এই সময়কে অনায়াসে বিজ্ঞাপনী সময় বলা যেতে পারে। প্রতিটি পন্যই তাদের নিজস্ব প্রচার ও প্রচারণার জন্য বিজ্ঞাপনী আশ্রয় নিয়ে থাকে। ভোক্তা বা ক্রেতা তাদের বিজ্ঞাপনী প্রচারণায় বিমুগ্ধ হয়ে ওই পণ্য বা দ্রব্যের প্রতি আকৃষ্ট হবে - এ প্রত্যয় নিয়েই পণ্য প্রতিষ্ঠানগুলো কোটি কোটি টাকা খরচ করে চলেছে বিজ্ঞাপনের পেছনে। কিন্তু সব বিজ্ঞাপনই কী ক্রেতাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে? সব বিজ্ঞাপনই কী শ্রেষ্ঠত্বের দাবী রাখে?...
২.
একঘেয়ে প্রচারণা আর গতানুগতিকতা থেকে বের হয়ে বিজ্ঞাপন নির্মাতারা এখন উন্নত দৃষ্টিভঙ্গি আর প্রচন্ড মেধা ও মননের পরিচয় দিচ্ছেন। তারা প্রমাণ করেছেন - বিজ্ঞাপন এখন শুধুমাত্র পণ্যের বাণিজ্যিক প্রচারণা নয়। এর সাথে অনেক ব্যাপারগুলো জড়িত। প্রথমতঃ বিষয় ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য। সম্পূর্ণ ভিন্নধরণের একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ বিজ্ঞাপন দর্শকদৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য। দ্বিতীয়তঃ মেধা ও মননশীলতা। মননশীলতার দাবী নিয়ে নিজস্ব একটা মতামত বা দৃষ্টিভঙ্গি জনসমে উপস্থাপন। তৃতীয়তঃ সংক্ষিপ্ত সময়ে বিজ্ঞাপনের সামগ্রিক ব্যাপারটিকে তুলে ধরা। ইত্যাদি। এতোগুলো বিষয় পার হয়ে তবেই বিজ্ঞাপনটি অনায়াসে শ্রেষ্ঠতর হয়ে উঠতে পারে।
৩.
গত বছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে গ্রামীণফোন কর্তৃক শিশুদের ফুলের শহীদ মিনার তৈরি বিজ্ঞাপনটি বেসরকারি চ্যানেলগুলোতে প্রচার করা হয়েছিল। সার্বিক বিবেচনায় বিজ্ঞাপনটি একটি অভূতপূর্ব হৃদয়গ্রাহী উপস্থাপন। বলাই বাহুল্য, ওই বিজ্ঞাপনটি আমার চোখে দেখা শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞাপনগুলোর একটি।...
প্রতিবারই মন্ত্রমুগ্ধের মত বিজ্ঞাপনটি দেখেছি আর পরিবারের সদস্যদের সাথে এর অনুভূতি ভাগাভাগি করেছি। কোথায় যেন একটা শেকড়ের টান প্রকাশ পেয়ে যায়! তবে দুর্ভাগ্যের ব্যাপার এই, বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনের ইতিহাসে এমন সব নান্দনিক ও গুরুত্ববহনকারী বিজ্ঞাপনগুলো মাত্র অল্প ক'দিন টিভিতে প্রচারিত হয়ে থাকে। অনেক দর্শকই এই বিজ্ঞাপনটি স্বচোখে প্রত্যক্ষ করা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
একুশের সুমহান চেতনায় কয়েকটি শিশু একটি শহীদ মিনার তৈরির সম্মিলিত স্বপ্ন-কে বুকে নিয়ে বাগান থেকে ফুল তুলে নিচ্ছে। ব্যাপারটি বাগানের মালির নজরে আসামাত্র তিনি তাদের সবাইকে হাতে-নাতে ধরে অপমান করে বাগান থেকে তাড়িয়ে দেন। পরে একসময় ওই বাগানের মালি প্রত্যক্ষ করেন, ওই শিশুরা কাগজের মালা দিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণের চেষ্টা চালাচ্ছে। জনৈক মালি তার ভুল উপলব্ধি করতে পেরে তীব্র অনুশোচনায় জর্জরিত হন এবং পরিত্রাণের উপায় হিসেবে তার বাগানের ফুল দিয়ে ওইসব শিশুদের জন্য নিজ হাতে 'ফুলের শহীদ মিনার' তৈরি করে দেন।...
মাতৃভাষার প্রতি কোমলমতি শিশুদের এমন দায়বদ্ধতা আর শিশুদের প্রতি এক মালির ভূমিকা এই দু' ব্যাপারই আমাদের বিবেক-কে অশ্রুসিক্ত করে এবং ভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধার স্থানটিকে আরো শাণিত করে তোলে।
যদিও বিজ্ঞাপনটি নির্মিত হয়েছে - তাদের ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ নিজস্ব প্রচার ও প্রসারের সৃজনশীল ব্যাপারটিকে মাথায় রেখে। কিন্তু এর ব্যতিক্রমী চিত্রনাট্য, পরিমার্জিত ভাষা ব্যবহার, সর্বোপরি যথোপযুক্ত নির্দেশনা ইত্যাদি ব্যাপারগুলো মিলিয়ে এই বিজ্ঞাপনটি বাংলাদেশের একটি শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞাপনের আসন জুড়ে আছে। যার দৃশ্যমান চিত্রগুলোর আবেদন প্রচন্ডমাত্রায় অনুভূতিসম্পন্ন!
৪.
আকাশসংস্কৃতির ক্রমাগত দাপটে মাতৃভাষা যখন কোণঠাসা, বিধ্বস্ত, বিপন্ন তখন এমন একটি বিজ্ঞাপন আমাদের চেতনাকে জাগ্রত করার পে অসম্ভব নয় কোনো ক্রমেই। গত বছরের ওই শিশুদের ফুলের শহীদ মিনার তৈরির বিজ্ঞাপনটি এবারও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলে বেসরকারি চ্যানেলগুলোতে পুনঃপ্রচার করা হলে আবারও সব বয়েসের আলোচনায় স্থান পাবে এই শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞাপনটি।
আকাশসংস্কৃতির অশুভ বেড়াজাল ছিন্ন করে মাতৃভাষার গৌরবোজ্জ্বল মূল্যবোধে নতুন প্রজন্ম দুখিনী বর্ণমালার প্রতি হোক - শ্রদ্ধাবনত আজীবন।
বি:দ্র: লেখাটি ১৯ জানুয়ারি ২০০৮ দৈনিক প্রথম আলো-তে প্রকাশিত।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ দুপুর ২:৪৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



