সেই থেকেই প্রীতমের সাথে বন্ধুত্ব ওর। বন্ধুত্ব মানে বন্ধুত্বই। প্রীতম বয়সে ছোটো হলে কী হবে, দেশ সম্পর্কে ওর জ্ঞানের বহর দেখলে অবাক হতে হয়। যেদিন ওর সাথে প্রথম দেখা হয়, জয় ওকে জিজ্ঞেস করেছিলো, কেন সে জনসভায় গিয়েছিলো ও আর কেনইবা এতো মন দিয়ে বক্তৃতা শুনছিলো। উত্তরে ও যা বলেছিলো তা শুনে চোখ কপালে উঠে গিয়েছিলো ওর।
‘চাইদ্দিলাম রাস্তাত যারা অষুধ বেচে মাইক দিয়েরে চিল্লাই চিল্লাই ইতারার লগে ইতারার ফাত্থক্য কী।’
(দেখছিলাম রাস্তায় যারা অষুধ বিক্রি করে তাদের সাথে এদের পার্থক্য কী।)
‘কী বুঝলে?’ হেসে জিজ্ঞেস করেছিলো জয়।
‘খনঅ ফাত্থক্য নাই।’ ( কোনো পার্থক্য নেই।)
‘কেন তোমার এরকম মনে হলো?’
‘রাস্তার কেনবাছার অলে মাইনসোরে ধোকা দে, ইতারাও মাইনসোরে ধোকা দে, ওদা ফদ্ধতি বেশকম যে।’
( রাস্তার ক্যানভাসাররা মানুষকে ধোঁকা দেয়, এরাও মানুষকে ধোঁকা দেয়, শুধু পদ্ধতি ভিন্ন।)
হোটেলে আবার দেখা হয়ে গেলো ফখরুদ্দিনের সাথে। ওকে দেখেই প্রীতম জয়ের কানে কানে বললো-‘বদ্দা, আঁর তালই ত আছে দেইর।’( ভাইয়া, আমার তালই তো দেখি আছে।)
‘তাই তো দেখছি, ব্যাটা কি আজ চালের আড়তে যায়নি নাকি।’
জয়ের সাথে প্রীতমকে দেখে বাঁকা চোখে তাকাল ফখরুদ্দিন, দেখেও না দেখার ভান করল জয়। কোনার টেবিল দখল করল ওরা।
‘কী খাবি বল,’ বলল জয়।
‘গরুর গোশত বদ্দা।’
‘হোটেলে এলেই তোর বুঝি শুধু গরুর গোশত খেতে ইচ্ছে করে?’
‘গরুর গোশত অয়ি যে আল্লার নেয়ামত, বেহেশতর মেমা।’(গরুর গোশত হচ্ছে আল্লার নেয়ামত, বেহেশতের মেওয়া।)
খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে চায়ের অর্ডার দিল জয়, প্রীতম তখনো খাচ্ছে। মানিব্যাগ খুলেই জয়ের মুখ চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে গেল, লক্ষ করল প্রীতম, বলল-‘টেঁয়া (টাকা) নাই বদ্দা?’ জিজ্ঞেস করল সে।
‘পঞ্চাশ টাকার একটা নোট ছিলো, এখন তো দেখছি নেই।’ বলল জয়।
‘চিন্তা ন গইরজো, আঁরতে আছে।’( চিন্তা করোনা, আমার কাছে আছে।)
ক্যাশে বসে ওদেরকে গভীরভাবে লক্ষ করছিলো ফখরুদ্দিন। কান পেতে থাকায় কথাবার্তাও শুনতে পাচ্ছিলো। যখন প্রীতম ক্যাশে টাকা দিলো, তার গম্ভীর মুখটা আরো গম্ভীর হয়ে গেলো। জয়ের উদ্দেশে বললো-‘বাবাজির দেখছি বেশ উন্নতি হয়েছে, রাস্তার ছেলেরাও বেশ সম্মান করছে!’ বলার সুরে প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ।
কথাটা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো প্রীতম, বুঝতে পারলো তাকেই ইঙ্গিত করে কথাটা বলা হয়েছে।
‘কথা হুঁশিয়ের অয় খইয়ো, রাস্তার ফুয়া অই বুলি কি ফুঁচি গেইনা, মাইনষোর টাট্টি সাফ গইরজো দে হদিন অর।’ (কথা সাবধানে বলো, রাস্তার ছেলে হয়েছি বলে কি পঁচে গেছি? মানুষের টয়লেট সাফ করেছো কদিন হচ্ছে?)
ফখরুদ্দিনের অতীত ধরে টান দিল প্রীতম, সে যে একসময় মেথর এর কাজ করতো সেটাই মনে করিয়ে দিলো ও। ফল হলো দেখার মতো, রাগে ফখরুদ্দিনের চেহারা লাল মরিচের মতো হয়ে গেলো, ‘বদমাশের বাচ্চা বদমাশ! হারামজাদার বাচ্চা হারামজাদা! কী বললি তুই! আবার বল দেখি, আছাড় দিয়ে তোর মাংস থেকে হাড্ডি না ছুটিয়েছি তো আমার নাম ফখরুদ্দিন নয়!’ মুখে আগুন ঝরছে ওর।
(এই সময় জয় ভাবলো, কথাটা কি মাংস থেকে হাড্ডি হবে, নাকি হাড্ডি থেকে মাংস?)
অবস্থা বেগতিক দেখে ওকে নিয়ে সটকে পড়লো জয়, পিছন থেকে আগুনের শিখা তাড়া করলো ওদের, ‘আর কোনোদিন যদি আমার দোকানের আশেপাশে তোকে দেখি, তাহলে তোর বাপের নাম ভুলিয়ে দেবো বলে দিলাম।’
‘বদ্দা, তুঁই যদি অনুমতি দও, আঁই একখান কাম গইরজোম।’ (তুমি যদি অনুমতি দাও তাহলে আমি একটা কাজ করবো) যেতে যেতে বললো প্রীতম, তখনো ফখরুদ্দিনের উপর রেগে আছে।
‘কী করবি?’
‘আলার ফুয়ার দোহানত গু মাইরজোম যে, দুইদিন ভিতরে ব্যবসা ফুডি যাইবোগই। (শালার ব্যাটার দোকানে গু মারবো, দুই দিনেই লালবাত্তি জ্বলবে ব্যবসার।)
হো হো করে হেসে উঠলো জয়। হাসতে হাসতেই বললো-‘আগে কখনো মেরেছিস?’
‘গেরামত থাকতে একবার মাতবরর দোহানত মারজিলাম।’ ( গ্রামে থাকতে একবার মাতবরের দোকানে মেরেছিলাম)
‘কেন?’
‘আলার ফুয়ার ধানত আঁর ছঅল ফরজিল, ইতারলায় ছঅল ইবা জরাইদি খায় ফেলাইয়ি আলার ফুয়া।’ (শালার ব্যাটার ধানে আমাদের ছাগল পড়েছিলো, এজন্য ছাগলটা জবাই করে খেয়ে ফেলেছিলো শালার পুত)
‘আচ্ছা, তাহলে তো ভালই করেছিস, ছাগলে ধান খেয়েছে বলে ছাগল খেয়ে ফেলতে হবে? তো, দোকান কি বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো?’
‘অই গেইল মাইনি, মাইনষে ইনদি যাইবার সময় নাক চিবি ধরি যাইতো, ইতাও আর সাফ-টাফ ন গরে।’
(হয়েছিলো মানে, মানুষ দোকানের পাশ দিয়ে যাবার সময় নাক চিপে ধরতো। সেও আর সাফ-টাফ করেনি)
মুরাদপুর থেকে এবার বহদ্দার হাট টার্মিনালের দিকে হাঁটা ধরেছে জয়। প্রীতম চলে গেছে অনেকক্ষণ। কেন যে হাঁটছে ও নিজেই জানেনা। মাঝে মাঝে এ শহরে নিজেকে অবাঞ্চিত মনে হয় জয়ের। মনে হয় ইট, পাথর, সিমে›টের এ শহর ওর নয়। ফুটপাত ধরে হাটতে হাটতে রাস্তার দিকে তাকাল জয়। অবিরাম ছুটে চলেছে যান্ত্রিক যানবাহন, হর্নের শব্দে কান পাতা দায়। কে কার আগে যাবে তারই প্রতিযোগীতা। যেন ঘোড়ার রেস, আগে যেতে পারলেই মিলবে মেডেল। কথাটা মনে হতেই একটা জোকস মনে পরলো জয়ের। রেস দেখতে আসা এক যুবক আর এক যুবককে বলছে-‘আচ্ছা, ওরা দৌড়াচ্ছে কেন?’
‘যে ফার্স্ট হবে সে পুরস্কার পাবে।’
‘তাহলে বাকিরা কেন দৌড়াচ্ছে?’ প্রশ্ন প্রথমজনের
চলবে....

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


