-আসসালামু আলাইকুম,
-ওয়ালাইকুমআসসালাম।
-আপনি কি কবি নজরুল কলেজের...এটুকু বলেই ছেলেটি ইতস্তঃত ভাব নিয়ে আমার দিকে তাকায়।
সায়েন্স ল্যাবরেটরী মোড় থেকে বাসে উঠেছি। গন্তব্য গুলিস্তান। গত শুক্রবার (০৪/০৭/১৪) ধানমণ্ডি স্টার কাবাব হাউজে আমাদের ভার্সিটির বন্ধুদের একটা ইফতার এবং আনন্দ আড্ডা শেষ করে বাসার উদ্দেশে রওনা হয়েছি। ইফতারের পর মোটামুটি বাসটি খালিই ছিল। আমার পাশেই ছেলেটি বসা। একনজর ছেলেটিকে দেখলাম। কলেজের স্টুডেন্ট হতে পারে। কলেজে শত শত ছাত্র-ছাত্রী। সবাইকে চেনা সম্ভব নয়।
আমি মাথাটা ঝুঁকিয়ে বললাম তুমি কি কবি নজরুল কলেজের স্টুডেন্ট? কোন ইয়ারে পড়ছ?
-না স্যার, আমি কবি নজরুল কলেজের স্টুডেন্ট না। মাসখানেক আগে একটা চাকুরির নিয়োগপত্র নিয়ে গিয়েছিলাম। নিয়োগপত্রে দু'জন গেজেটেড কর্মকর্তার রেফারেন্স প্রয়োজন ছিল। আপনি তা করে দিয়েছিলেন।
ঘটনাটা আমার মনে পড়ল। ছেলেটি অনেক ঘুরে শেষ পর্যন্ত আমার কাছে এসেছিল। আমি নিয়োগপত্রটা দেখে প্রত্যয়ন করে ছিলাম। সাথে আরেকজন সহকর্মীকে অনুরোধ করে দু'জনের প্রত্যয়নই নিশ্চিত করেছিলাম।
নামটা আবারও জেনে নিলাম। নাজমুল হক সৈকত। ইসলামী ব্যাংকে প্রবেশনারী অফিসার পদে চাকুরি হয়েছে। এখন পোস্টিং নরসিংদী জেলার মাধবদী। কথা প্রসঙ্গে অনেক কথাই বলে চলছে সে। বেশ ক'জনের নিকট গিয়েছিল। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট বিধায় কবি নজরুল কলেজের কোনো শিক্ষকই তাকে চিনে না। তাই কেউই তার নিয়োগপত্রে প্রত্যয়ন করতে চায় নি। আমি খুব সহজেই কাজটি করে দিয়েছিলাম বলে সে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। এমনও বলল যে, আমাকে যেখানেই দেখবে সেখানেই সে চিনতে পারবে।
বিসিএস করা একজন কর্মকর্তা হিসেবে আমার সত্যায়িতকরণ ক্ষমতা আছে। আমি সাধারণত সত্যায়িতকরণের ক্ষেত্রে কাউকে ফিরাই না। যদি মূল কাগজপত্র থাকে সেক্ষেত্রে ফটোকপিতে সত্যায়িত করে দেওয়া আমার পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করি। এ বিষয়ে আমার জীবনের একটি দুঃখজনক অভিজ্ঞতা আছে। ঐ অভিজ্ঞতার পর আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম জীবনে যদি আমার অ্যাটাস্টেশন পাওয়ার আর্জিত হয় তবে আমি কাউকে ফেরাব না।
অভিজ্ঞতাটি শেয়ার করছি-
আমি তখন চিটাগাং ভার্সিটির ছাত্র। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। হলে সিটের জন্য আবেদন করার নোটিশ দিয়েছে। আমি যখন নোটিশটি পাই হাতে একদিন সময় মাত্র। ভার্সিটির শিক্ষক কর্তৃক কাগজপত্র সত্যায়িত করে আবেদনপত্রের সাথে জমা দিতে হবে।
ভার্সিটি কোনো কারণে বন্ধ ছিল। আমার ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের কোনো শিক্ষকই সেদিন আসেন নি। আমি অ্যাকাউন্টিং ডিপার্টমেন্টে গেলাম। সেখানেও কোনো শিক্ষক নেই। ডিপার্টমেন্টের এক সিনিয়র শিক্ষকের কক্ষ খোলা। সাহস করে কক্ষে প্রবেশ করলাম। বিনয়ের সাথে আমার আগমনের উদ্দেশ্য জানালাম। সত্যায়িতকরণের অনুরোধ জানিয়ে কাগজপত্রগুলো স্যারের হাতে দিলাম। স্যার কাগজগুলো একনজর দেখে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, তুমি আমাকে চিন? তুমি আমার কাছে এসেছ কাগজপত্র সত্যায়িত করতে? বেরিয়ে যাও! পরে শুনেছিলাম সে স্যার একসময় প্রো-ভিসি ছিলেন।
কাগজপত্রগুলো কুড়িয়ে নিয়ে চলে এসেছিলাম। চোখ দিয়ে পানি চলে এসেছিল। পরে অর্থনীতি ডিপার্টমেন্টে এক নবীন শিক্ষকের কাছ থেকে সত্যায়িত করে নিয়েছিলাম। সেই ঘটনার পর থেকেই আমার এই প্রতিজ্ঞা ছিল যে, জীবনে কাউকে প্রত্যয়ন বা সত্যায়িতকরণের ক্ষেত্রে ফিরিয়ে দেব না। হোক সে আপরিচিত। কাগজপত্র সঠিক থাকলে সত্যায়িতকরণের ক্ষেত্রে কাউকে হয়রানি করা ঠিক না। আমি যদি এ কাজটি না করে দেই তাহলে হয়তো সে নকল সীল বানিয়ে নিজেই স্বাক্ষর করে জমা দেবে। এটি ভয়াবহ অন্যায় হবে। আর এর দায় আমার উপরও বর্তাবে নিশ্চয়ই।