার ইনগ্রাডি ছিলেন, আমাদের 'ইয়ার এডভাইজার'। প্রতিটা ইয়ারের একটা করে এডভাইজার ছিল, যাদের কাছে খুঁটি নাটি সব সমস্যা নিয়ে যাওয়া যেত। ম্যাথস ক্লাস পছন্দ হচ্ছে না--মিস্টার ইনগ্রাডি। ক্লাসে টিচার নেই--মিস্টার ইনগ্রাডি। মন খুব খারাপ, মনে হচ্ছে পাশ করতে পারব না--মিস্টার ইনগ্রাডি। পেট ব্যাথা করছে--মিস্টার ইনগ্রাডি। ইতালিয়ান বংশদ্ভূত চলি্লশোর্ধ ভদ্রলোক দারুন আমুদে। খুব কাছে টানতে পারেন। আমার মনে আছে, প্রথম যখন স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম ইয়ার টেনে। তখন মোটে বাংলাদেশ থেকে এসেছি সপ্তাহ তিনেক হল। বাংলাদেশে পড়েছি বাংলা মিডিয়াম স্কুলে। চটপট ইংরেজি বলার মত মুখের জড়তা কাটে নি। স্কুলের ইউনিফর্মও নেই ঠিক ঠাক। কারও কথা শুনে ঠিক মত বুঝি না। প্রবল শঙ্কা, জড়তা, বিব্রতভাব। অফিস লেডি মিস্টার ইনগ্রাডিকে ডেকে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ঠিক তখন তিনি যেই হাসিটা দিয়েছিল, সেটা আমার সব শঙ্কা কাটিয়ে দিয়েছিল। বুঝতে পারছিলেন, ইংরেজি বুঝতে সমস্যা হচ্ছে, তাই খুব ধীরে ধীরে কথা বলে সব বুঝিয়ে দিলেন। এরপরে, যতবার যত সমস্যা হয়েছে, ছোট খাট থেকে বড় সড়, সব কিছুর জন্য মিস্টার ইনগ্রাডির কাছে ছুটে যেতাম। আমাদের সবার স্কুল-টাইম-বাবা ছিলেন তিনি, কিন্তু একদম বন্ধুর মত। ভেংচি কাটা যেত তাঁর দিকে তাকিয়ে, তিনি উলটা ভেংচি কাটতেন। একবার বাজি ধরেছিলেন আমাদের সাথে। বাজিতে হেরে মাথার চুল সবুজ রং করে আমাদের ইউনিফর্মের স্কার্ট পড়ে ঘুরেছেন সারা দিন।
আমরা ঠিক করলাম মিস্টার ইনগ্রাডির উপর পানি বোমা বর্ষণ করব। কিন্তু একটা বোমাতে তো কাজ হবে না। তখন ঠিক করলাম ভদ্রলোকের মাথার উপর দোতালার বারান্দা থেকে পানির বালতি উলটে দিব। কয়েক জন মেয়ে ওনাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে এল বারান্দার নিচে। পানি দিয়ে গোসল শেষে ভদ্রলোকের ভাব দেখে কে। মুখ গম্ভীর করে রেখে আমাদের বলছে, দেখ বাচ্চারা, আমার গাত্র-স্পর্শের কারণে পানিটা পবিত্র হয়ে গেছে। আছ বাছারা, এই পানি ছিটিয়ে দিলে তোমাদের কল্যাণ হবে। এইচএসসিতে ফাটাফাটি রেজালট করবে।
মীরা বলছিল, এখন নাকি স্কুলে দারুণ 'এগিং' চলছে। আহ সেই দিনগুলো! আমাদের স্কুলটা মেয়েদের স্কুল, আর কয়েক মিটার দুরেই ছেলেদের স্কুল। মেয়েদের স্কুল হয়েও ঠিক মেয়েদের ছিল না, কারণ আমাদের বরাবর যাওয়া আসা ছিল। কবে থেকে চলে এসেছে সেই ইতিহাস ঠিক জানা নেই, কিন্তু এইচ এস সির ঠিক আগে দিয়ে ছেলে আর মেয়েদের মধ্যে চলে ডিম-যুদ্ধ। ছেলেরা মেয়েরা ডিম নিয়ে ঘুরে। এক স্কুলের ইয়ার টুয়েলভের পাবলিক আরেক স্কুলের ইয়ার টুয়েলভের পাবলিক দেখলেই ডিম ছুঁড়ে। বেশ দুধর্ষ ব্যপার স্যপার চলে। রীতিমত ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এক এক স্কুলের পাবলিকরা বেরিয়ে যেত গাড়ি বোঝাই করে ডিম নিয়ে। আমাদের স্কুলের মেয়েরা ছেলেদের স্কুলের পার্কিং লটে গিয়ে চেনা গাড়িগুলো ডিমে ডিমে ডিমাকার করে আসত। পরের দিন চলত পালটি। আমার স্কুল থেকে বাসা ছিল দেড় ঘন্টার পথ। স্কুলে ডিম খাইলে বাসায় আসতে আসতে কি অবস্থা হবে তাই ভেবে জার্সি খুলে ইয়ার ইলেভেনের মত শার্ট পড়ে হেঁটেছি এ কয় দিন। স্যাম, নিকোল, জেনি ওরা নিজেরা গাড়ি নিয়ে অপারেশনে বের হত। পুরোটা ভিডিও করে এনে দেখাতো কমন রুমে। আহ, কি টান টান উত্তেজনার দিনগুলো!
একদিন কিছু বদ মেয়ে স্যারদের টয়লেটে গিয়ে কমোডে লাল রং ঢেলে আসল। তারপরে করিডরের কোনায় লুকিয়ে থেকে প্রথম ভদ্রলোক ঢুকে যেভাবে ছুটে বেরিয়ে আসল সেটা আগা গোড়া ফিল্ম করল। কমন রুমে সবাইকে দেখিয়ে সে কি হাসি!
সারা বছর ক্লাস ফাঁকি দেয়ার রেকর্ড ছিল না আমার। সুবোধ বালিকা হয়ে ক্লাস করেছি। শেষ সপ্তাহে এসে স্যাম শুনে সেকি ঝাড়ি! কি বল তুমি! তুমি তো আমাদের স্কুলের অপমান! আজকে থেকে আর ক্লাস করবা না। কথা শুনছি, এরপর থেকে ক্লাসে যাইতাম না। শেষ সপ্তাহের চার দিন ক্লাস করি নাই। স্কুল টাইমে স্কুলে এসে শপিং সেন্টারে গিয়ে ঘুরতাম। যাদের যাদের জোড়া ছিল, তাদের অভিসার স্থল ছিল শপিং সেন্টার। বাকিরা কফি খাওয়া আর আড্ডাবাজি। ডিম বা পানি যুদ্ধের পরবর্তী প্ল্যান করতাম। টিচাররা জেনেও কিছু বলত না। কারও কথা বার্তা একান্তই শুনে ফেললে ফিঁচকি হাসি দিয়ে বলত, 'গাইস, আই ডিডনট হিয়ার এনিথিং!'
শেষ দিন তো গন হারে ক্লাস বর্জনের ডাক আসল। হুদা হুদাই। দলে দলে মেয়ে বেরিয়ে আসল ক্লাস থেকে। তারপরে স্কুলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার... ক্লাস ফাঁকি দেয়ার এটাই শেষ সুযোগ! প্রিনসিপাল এক পাশে দাঁড়িয়ে হাসছিলেন কান্ড কারখানায়।
খুব মনে পড়ছে চরম সরলতার দিনগুলোর কথা!
প্রথম ছবিটা মিস্টার ইনগ্রাডির সাথে তার কণ্যাসমগ্র। একটা একসকারশনে যাওয়ার সময় বাসের ভিতর। আমি ক্যামেরার পিছে!
দ্বিতীয় ছবিটা কমন রুম আড্ডার এক পর্যায়ে তোলা। উদ্দেশ্য জার্সির ছবি তোলা। আমি নেই ছবিতে
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০০৬ সন্ধ্যা ৬:০৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





