এই বছর বৃটিশ নাগরিকত্ব লাভ এবং পাসপোর্ট প্রাপ্তির পর সিদ্ধান্ত নেই যে প্রথমে জার্মানীর রাজধানী বার্লিন শহড়ে ভ্রমণে যাব। ইচ্ছে করেই শীতকালে যাবার সিদ্ধান্ত নেই। কারণ মে থেকে সেপ্টেম্বর ইউরোপের প্রধান প্রধান বা প্রসিদ্ধ শহড়গুলিতে অনেক জনসমাগম হয়। স্বদেশ এবং বিদেশী পর্যটকদের আগমনে লোকারণ্য হয়ে উঠে এই সমস্ত শহড়গুলি। ইউকের একটি শহড় থেকে কম খরচে Easyjet এয়ারলাইন্সে করে বার্লিনের টিকেট কাটি। বিমান ভাড়া মাত্র ৭০ পাউন্ড! সে যাই হৌক ঠিক সময়মত বার্লিনে ব্র্যান্ডেবুর্গ এয়ারপোর্টে পৌছালাম। ফ্লাইট দুই ঘন্টার কথা বললেও সময় লাগল দেড় ঘন্টার মতন। জার্মান ইমিগ্রেশন কেবলই আমার কোভিড-১৯র ভ্যাক্সিন নেওয়া আছে কিনা সেটার বৃটিশ NHSর সার্টিফিকেট দেখেই নতুন পাসপোর্টে এন্ট্রি সিল দিয়ে ছেড়ে দিল। কি কারণে আসছি, কতদিন এবং কোথায় থাকব কিছুই জিজ্ঞাসা করল না। আমাকে অফিসার "Ciao" (চিয়াও: ইটালিয়ান যা হ্যালো এবং বাই দুটাই বোঝায়) বললে আমি তাকে জার্মান ভাষায় জবাব দিলাম "Auf Wiedersehen" (যতক্ষণ না পুনরায় দেখা হচ্ছে), সে খুশী হইল। একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম কি বার্লিন কি প্যারিস এই চিয়াও শব্দটাই বেশী ব্যাবহৃত হয় নিজেদের ভাষার বদলে। রাত্রে এসে হোটেলে উঠলাম এবং ৭ ঘন্টা যাত্রার পর বিছানায় গড়িয়ে পড়লাম। মাত্র ৪ দিনের জন্য আসা। পরের দিন সকালে উঠে ঠিক করলাম প্রথমে Brandenburg Gate দেখতে যাব সেখানেই আরো একটা জিনিস দেখা যাবে।
Spree River
Brandenburg Gate
ব্র্যান্ডেনবুর্গ গেইট থেকে সিকি মাইলের মধ্যেই Reichstag Buildingতথা জার্মান সংসদ ভবন অবস্থিত। গেটের মধ্যে দিয়ে এর পেছনে গেলে হাতের ডান দিকেই জার্মান সংসদ ভাবন রাইখষ্টাগ বিল্ডিং অবস্থিত।
Reichstag Building (জার্মান সংসদ ভবন)
এর কিছু দূরেই হইল Berlin Hauptbahnhof তথা বার্লিন শহড়ের কেন্দ্রীয় রেল ষ্টেশন বা প্রধান ষ্টেশন। এভাবে জার্মানির প্রতিটা শহড়ের এই সমস্ত রেল ষ্টেশনকে Hauptbahnhof বলে।
শীত বা কোভিড-১৯র শিথিল লকডাউনের জন্য না বরং এখানে খোজ নিয়ে জানলাম বিশাল এই শহড়ে এত জনসমাগম হয় না। কেবল কিছু দর্শনীয় স্থানেই গ্রীস্ম হতে শরৎকাল পর্যন্তই ভীড়। শহড়ে প্রায় বেশীর ভাগ জায়গাতেই খালি খালি মনে হইল। প্রথম দিন ঠিক করলাম বার্লিনের বিখ্যাত তুরস্কের ডোনার-কাবাবের দোকানে লাঞ্চ করব। চলে গেলাম বার্লিনের অন্যতম বিখ্যাত ডোনার কাবাব Imren Grillএ। যদিও বার্লিনের বেশীর ভাগ ফাষ্টফুডের দোকান থেকে এখানে খাবারের দামটা একটু বেশী কিন্তু ১৫ ইউরোর মধ্যে খাবার পরিমাণে যথেষ্ঠ মজাদার। ৫০ দশকে তুরস্ক হতে যাওয়া অভিবাসী যাদেরকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিধস্ত পশ্চিম জার্মানীতে পুনঃগঠনের জন্য নেওয়া হয়। তারাই এই বিভিন্ন তুরস্ক এবং মধ্যপ্রাচ্যের খাবার গুলিকে জনপ্রিয় করে তোলে। এখানেও কেভিড-১৯ বিষয়ে সতর্কতা যে যাদের টিকা নেওয়া আছে তারাই ভিতরে বসে খেতে পারবে।
এভাবেই দিনের বেলাটা শেষ হইল। যদিও সন্ধ্যায় বের হওয়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু প্রবল বৃষ্টিতে এবং ঠান্ডায় হোটেলেই ছিলাম। পরে রাত্র ১০টার দিকে বৃষ্টি কমলে আরেকটা সাধারণ সেই তুরস্কেরই ডোনার-কাবাবের দোকানে যেয়ে রাতের খাবার কিনলাম। এবার মাত্র ৪ ইউরোতে যে খাবার কিনলাম সেটাই ইমরেনে ১০ ইউরো পড়বে। তবে বলতেই হবে বার্লিনে খাবারের দাম প্যারিস থেকে তুলনামূলক ভাবে ৩০% কম।
পরের দিন ঠিক করাই ছিল। বার্লিনের আরেকটি ঐতিহাসিক স্থানে যাবার। সেটা হইল Checkpoint Charlie।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন সিদ্ধান্ত নিল যে পূর্ব জার্মনীর মধ্যেই বার্লিন শহড়কে বিভক্ত করার। পূর্ব অংশ ওয়ারশো এবং পশ্চিম বার্লিন ন্যাটো জোটের অধীনে থাকবে। এর জন্য নির্মিত হয় বার্লিন ওয়াল বা বার্লিনের দেওয়াল। তখন পূর্ব এবং পশ্চিমের মধ্যে স্থলপথে পারাপারের জন্য তিনটি ক্রসিং চেক পয়েন্ট ছিল। তার মধ্যে Checkpoint Charlie। ইংরেজী অক্ষর "A, B ও C", চার্লি ছিল সি। বহু ঘটনার ইতিহাস এই চেক পয়েন্ট সমূহ এবং বার্লিন দেওয়াল।
এই চেকপয়েন্ট চার্লি দেখার সময়ই আবারও প্রচন্ড বৃষ্টি। এবার মেট্রতে করে চলে গেলাম বার্লিনের সেন্ট্রাল ষ্টেশনে। সেখানে সুপার মার্কেট তথা শত শত দোকান। কাপড়, ইলেকট্রনিক্স, জুয়েলারী, খাবার ইত্যাদি। ঢুকে পড়লাম একটা রেষ্টুরেন্টে লাঞ্চ করার জন্য। এইদিকে বৃষ্টি থামারও লক্ষণ নাই। এটাই ছিল আমার বার্লিন ভ্রমণের শেষ দিনের আগের দিনটা। কারণ পরের সকালেই আবার ইউকের ফিরতি বিমান যাত্রা। কাজেই বাধ্য হয়েই ফিরে গেলাম হোটেলে কারণ অনেক সকালে উঠতে হবে। যাই হৌক সকালে ঠিক সময়মত উঠে আবার সেই ব্র্যান্ডেনবুর্গ এয়ারপোর্টে চলে এলাম। তারপর নিরাপদেই ইউকেতে ফিরত আসি।
Easyjet সহ বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন্স প্রায়ই বিশেষ সুবিধা দেয়। বার্লিনে টিকেট কাটার সময় একটা অফার দেয় যদি ইউরোপের ইটালী, ফ্রান্স, স্পেন বা পর্তূগালের বিখ্যাত শহড়গুলির একটিতে টিকেট কাটি তাইলে ৬০ পাউন্ডেই সেটা সম্ভব। তাই ঠিক করলাম যে প্যারিসেই যাব মার্চে।
মার্চের শেষের দিকে ২১ তারিখে যাত্রা করলাম প্যারিসে। যদিও বলে এক ঘন্টার ফ্লাইট আসলে লাগে মাত্র ৪৫ মিনিটেরও কম। এভাবেই ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের Charles de Gaulle এয়ারপোর্টে অবতরণ করি। যদিও বলছিল যে এখানে কোভিড-১৯র সার্টিফিকেট জরুরী। কিন্তু ইমিগ্রেশন মহিলা অফিসার শুধু পাসপোর্ট নিয়ে তাতে এন্ট্রি সীল দিয়েই ছেড়ে দিলেন। Charles de Gaulle অনেক বিশাল বিমানবন্দর। প্রায় ১৫ মিনিট হাটার পর এখানকার পাব্লিক ট্রান্সপোর্টের টিকেট কাউন্টারে যেয়ে নিয়ে নিলাম ৭ দিনের বাস, রেল এবং ট্রামের পাস। নিল মাত্র ২২.৮ ইউরো। কেবল মাত্র আপনাকে একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি দিলেই হবে তখন এটাতে সেই পাসের উপর জুড়ে দিবে। লন্ডনের মতই স্ক্যানারে সোয়াইপ করলেই ব্যারিয়ার বা গেট খুলে যাবে স্বয়ংক্রিয় ভাবে ষ্টেশনে প্রবেশ এবং বের হওয়ার জন্য।
জার্মানী এবং ফ্রান্সে পাব্লিক ট্রান্সপোর্টের খরচ ইউকে থেকে ৬০-৭৫% সস্তা। লন্ডন শহড়ের ৬টা (মেট্রপলিটন) জোনের চার সপ্তাহের পাস (বাস, ট্রেন এবং ট্রাম) খরচ পড়বে ২৬০ পাউন্ড। বার্লিনে(A, B, C zones) ১০০ এবং প্যারিসে(5 zones) ৭৫ ইউরো। তাহলে বুঝেন ইউকে থেকে কত সস্তা গণপরিবহন। ইউকের এই খরচ বলতে গেলে মানুষের গলা কাটে। যদিও প্যারিস সব সময়ই লোকারণ্য কিন্তু বার্লিনের মতই ৫ মিনিট পর মেট্র বা ট্রেন পাওয়া যায় শহড়ের সব ষ্টেশনে।
এবার প্যারিসে উঠলাম বন্ধুদের ফ্ল্যাটে। তিন বন্ধু আমার। দুইজনের ডিউটি সকাল-বিকাল এবং আরেকজনের রাত ১১টা থেকে ভোর ৬টা। কি দুপুর কিংবা রাত খেতে সমস্যা নাই। যদিও আমি ঠিক করছি যে না শহড় ঘুরে চাইলেই খিদা নিয়ে এত দূরে আবার ওদের ফ্ল্যাটে আসা সম্ভব না। তাই ৭ দিনের মধ্যে ৬দিনই দুপুরের খাবার বাইরে খাব।
প্রথম দিন গেলাম আইফেল টাওয়ার দেখতে। বলে রাখা ভাল আপনারা যদি কেউ প্যারিস যান আপনাদের স্মার্ট মোবাইলফোনে Bonjour RATP এ্যাপটা ডাউনলোড করে নিয়েন। এ্যাপল কিংব গুগেল প্লেতে এটা পাবেন ফ্রিতে। বন্ধুদের পরামর্শেই যেখানে থাকি স্থানীয় মেট্র ষ্টেশনটা মাত্র ২ মিনিট হাটার পথ। বলল যে এটা কিংবা অন্য যে ষ্টেশনেই হৌক সেটার নাম এবং যেখানে যাওয়া তার নাম বললে কিভাবে যাত্রার উপায় সব বলে দিবে এই এ্যাপ। আপনাদের যদি রোমিং বা ডেটা থাকে তো ভাল নতুবা প্যারিস মেট্রতে ইন্টারনেট ফ্রি। ষ্টেশনের কোন প্ল্যাট ফর্ম, পরবর্তী ট্রেনের আগমন সময় এবং কোন ষ্টেশনে নামবেন। আর যদি একাধিক ষ্টেশনে নেমে অন্য লাইনের ট্রেনও ধরতে হয় সব বলে দিবে এই এ্যাপটা। বস্তুত এই এ্যাপটা ব্যাবহার করেই প্যারিসের নির্ধারিত দর্শনীয় স্থান গুলি তথা শহড় ভ্রমণটা সহজ হয়ে যায়।
Eiffel Tower
পরের দিন গেলাম প্যারিসের বিখ্যাত Louvre Museum তথা লুভ যাদুঘরে।
তৃতীয় দিন গেলাম প্যারিসের National Museum Of Natural Historyতে। স্থল, আকাশ এবং পানির জীবজন্তুদের দেহ, কংকাল ইত্যাদির সমারাহ এখানে। ডাইনোসরের কংকালের অবকাঠামো এখানে আছে;
পরের দিন গেলাম প্যারিসের লা বুফন মসজিদে জুম্মার সালাত আদায়ে জন্য
পরে একে একে দেখা হইল Château de Versailles ইংরেজীতে Palace of Versailles তথা ভার্সেইর রাজপ্রাসাদ, গেইট অব প্যারিস এবং Moulin Rouge। এই তিনটার কোনটার ভিতরেই যাইনি। স্রেফ বাইরে থেকে যা দেখা যায় সেটাই দেখা হইছে।
Palace of Versailles
Gate of Paris
Moulin Rouge
এভাবেই প্যারিস ভ্রমণে আমার সূনির্দিষ্ট তালিকার দর্শনীয় স্থানগুলি দেখা হইল।
একটি বিষয় বলে রাখা ভাল বার্লিনে পাব্লিক ট্রান্সপোর্টের টিকেট কিনে যখন ব্যাবহার করতে হয় সাথে সাথে একটি নির্ধারিত মেশিনে এটা পাঞ্চ করতে হয়। তারমানে সেই মুহুর্ত থেকেই টিকেটের মেয়াদ শুরু। ইটালির রোম শহড়েও একই। কেবল প্যারিসের সিষ্টেমটা ইউকের মতই।
ইউকের ফিরতি ফ্লাইট ছিল রাত্র ৯টায়। আর বন্ধুরা সেইদিন দুপুরে চিকেন বিরিয়ানী সহ বেশ কয়েকটি আইটেম আমার জন্য রান্না করে। এমন ভ্রমণ সত্যিই ছিল অসাধারণ। যাক আল্লাহর রহমতে আবারও ইউকেতে নিরাপদে ফিরে আসি।
আর ইউকেতে ফিরে আসলে এয়ারপোর্টে বৃটিশ পাসপোর্ট স্ক্যানারে রাখলেই স্বয়ংক্রিয় ভাবে এন্ট্রি হয়ে গেট খুলে যাবে। মানে কি বিদেশ যেতে কি ফিরত আসতে স্বদেশী কোন ইমিগ্রেশন অফিসারকে মোকাবেলা করতে হয় না। এটা ইউকে, ইইউ, আমেরিকা সহ পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে এমন সিষ্টেম আছে।
দেখতে দেখতে সামুতে ১৪ বছর পার হয়ে গেল। সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব বা Vlog, App, Tiktokই বর্তমানে ব্যাবহারের তুঙ্গে তারপরেও মন চায় মাঝে মাঝে ব্লগিং করি। সেই কারণেই এই বিশেষ পোষ্ট!
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০২২ রাত ৮:৫১