নৃতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ, রাজনীতিবিদ, রসায়নবিদ, প্রাণীবিজ্ঞানী, উদ্ভিদবিজ্ঞানীর মত মনোবিজ্ঞানীরাও স্ব-অর্জিত টাইটেলের পিছনের দশমনী ওজনের 'বিজ্ঞানী' শব্দটুকুর উপর সুবিচার করতে একই কাজই করে। সাধারণ, প্রতিদিনের ব্যপারগুলো নিয়েই খুবসে অংক কষে, থুতনিতে হাত দিয়ে কি কি ভাবে, আবারও অংক কষে এবং জটিল জটিল শব্দ ভর্তি রচনা লিখে ফেলে। তাই নিয়ে হই চই।
আমার সত্তর বছরের সহজ সরল বুড়ি নানী বরাবরই বলে তরকারী বেশি থাকলে খাওয়া বেশি হয়। ছোটবেলা থেকেই যা শুনে আসছি, সেই তথ্যই শুনলাম সেদিন কোন 'মনোবিজ্ঞানী' [ইটালিক]আবিষ্কার[/ইটালিক] করে মজা লুটছে, নাম দিয়েছে বিশমনী, 'সেনসরি স্পেসিফিক সেটাইটি'।

ভাবছেন, মেয়ের হলোটা কি? এতদিন পরে ব্লগে এসে কি সব কচকচানি শুরু করেছে? আসলে ব্লগ নিয়ে আমার কিছু বলার ছিল। পরীক্ষার পরেও দেখলাম সব নিয়ম উল্টে দিয়ে মাথা থেকে বইয়ের কালো অক্ষরগুলো যাচ্ছে না। সপ্তাহব্যপী অনভ্যাসের পড়াশোনার কুফল! ভাবলাম মাথার ভিতরের বিশেষ অজ্ঞ সাহেবদের উদ্ভাবিত দুইটা জটিল শব্দ দিয়ে আমার আজকের ভরিক্কি আলোচনা পেশ করবো--হ্যাবিচুয়েশন এবং সেনসিটাইজেশন।
হ্যাবিচুয়েশন হলো অভ্যস্ততার ফলে অনুভূতির তীব্রতা কমে যাওয়া। ঈদের দিন মায়ের বিরিয়ানী খেয়ে মনে হয় প্রতিদিন খেতে পারবো। ফ্রীজের একই বিরিয়ানী গরম করে পর পর তিনদিন খাওয়ার পরেই মহা বিরক্তি শুরু হয়। কবে যে মুক্তি পাবো! উল্টাটাও হতে পারে, শুটকি বিদ্বেষে আমি বিশেষ পরিচিত ছিলাম। খেতে খেতেই বিরক্তির তীব্রতা কমে গিয়ে এখন রীতিমত ভালোই লাগে!
সেনসিটাইজেশন হ্যাবিচুয়েশনের পুরো উল্টা ব্যপার। কোন কিছুর ব্যপারে সময় যাওয়ার সাথে সাথে অনুভূতির তীব্রতা বাড়া। প্রেমের প্রথম দিকে যেটা হয়, প্রতিদিনই মনে হয় ভালো লাগাটা নতুন করে বাড়ে। আবার কাউকে দেখে বিরক্তি হলে প্রথমে তার কথা বিরক্ত লাগে, তারপরে তার চেহারা বিরক্ত লাগে, তারপরে তার হাঁটাচলা বিরক্ত লাগে, একসময় তার বাসার কাজের মেয়েকেও বিরক্ত লাগে।
এবার বলি আমার দেখা হ্যাবিচুয়েশনের ব্লগীয় প্র্যাক্টিকাম। আমি নিজে গালি দিতে জানি না, ছোট বেলা 'শয়তান' বললেই বকা খেতাম খুব। তাই আমার কাছে কুকুর বিলাই বলে গালি দেয়াটাও খুব বাড়াবাড়ি। ব্লগে এসে খেয়াল করলাম মানুষ অবলীলায় ব-শব্দ, চ-শব্দ উচ্চারণ করছে এবং তার বৈধতা, ধার, শালীনতা, অশালীনতা নিয়ে বিশাল বিশাল আলোচনা জুড়ে দিচ্ছে। আসলে যারা এসব শব্দ আশে পাশে খুব করে শুনেছেন, তাদের অজান্তেই সেগুলোর ধার কমে জিভে এসে বসে আছে। মুখ খুলতেই সেগুলো লাফিয়ে পড়ে। ওনাদের গায়ে লাগে না। কিন্তু আমরা, যারা কখনও শুনি নি, শুনতে চাই না, তাদের খারাপ লাগে। সত্যিই খারাপ লাগে। হ্যাবিচুয়েশন হয় নি তাই। যারা কথায় কথায় যৌনতা আনেন, বিকৃত যৌনতার কথা বলেন তার একটাই ব্যাখ্যা আছে মনোবিজ্ঞানে। মানুষগুলোর চিন্তাজগতের একটা বড় অংশ জুড়ে যৌন বিকৃতি থাকে। ব্যপারটা শুধু শুধু হয় না, এক্সপোজারের কারণেই হয়। যৌন বিকৃতিতে যত এক্সপোজড হবে, তত সেগুলোর প্রতি খারাপ লাগা কমতে থাকে। হ্যাবিচুয়েশন। যে এক্সপোজড হয় নি, তার এ সংক্রান্ত ভাবনাগুলো এত সহজে আসে না। এই সরল অংক না বুঝার কি হলো বুঝলাম না, অথচ এটা নিয়েই বিশাল ব্লগীয় ঝগড়া, সমাবেশ, মিছিল, গণ পঁচানি...
সেনসিটাইজেশনেরও প্র্র্র্যাক্টিকাম দেখা হয়ে গেল। প্রথম দিকের পোস্টগুলো ঘাটলে দেখা যাবে ব্লগারদের সবার পোস্টে সবার মন্তব্য ছিল। সত্যি সত্যি না হলেও একটা অভিনিত সহাবস্থান এবং সহনশীলতা ছিল। এখন সেটা পুরোপুরি উধাও। একটা স্পষ্ট পোলারাইজেশন বিদ্যমান, যেখানে দুই পক্ষই তীব্র অনুভূতিতে টগবগ করছে। সেনসিটাইজেশনের চূড়ান্ত যাকে বলে! নিজের পক্ষের জনগণের প্রতি নি:শর্ত ভালবাসা, যত যাই বলুক, করুক, না দেখে থাকা। অপর পক্ষকে নিয়ে নামে বেনামে নোংরামী!
সেনসিটাইজেশনের স্বীকার আমি নিজে। কিছু ব্লগারের মহা বেকুবীয়, অযৌক্তিক কথাবার্তা শুনতে শুনতে তাদের নিক দেখলেই মেজাজ খারাপ হয়। সমস্যা হলো, আমি চাই না, গালি এবং মানুষকে বিশ্রী অপমান করার প্রতি আমার হ্যাবিচুয়েশন চলে আসুক। চলে আসলে হঠাত খেয়াল করবো, সেগুলো আমারও জিভের ডগায়। মানুষের প্রতি স্রষ্টার সবচেয়ে সুন্দর উপহার মানুষের মুখের ভাষা। যে কোন মলমের চেয়ে তিন লক্ষ গুণ শক্তিশালী। গন্ধরাজের চেয়ে সুগন্ধী। পৃথিবী ভরা অভুক্ত মানুষগুলোর পান্ডুর মুখে খাবার দিতে পারি না, শীতে কাঁপতে থাকা মানুষগুলোর লজ্জা ঢাকতে পারি না। একটাই যা দিতে পারি, আমার মুখের ভাষা, সেটাই বা কেন দিব না?
আমার নিজের উপর সবচেয়ে বড় অভিশাপ কার্যকরী হবে সেই দিন, যেদিন এগুলো খারাপ লাগবে না আর। খারাপ লাগছিল খুব, এখনও ভীষণ লাগে। যতদিন লাগবে, ততদিনই বেঁচে থাকবো!
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই নভেম্বর, ২০০৬ সকাল ৭:৩২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



