somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রান্নার গল্প

০৩ রা ডিসেম্বর, ২০০৬ সন্ধ্যা ৭:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রান্না বান্নায় আমার আগ্রহ ছিল না কোন কালেই। মাও চাপ দেয় নি। নানু বলতো, মেয়েদের খালি পড়াশোনাই সব? মাঝে মাঝে রান্নাও করতে হয়। মা হেসে বলতো, আরে, আমাকে বিয়ের আগে রান্না শেখান নাই, আমার রান্না খারাপ নাকি? দরকার আসলে আমার মেয়েও এমনি এমনি শিখে যাবে।

ফলশ্রুতিতে আমি চাও বানাতে পারতাম না। কারণ চা বানানোর আগে চুলা ধরাতে হয়। আর ম্যাচের কাঠি দিয়ে চুলা ধরানোর মতো প্রশিক্ষণও আমি নেই নি। (অনেক পরে, ম্যাচের কাঠি জ্বালানো শিখেছি কেমিস্ট্রি প্র্যাক্টিক্যালে, বুনসেন বার্নার জ্বালানোর জন্য)।

তখনই একবার 'প্রয়োজন' এসে গেল। বাবা একসিডেন্টটার পরে খুবই অসুস্থ। পায়ে প্লাস্টার। ছুটিতে ছিল। সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকে। ঘরের কোণায় ক্র্যাচ ছিল বটে, কিন্তু ওগুলোতে তখনও হাঁটতে পারে না। একটু হাঁটতেই কপালে ঘাম জমে। পুরো শরীর কাঁপতে থাকে। ভয়াবহ দু:সময় তখন আমাদের। ওরকম দু:সময়ে আমাদের বাসার কাজের মেয়েটাকে ওর মা নিয়ে গেল। বিয়ের খুব ভালো একটা সম্বন্ধ এসেছে, কিছুতেই ফিরানো যাবে না। মায়ের মাথায় হাত। একা হাতে আর কত সামলানো যায়? আমার তখন পরীক্ষা চলছে ক্লাস এইটের। বৃত্তির জন্য মাথা নামিয়ে পড়ছি। বাসায় যতক্ষণ থাকি, বাবার মাথা ধুইয়ে দিতে পারি, টুক টাক খাইয়ে দিতে পারি, কিন্তু আনুসংগিক আরও যত্নের ব্যাপার আছে যেটা মা ছাড়া আর কেউ পারতো না। তাছাড়া তখন আর্থিক সমস্যা প্রকট। মায়ের স্কুলে না যাওয়ার উপায় নেই। মা বাসায় সার্বক্ষণিক সময় দিতে না পারায় আর কাজের মেয়ে চলে যাওয়ায় সবচেয়ে বড় সমস্যা যেটা দেখা দিলো, সেটা হলো, অভুক্ত থাকার শঙ্কা। বাসায় এসে বাবার যত্ন নিয়ে মা প্রতিদিন এত ক্লান্ত থাকে, কখন রান্না করবে? তবু ভর্তা ডাল দিয়ে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু ভাত তো রাঁধতে হবে!

অগত্যা, আমাকেই নামতে হলো। ভাত রান্নার যাবতীয় ইনস্ট্রাকশন দিয়ে মা সকাল সাড়ে সাতটার বাস ধরলো। এগারোটার দিকে মেপে মেপে আড়াই পট ভাত নিলাম, আঙ্গুল দিয়ে মেপে পানি দিলাম। কিন্তু তারপরে চুলা আর ধরাতে পারি না! একের পর এক ম্যাচের কাঠি জ্বালাই, আর ছেড়ে দেই। চুলার ফাঁক গলে নিচে পড়ে পুরে নি:শেষ হয়ে যায়। এক বাক্স ম্যাচের কাঠি শেষ হলো আর আমার চোখে পানি। কিন্তু ভাত তো খেতেই হবে! বাবার কাছে বিমর্ষ মুখে গিয়ে বললাম সমস্যার কথা। বাবা হেসে ফেলেছে। ঘরের কোণা থেকে ক্র্যাচ আনতে বললো। এনে দিলাম। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম বাবা কাঁপতে কাঁপতে ক্র্যাচ হাত উঠে দাঁড়িয়েছে। খুব ঘামতে ঘামতে বাবার ঘর থেকে স্পেইস, দুই ধাপ সিঁড়ি, ডাইনিং পাড় হয়ে রান্না ঘর পর্যন্ত দুরত্বটুকু পার হলো। তারপরে এক সেকেন্ডের মামলা। আমার তীব্র অপরাধ বোধ হচ্ছে। কেন যে ম্যাচ জ্বালানো শিখলাম না!

যাই হোক, ভাত বসিয়ে দিলাম। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, আগে রাঁধি নি তো কি হয়েছে? ঝরঝরে সুন্দর ভাত রান্না হবে, সবাই দেখে মুগ্ধ হয়ে যাবে। মা বাবা প্রসন্ন মুখে ভাত খাবে কপ কপ।

ভাত সিদ্ধ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করার সময়টুকু বাবার সাথে কাটাবো ঠিক করলাম। বসে বসে দুই জন টিভি দেখছি, গল্প করছি। হঠাৎ বাবা বাতাসে নাক টেনে বলে, কিসের পোড়া গন্ধ? আমি বলি, কই কিসের? বাবা বলে, ক্যামন পোড়া গন্ধ পাও না? ভাত হয়েছে?

আমি পড়ি মড়ি দৌঁড়ায় রান্নাঘরে গিয়ে ভাতের হাড়ি নামালাম। ঢাকনি খুলে দেখি... কি দেখলাম বিশ্বাস করবেন না, একটাও সাদা ভাতের দানা অবশিষ্ট নেই। একটাও। উপরে কিছু গাঢ় হলুদ থেকে বাদামী ভাতের মত বস্তু, নিচে কয়লার মত কালো, শক্ত, পুরু আবরণ। আমি ঝর ঝর করে কানতেছি আর হাড়ি খালি করতেছি। নিজেকে হৈমন্তীর মতো লাগতেছিল। হাড়ি খালি করতে পারি নাই, নিচে কয়লার শক্ত আবরণ উঠানো আমার কম্ম ছিলো না।

ওই হাড়ি আর কাজের ছিল না, নতুন হাড়িতে আবারও চাল ধুয়ে বসালাম, বাবা আবারও জিহাদ করতে করতে এসে নতমুখের আমার সামনে এসে চুলা ধরিয়ে দিয়ে গেল। বাবা হাসছে, তোমার মা বিয়ের প্রথম দিকে আমাকে যা খাওয়াইছে মা, তুমি তো জানো না। এতে কান্নার কি আছে? প্রথম প্রথম সবারই ওরকম হয়। কিন্তু আমার যে নিজেকে প্রবল রকমের ইনকম্পিটেন্ট মনে হচ্ছিল! অসুস্থ বাবাকে এত খাটালাম, মেয়ে হয়ে সামান্য স্বস্তিটুকু দেয়া দূরে থাক, এত কষ্ট দিলাম! প্রথম বারের মতো মনে হলো, "শুধু মেয়ে বলে রান্না করতে হবে" এই ধারণার উল্টো যেতে গিয়ে আমি জীবন বাঁচানোর খুব প্রয়োজনীয় একটা স্কিলকে অবহেলা করেছি।

এখন আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই, কোন দিক দিয়ে যে রান্না শিখলাম! খারাপ রাঁধি না কিন্তু! এখন পরীক্ষার পর থেকে প্রতিদিনই রাঁধছি। ডাল ভর্তা থেকে শুরু করে মাছের তরকারি, শুটকি, আস্ত মুরগির রোস্ট, নতুন যে কোন রান্না। মা ব্যস্ততার জন্য যেসব নতুন মা হওয়া আন্টিদের খাবার রেঁধে খাওয়াতে পারেন না, ওদেরও অহরহ রেঁধে দিচ্ছি। এখন বুঝি, রান্না প্রথমত, বেঁচে থাকার জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটা 'স্কিল'। ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে দেখেছি একটু অহং করেই বলে, রান্না বান্না পারি না। রান্নার মতো সারভাইভাল স্কীল না জানায় কোন ক্রেডিট নেই। আর রান্না অবশ্যই ভীষণ রকমের শিল্প! কঠিন না কিন্তু, শুধু কিসের সাথে কি মিশালে স্বাদ খারাপ হয় না, সেগুলো জানলেই হয়ে যায়। বাকিটুকু প্র্যাকটিস। আর মানুষকে মনের মতো খাইয়ে যেই তৃপ্তিটুকু পাওয়া সেটার সাথে কিচ্ছুর তুলনা চলে না একদম!
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০
১৯টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুহূর্ত কথাঃ সময়

লিখেছেন ফাহমিদা বারী, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৩৭



সামুতে সবসময় দেখেছি, কেমন জানি ভালো ব্লগাররা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়! যারা নিয়মিত লেখে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রচণ্ড নেগেটিভ স্বভাবের মানুষ। অন্যকে ক্রমাগত খোঁচাচ্ছে, গারবেজ গারবেজ বলে মুখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রকৌশলী এবং অসততা

লিখেছেন ফাহমিদা বারী, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৫৭


যখন নব্বইয়ের দশকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং পছন্দ করলাম পুরকৌশল, তখন পরিচিত অপরিচিত অনেকেই অনেকরকম জ্ঞান দিলেন। জানেন তো, বাঙালির ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ডাক্তারিতে পিএইচডি করা আছে। জেনারেল পিএইচডি। সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

NVR (No Visa Required) এর জন্য জেনে রাখা দরকার

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৯
×