এই মানব বসতি নশ্বর পৃথিবীতে প্রেম নামক এক আজব টাইপের ব্যাপার আছে। পিচ্চিপাচ্চা গুলো কৈশর পার হলেই ব্যাস, বালকেরা বীর পুরুষ আর বালিকারা রাজকন্যার মত আচরণ শুরু করে। ছেলেগুলার ভাব দেখে মনে হয় পুরুষ মানুষের সংজ্ঞা এ পৃথিবীতে সে ছাড়া আর কেউ ঠিক মত বোঝে নি। আর রাজকন্যাদের অবস্থা তো আরো কাহিল, যা দেখে তাতেই. '' উঊঊফ, যা কি-ঊ-ট'' বলে মুর্ছা যাবার উপক্রম হয়। কৈশরে পিটুইটারি গ্রন্থির সাসা শব্দ, তারপর প্রেম মূলক কল্পণার চোটে ঘুম না আসা, এভাবেই ঘটে প্রাগৈতিহাসিক মানবিক বিপর্যয়। কিন্তু আসল বিপদটা সেটার চেয়েও বড়।
এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় খুব কাছ থেকে দেখবার সৌ/দূর ভাগ্য আমার একবার হয়েছিলো। আক্রান্ত যে ছেলেটির গল্প বলবো তাকে প্রেমিক সমাজে ঠিক কোন প্রজাতির মধ্যে ফেলা যায় সেটা নিয়ে আমি এখনও নিশ্চত না। যাবতীয় তালিম, স্বার্থবাদী প্রবচণসমুহ, যা কিছু আমোঘ অবশেষ বলে বিবেচ্য সবকিছুই জানত সে। যুক্তির তিন-চারা বারোও মেলেতো সহজেই। নাহ তাকে বোকা বলা যায় না। পাগল বোধয়। পাগল না হলে কি এমন কেউ কি করে??
মহাজ্ঞানীর ভাব নিয়ে সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো- সত্যিকারের ভালোবাসা কাকে বলে??!
যদিও এ প্রশ্নের জবাবে কোনো শব্দ ব্যাবহার করতে ইচ্ছে করছিলো না। তার চেয়ে বরং তার পশ্চাৎ দেশে সর্বশক্তি নিয়োগ করে কষে এক লাথি মারাটা অধিক সঠিক উত্তর বলে মনে হয়েছিলো। ষোলো জুগল দন্ত বের করে মোলায়েম হাসি দিয়ে বলতে ইচ্ছে করছিলো- সোনামানিক, তুমি যার জন্য সত্যিকারের ভালোবাসা কপচাচ্ছো, সেই উর্বসী তোমায় বানর নাচাচ্ছে। তুমি সেটা জানো। সে যেটা করছে সেটাকে বিদ্যা ভান্ডারে অংকশ্রাস্ত্র বলে, প্রণয় নহে। সে শিশুও নয়, বোকাও নয়, সে প্রকৌশলের ছাত্রী। মানব প্রণয় প্রকৌশল তার নন মেজর কোর্স। তুমি তার ল্যাবে চিৎপাৎ গিণিপিগ।
শান্ত ভাবে বললাম, ম্যাথমেটিক্সে তুমি তো নেহায়েত নবিস নও, মনোবিজ্ঞানে নাকি তোমার আজন্ম অভিরুচি। যে খেলা শুরু করেছো তার নাম তুমি জানো। শেষটাও জটিল কোনো হিসেব নয়। তবে কেন? কেন? কেন?
এমন নাচন দিবা জানলে, 'নিউ বেংগল সার্কাস' টাইপের কোনোকিছুতে ক্লাউন হিসেবে জয়েন করতা, সিগারেট খরচটা অন্তত পাওয়া যেত। এই অভাবের দিনে সেটাও বা কম কিসে?
আমার এসব কথা শুনে সে যে মোনলিসা হাসিটা দিলো তাতে আমার পিত্তি জ্বলে গেলো। চিবিয়ে চিবিয়ে বল্লোঃ নির্ভানার ওই গানটা মনে আছে? দ্যা ম্যান হু সোল্ড দ্যা ওয়ার্ল্ড... লং লং টাইম এগো...
বিড়বিড় করে বললোঃ তুমি তো জানো আমি মরে গেছি সেই কবে। লিভিং লাইক আ ডেড ম্যান ওয়াকিং। অভিনয় শিখবার আগেই উকি দিয়েছিলাম এই পৃথিবীর স্টেজের পেছনের গ্রিণরুমে। দেখেছি সবচেয়ে আপন মানুষগুলোর প্রেতাত্বা। স্বার্থের বিভৎস লালা প্রেম থেকে পূন্যে। মর্ত্য থেকে বিধাতায়। এই সহজ সত্যটি বোঝার পর থেকে অনুভূতিহীন হয়ে গেছি। রূপকথার সেই ডাইনীর যাদুতে পাথর হয়ে যাওয়া দুর্ভাগা রাজপুত্রের মতোই আমি মুর্তি এক। দুদোখ জুড়ে কাতর বিষ্ময়।
আমার হারাবার কিছু নেই। হারাবার ভয়ও নেই।
তার এইসব তাত্বিক কথা বার্তা আমার মগজ ভেদ করতে ব্যার্থ হলো, বলাবাহুল্য। তবে এই মুহুর্তে ছেলেটার প্রতি যা অনুভব করছি সেটার নাম করুণা। আমি বেশ শান্ত ভাবেই তাকে জিজ্ঞেস করলাম, হারাবার কিছু না থাকলেও এভাবেই কেনো মরতে হবে ভাই?? কাজ না থাকলেই মানুষ তো আর কমোডে গিয়ে বসে থাকে না...
আমার কথা শুনে সে হেসে ফেললো। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। যাক, রসবোধ এখনো জীবিত আছে। হাসতে হাসতেই বললো, এমন বাজি তো সবাই ধরতে চায় যেখানে হারলে কিছু হারাবার নেই, কিন্তু জিতলে সব পাবার আছে...। আমি তো এমন বাজীই ধরেছি। পৃথিবীর সবচেয়ে খাঁটি ভালোবাসা দেবার পর, যদি সে না পারে আমায় ফেরাতে... যদি জিতে যায় প্রেম সকল কপোটতার চেয়ে গাঢ় হয়ে, ভেবে নেবো মিছেই দোষ খুঁজি পৃথিবীর নিয়মগুলোর- সত্য, সুন্দর এখনো বেওনেটের মত বেরিয়ে আসে ক্লেদ গ্লাণি থেকে। বাজিতে জিতে যদি খুঁজে পাই বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস, খারাপ কি??
হয়তো একটা সম্পর্কের মাঝে এখনও আছে আশ্রয় আমার, হয়তো এখনও সবকিছু ক্লান্তিকর নয়। ভেবে নেবো- আমিই হয়তো আহাম্মক দূঃখ বাদী।
এবার আমার দীর্ঘশ্বাস ছাড়বার পালা। ছেড়েও দিলাম মুখ দিয়ে অনেক খানি। কি বলবো ওকে?
ভালোবাসলেই কি ভালোবাসা পাওয়া যায় নাকি? সব কিছুর একটা সিস্টেম আছে না??
ভালোবাসা পাওয়ার সিস্টেম?? এটুকু বলেই হেসে ফেলল সে। সিস্টেম টা কি??
কি বলবো? প্রেম করতে হলে কিছু কৌশল যে নিতেই হয় এটা সবাই জানে। তার অবস্থা দেখে এক ধরণের নিরাপত্বাহীনতা এসে ভর করলো আমার মাঝে। আমার সম্মুখ ব্যক্তিটি্র যুক্তিবোধ বিপদজনক ভাবে স্ট্রং, আমি এখন যাই বলবো উনি সেটার বিপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে আমার অবস্থা ছ্যাড়া-বেড়া করে দেবেন। কাজেই নিরবতাই শান্তি।
বেশ কিছুক্ষণ নিরবতার শান্তিতে অবগাহন করে সে নিজেই পুরোনো প্রশ্নে ফিরে গেলো- সব থেকে খাঁটি ভালোবাসা কেমনে বাসা যায়?
অসহায়ত্ব চেপে, যতদূর সম্ভব নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম। দৃষ্টিতে কোনো উত্তর না পেয়ে সে নিজের উত্তর দিতে শুরু করলোঃ হিসেব করে তো ভালোবাসা হয়না। প্রতিদানের আশা করে কি আর ভালোবাসা যায়। সেটাতো স্বার্থপরতা হয়ে যায়। পৃথিবীর শ্রেষ্ট ভালোবাসাটি হবে সকল মানবিক দূর্বলতার উর্ধে। কোনো প্রতিদানের লোভ থাকবে না, থাকবে না কোনো ইগো, অভিমান... কাউকে সত্যকারের ভালোবাসা মানে তাকে উজার করে দিতে শেখা, সানন্দে নিতে শেখা যা কিছু সে দিতে পারে। হোক সেটা বুক ছিড়ে যাওয়া কষ্ট, হোক ম্লাণ হাসি... কাউকে সত্যিকারের ভালোবাসা মানে নিজের সুখের উর্ধে তার সুখকে স্থান দিতে পারা। ভালোবাসা মানে নিদারুন ভাবে হেরে গিয়ে প্রতিপক্ষের জয়ে সুখি হতে পারা। আমি তো জানি ও অভিনয় করে মজা পাচ্ছে, আমার গ্লানি লাগেনা, আমি তো প্রেম অনুভব করি রক্তের ভেতর, প্রেমে মত্ত হয়ে মাদকাসক্তের মতোই ছটফট করে পার করি নির্ঘুম রাত... তাকে মিস করে আমার শরীর জুড়ে বিষাক্ততা ছড়িয়ে যায়... তার ছলনা আমার মধ্যে গ্লাণি আনে না... আমি ভালোবাসি সব কিছু হারিয়ে তার একটু সুখের জন্য।
কিন্তু... শব্দটি আমার মুখ থেকে বেরুবার পর সে তাকালো আমার দিকে। তার চোখে জল। আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। ম্লান হেসে বললো সেঃ আমি বাজি ধরেছি, পৃথিবীর সকল অশোভন নিয়মের বিরুদ্ধে। আমার সকল করুণ অভিজ্ঞতার বিরুদ্ধে। এটাই শেষ বাজি। এই বাজিতে হারলে আমি আর কোনোদিন ফিরবো না, কথা দিলাম।
সেদিন আর কিছু বলিনি তাকে।
সে কথা রেখেছে। সে আর ফেরেনি। আমার বোকা সেই প্রেমিক হৃদয়টার সাথে আর কোনোদিন দেখা হয়নি আমার।
তবু তার কান্নার কথা মনে হলে এখনো আমার মুখে ম্লাণ হাসি লেগে থাকে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলিঃ ইস কি কষ্টটাই না পেয়েছিলাম।
Link: I started a joke..
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০১১ দুপুর ১২:১৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




