লক্ষ্মীপুর জেলার সদর উপজেলার অন্তর্গত একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল মজু চৌধুরী হাট। লক্ষ্মীপুর জেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে এ স্থানটি অবস্থিত। মজু চৌধুরী হাটের (ভোলা ফেরীঘাট সংলগ্ন) মেঘনা নদীর তীর ঘেঁষে ৭০-৮০ টি নৌকায় একটি জেলে জনগোষ্ঠীর বসবাস। নদী ভাঙ্গনে সব হারিয়ে একটি নৌকাকে সম্বল করেই তারা এ অঞ্চলে বসত গেড়েছে। ষাট সত্তর বছর ধরে এখানেই তাদের বসবাস। নৌকাই তাদের জীবিকা অর্জনের একমাত্র উপায়। নৌকাতেই ঘুম, খাওয়াদাওয়া এবং জীবনযাপন। এই নৌকা করেই তারা সুদূর মেঘনার বুকে চলে যায় মাছ ধরতে। সারাদিন মাছ ধরা শেষে সূর্য যখন পশ্চিম পাটে অস্ত যায় তারা ফিরে আসে। ছোট ছোট শিশুরা বাবা-মার সাথে নৌকাতেই থাকে এবং মাছ ধরায় সহায়তা করে। মেঘনার এই শাখার বুক চিরে এক টুকরো স্থলভূমি। সন্ধ্যার পরে এ শুকনো ভূমিটুকুতে ছেলেরা ডাংগুলি, মার্বেল কিংবা গোল্লাছুট খেলে সময় কাটায়। আশেপাশে স্কুল নেই। আর থাকলেও ভাসমান এই শিশুদের স্থানীয় ভাষায় `বাইজ্যা' (প্রচলিত অর্থে বেদে) অভিহিত করে স্কুলে ভর্তি নেওয়া হয় না।
২০০৮ সালের ১৪ জুলাই। জেলে পাড়ার ভাসমান এ জনগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য একটি স্কুল স্থাপন করা হলো। মেঘনাপাড় ধীবর বিদ্যানিকেতন। প্রথমে ৩২ জন শিশু নিয়ে স্কুলটি চালু হলো। তারপর প্রতিবছরই শিশুর সংখ্যা বাড়তে লাগলো। বর্তমানে স্কুলে প্রায় আড়াইশ শিশু শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছে। শিশু শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ক্লাস চালু আছে। পাঁচজন শিক্ষক নিবিড় পরিচর্যায় শিশুদের পাঠদান করছেন। কতিপয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তির সার্বিক তত্ত্বাবধানে স্কুলটি এগিয়ে চলেছে। ২০১৪ সালে ৮ জন প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে আটজনই উত্তীর্ণ হয়েছিল। ২০১৫ সালে ১২ জন এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ১০ জন পাস করে। ২০১৬ সালে পঞ্চম শ্রেণীতে ১৭ জন শিক্ষার্থী প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা দেবে। কয়েকজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তির অর্থানুকূল্যে স্কুলটি চলছে। শিক্ষকদের বেতন নিয়মিত প্রদান করা সম্ভব হয় না। শত প্রতিকূলতার মাঝেও এ স্কুলের শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন শিক্ষিত হয়ে দেশের সু-নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠা।
চলতি ২০১৬ সালে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসনের সহায়তায় স্কুলের জন্য চল্লিশ হাত বাই দশ হাতের একটি বড় শ্রেণীকক্ষ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া একটি পাকা সেনিটারী বাথরুম এবং একটি ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন করে দেওয়া হয়েছে। স্কুলের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসনকে জানাই কৃতজ্ঞতা। একটি স্বপ্নের শুরু হয়েছিল কয়েকজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তির প্রচেষ্টায়। সামহোয়্যারইন ব্লগ, প্রথম আলো ব্লগ, শব্দনীড় ব্লগের অনেক বন্ধু এবং শুভাকাঙ্ক্ষী স্কুলটি স্থাপনের সময় আর্থিক এবং মানসিক সহায়তা দিয়ে এগিয়ে নিয়েছেন। ব্লগের এই বন্ধুদের কাছেও কৃতজ্ঞতা। বর্তমানে প্রায় আড়াই শতাধিক শিক্ষার্থীর স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে মেঘনাপাড় ধীবর বিদ্যানিকেতন এগিয়ে চলেছে। এই পথ চলা যেন থেমে না যায় আপনাদের কাছে সে দোয়া প্রত্যাশা করি।
ছবিতে মেঘনাপাড় ধীবর বিদ্যানিকেতন-
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:৪১