একজন পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে আমার বোদগম্য জ্ঞান ও বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী কার্ল স্যাগানের COSMOS এর অনুকরণে প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে । বিজ্ঞান ও ধর্মকে এক করে দেখার মানসিকতা অথবা বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে ধর্মের পূর্বনির্ধারিত ভাবার মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো এই লেখার উদ্দেশ্য । এই বিষয়ে আরো অনেক গুলো লেখা পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করতে পারব আশা রাখি ।
প্রতিটি সমাজ ও সভ্যতায় একটা জিনিস সম্পূর্ণরূপে এক ; আর তা হলো নতুন শিশুর জন্ম এবং তার বেড়ে ওঠা । আমাদের মানব প্রজাতির কাছে এটাই সর্ববৃহৎ রহস্য । আমরা জানতে চাই যে- আমরা কে ? আর আমরা এলামই বা কোথা থেকে ? যে মহাবিশ্ব আমরা দেখি তারই উৎপত্তি হলো কোথা থেকে ? মহাবিশ্ব কি চিরকাল এমনই ছিল নাকি এরও একটা শুরু আছে ?
ধর্ম, দর্শন এবং বিজ্ঞান এই তিনটি শাখাই আসলে ঐ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বেড়ায় । আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান অনুযায়ী প্রায় ১৫ বিলিয়ন বছর আগে সকল পদার্থ এবং শক্তি ছিল পুঞ্জীভূত । অতপর বিগব্যাং ও সর্বব্যাপী সর্বদিকে মহাবিশ্বের স্থান ও শক্তি বিকিরণ । এখনকার দিনে আমরা যে মহাবিশ্ব দেখতে পাই তা মূলত এই বিশাল সৃষ্টির একটা অংশ মাত্র । আমরা এখন দেখি সর্পিলাকার গ্যালাক্সী, উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সী, অসম্পূর্ণ-অনিয়মিত গ্যালাক্সী এবং উজ্জ্বল নীল বর্নের গ্যালাক্সী। যদিও আমরা গ্যালাক্সীগুলার উৎপত্তি, বিকাশ ও চলাচল এক শতাব্দীর চেয়েও কম সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করে চলেছি তবু আমরা বলতে পারি এগুলোর অতীত ও ভবিষ্যত । আর এর জন্য দরকার সৃজনশীল ভাবনা ও পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞান ।
যখন আমরা একটি সর্পিলাকার ছায়াপথ দেখি তখন আমরা সর্পিলাকারে বিলিয়ন তারকার মেলা ।
আবার যখন আমরা দেখি একটি ছায়াপথের প্রারম্ভিক অবস্থা , তখন আমরা দেখি গ্যাস ও ধুলিকণার সংমিশ্রন যা দিয়ে আমরা বুঝতে পারি যে তারকাগুলো মূলত গ্যাস ও ধুলিকণার দ্বারা তৈরি ।
এছাড়া আমরা আরো দেখতে পাই দুবাহু যুক্ত সর্পিলাকার ছায়াপথের মেলবন্ধন ।
আর এটা থেকে যৌক্তিকভাবেই আমরা গ্যালক্সি গুলোর বিবর্তন ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা পেতে পারি ।
বৃহৎকার ইলিপটিক্যাল(এটা ভালো বাংলা আমার জানা নেই) গ্যালাক্সি সর্ববৃহৎ সৃজনশীলতার পরিশিষ্ট অংশ কারণ এর পরের অবস্থা ধ্বংসাত্মক । এছাড়াও আরো বিভিন্নরকম রহস্যময় ছায়াপথের সন্ধান পাওয়া যায় যা কিনা বিলিয়ন বছরের পুরানো ।
চিত্রে: ইলিপটিক্যাল গ্যালাক্সী ।
এই অজস্র ছায়াপথ শুধু আমাদের অসংখ্য তারকা আর গ্রহের সংখ্যার ধারণাই দেয় না এটা আমাদের আরো অনেক বুদ্ধিমান জীবনের অস্তিত্ব সম্পর্কেও অবগত করে ।
চিত্রে: নাসার ক্যামেরায় তোলা একটি আকাশগঙ্গার ছবি ।
প্রত্যেকটা ছায়াপথ হয়ত বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে কিন্তু সবজায়গায় একটা জিনিস একই আর তা হলো পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রাবলী । একটা কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে আমরা খুব সহজেই গ্যালাক্সীগুলোর এই বিবর্তন ও পরিবর্তনগুলো বিলিয়ন বছর ধরে হলেও কমপিউটারে তা মাত্র কয়েক মুহুর্তে দেখানো সম্ভব । মহাকর্ষ হলো মূল শক্তি যা এই তারকারাজিকে ছায়াপথে ধরে রাখে আবার ছায়াপথের পারস্পরিক মহাকর্ষই পারে একে অপরকে ধ্বংস করে দিতে । এটাকে ঠিক ধ্বংস বলা যায় না কারণ তারকাগুলো মূলত ধ্বংস হয় না তবে তা ছায়াপথ ছেড়ে বেরিয়ে আসে বাইরের অসীম ফাঁকা স্থানে । আর এভাবেও একটি ছায়াপথ থেকে তৈরি হয় ভিন্ন ভিন্ন ছায়াপথ ।
বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এই রকম কিছু বিচ্ছিন্ন তারকারাজির সন্ধানও ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে । তবে মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় জিনিস হচ্ছে কৃষ্ণগহবর । এই বিষয়ে আশা করি অন্য কোনোদিন বিষদ আলোচনা করতে পারব ।
আমরা যে ছায়াপথে আছি তা সর্পিলাকার এবং মহাকর্ষীয় বলের প্রভাবে গ্যাস এবং ধূলিকণার সংমিশ্রনের এর কেন্দ্রে উৎপন্ন হচ্ছে নতুন তারা যা কিনা স্পাইরাল ঘূর্ণনের ফলে ধীরে ধীরে কেন্দ্র হতে বাহিরের দিকে চলে যায় । ফলে তারকা মৃত্যু হলেও নতুন তারকার জন্মও হতে থাকে ।
সৃষ্টিবিজ্ঞান নিয়া পড়াশুনা করার জন্য প্রকৃতির কিছু মূল সূত্র জানা আবশ্যক । যারা এই প্রবন্ধটি পড়ছেন তাদের জন্য ডপলার ক্রিয়া বোঝা অত্যাবশ্যক ; যদি কেউ তা না জেনে থাকেন তবে তাদের জন্য উচ্চ মাধ্যমিক পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম পত্র বইয়ের শেষ তিন অধ্যায় পড়া বাধ্যতামূলক তবু যদি পড়তে না চান তবে আমার কথা বিশ্বাস করেন । সারাজীবনতো অনেক ধর্মীয় অলৌকিক কাহিনীই বিশ্বাস করলেন আর এখন না হয় পড়াশুনার ভয়ে একটা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব না বুঝেই বিশ্বাস করলেন । :p
তবে ড্রপলার ক্রিয়া কি তা আমি আপনাদের বুঝিয়ে দেই without mathematics । এটা হলো যে কোনো তরঙ্গের উৎসের আপেক্ষিক গতির ফলে ঘটা ঘটনা । যেমন ধরেন আপনি স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছেন । এবার ৫ কি.মি দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনটা যদি হুইসেল বাজায় তবে আপনি যত জোড়ে হুইসেল শুনবেন তা অবশ্যই ট্রেনটা যদি আপনার দিকে অথবা উল্টো দিকে যেতে শুরু করে তার থেকে বেশি বা কম হবে । অথ্যাৎ ট্রেনের আপেক্ষিক বেগের উপর শব্দের তীব্রতা নির্ভর করে হুইসেলের উপর না । মূলত ট্রেনের গতি আপনার জন্য শব্দের কম্পাঙ্কের পরিবর্তন ঘটায় । এই ঘটনা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় যে মহাবিশ্ব স্থির না সম্প্রসারণশীল । ব্যাপক আপেক্ষবাদে ঈশ্বর বিশ্বাসী আইনস্টাইন মহাবিশ্বকে স্থির প্রমাণ করার জন্য একটা ধ্রুবকের আর্বিভাবও ঘটিয়েছিলেন । যদিও ১৯৩০ সালে এডুইন হাবল একটা পর্যবেক্ষণ দ্বারা তাকে ভুল প্রমাণ করেন । এক্ষেত্রে হাবল পদার্থবিজ্ঞানের যে সূত্রটি ব্যবহার করেছিলেন তা আর কিছুই নয় ; একটু আগে বলা ডপলার ক্রিয়া ।
হাবল ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ছায়াপথের ছবি তুলে দেখতে পান যে ছায়াপথের আলোর রং পরিবর্তন হচ্ছে কিন্তু এত কম সময়ে এত বেশি পরিবর্তন কোনোভাবেই সম্ভব না । আর এর একমাত্র ব্যাখ্যা হচ্ছে আমাদের ছায়াপথের সাপেক্ষে অন্য ছায়াপথগুলোর আপেক্ষিক গতি । এই গতির ফলে আলোর কম্পাঙ্কের পরিবর্তন ঘটে আর তাই ভিন্ন ভিন্ন কম্পাঙ্কের জন্য ভিন্ন ভিন্ন রংয়ের আলো দেখা যায় । হাবল দেখছিলেন যে ছায়াপথগুলা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে যা তিনি আলোর বর্ণ পরিবর্তন দ্বারা বুঝতে পেরেছিলেন । যেমন : বেশি কম্পাঙ্কের বেগুনী আলো থেকে আলো নীল বর্ণ ধারন করলে আমরা কম্পাঙ্কের হ্রাস বা আপেক্ষিক দূরত্ব বেড়ে যাওয়ার প্রমাণ পাই ।
এবার তাহলে আমরা আলোচনায় আসি মহাবিশ্বের স্থান সম্পর্কে । এটা একটা বিরাট প্রশ্ন যে আমাদের মহাবিশ্বের স্থান সমতল নাকি বক্রাকার ? এটা হতে পারে সমতল এবং ভরের কারণে স্থান সংকোচনের ফলে(আনস্টাইনের ব্যাপক আপেক্ষবাদ অনুযায়ী) দীর্ঘ যাত্রাপথে এটা বক্রাকার । ধরি, আমরা একটা দ্বিমাত্রিক রেখা টানতে শুরু করলাম যা অনেক দূর পর পর অল্প অল্প করে বাঁক খেতে থাকল ফলে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে অসীম দৈর্ঘ্যের ঐ রেখা অবশ্যই কোন একসময়ে আবার ঐ রেখার প্রাক পথে এসে মিলিত হবে । আর আমরা হয়ত অমন কোন এক গোলক ধাধাতে বন্দি যেখানে ত্রিমাত্রিক জগতের বাসিন্দারা আরো অধিকমাত্রা দেখতে পাইনা তাই মহাবিশ্ব সর্বদা আমাদের কাছে ত্রিমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা সীমাবদ্ধ ।
অনেক কসমোলজিস্ট মনে করেন, আমাদের ছায়াপথগুলো একই জায়গায় আসে যদিও স্থানের বর্ধন ঘটছে । ব্যাপারটাকে একটা বেলুনের সাথে তুলনা করা যায় যেখানে অনেকগুলো ফুলকি আছে । ঐ ফুলকিগুলোকে যদি আমরা ছায়াপথ মনে করে বেলুনটাকে ফুলাতে শুরু করি তবে ঠিক উপোরোক্ত ফলাফল পাওয়া যায় । তবে একটা বিকল্প প্রশ্নও আসতে পারে । স্থান ও কাল যেহেতু পরস্পর সম্পর্ক যুক্ত তবে এটা কিভাবে ঘটে ? এক্ষেত্রে আমরা কৃষ্ণগহবরে স্থান ও কালের সংকোচনও দেখতে পাই । সিঙ্গুলারিটি বা নব্য পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র তৈরি হওয়া ঐ স্থানগুলোর সংখ্যা অনেক আর ঐগুলোকে স্বতন্ত্র মহাবিশ্ব বলাই অধিক গ্রহণযোগ্য । ব্লাকহোল হয়ত আমাদের ঐ ভিন্ন ভিন্ন মহাবিশ্বের সংযোগ স্থল । এক্ষেত্রে ব্যাপারটাকে পাম্প ছাড়া ফুটবলের সাথে তুলনা করা যায় যেখানে এক অংশের ট্যাপ খেলে অন্য অংশ ফুলে ওঠে ।
সে যাই হোক । বিগ ব্যাং কে যদি আমরা সৃষ্টির শুরু ধরে নেই তবে দ্বিতীয় আরেকটি প্রশ্ন আছে । আর তা হলো শূন্য থেকে সৃষ্টি হওয়া মহাবিশ্বের আগে তবে কি ছিল ? এর উত্তর পাওয়া যায় বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থ থেকে । আর তা হলো ঈশ্বর,খোদা বা ভগবান ছিল যে কিনা মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছে। এর এটাই হলো ধর্মের মহত্ত্ব । বিজ্ঞানের যেখানে শেষ , ধর্মের সেখানে শুরু । এ ব্যাপারে কুরাআন শরীফে স্পষ্ট বলা আছে-“ মানুষের জ্ঞান যেখানে শেষ , আমার(আল্লাহ) জ্ঞান সেখানে শুরু ।”
তবে এটা আসলে কোনো জবাব না , এটা হলো প্রশ্নটাকে ফ্যাসিবাদী কায়দায় অবদমন করা । আরো সহজভাবে বললে – “একটা রহস্যকে অন্য আরেকটি রহস্য দ্বারা প্রতিস্থাপন করা এবং সেই রহস্য সম্পর্কে প্রশ্ন করাও নিষিদ্ধকরণ ।”
সুতরাং চলেন আমরা প্রশ্ন চালিয়ে যাই – ঈশ্বর যদি শূন্য হতে আসতে পারে তবে মহাবিশ্ব ক্যানো শূন্য হতে আসতে পারে না ? তারা বলে যে ঈশ্বর সর্বদা বিরাজমান তবে মহাবিশ্ব ক্যানো সর্বদা বিরাজমান নয় । আমরা হয়ত বারবার সৃষ্টি আর ধ্বংসের একটা চক্রে আবদ্ধ । বিগব্যাং ঘটার পর থেকে পদার্থবিজ্ঞান বাদে আর কোনো সূত্রই মহাবিশ্বের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারে না । সুতরাং যদি আমরা ধরেও নিই যে ঈশ্বর হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী তবুও তার সীমাবদ্ধতা রয়েছে যার প্রমান আমরা পাই “কোয়ান্টাম মেকানিকসে”(এ ব্যাপারেও আশা করি পরবর্তীতে আলোচনা করতে পারব), আর একারণে ঈশ্বরবিশ্বাসী মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনও কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে মেনে নেননি । যদিও প্রকৃতি কোন ব্যাক্তির ইচ্ছার ধার ধারে না । তাই কোয়ান্টাম মেকানিক্স এগিয়ে চলেছে এবং তার ফসল হিসাবে কম্পিউটার ও ইলেক্ট্রিক্যাল সাইন্স গড়ে উঠেছে । তাই ঈশ্বরের ক্ষমতাও প্রকৃতির খেয়াল খুশির কাছে সীমিত । হিন্দু মিথলজিতে মহাবিশ্বকে ঈশ্বরের স্বপ্ন রূপে উল্লেখ করা হয়েছে । সে হিসাবে একজন ঈশ্বর কিভাবে অসংখ্য মহাবিশ্বের স্বপ্ন দেখছেন তা একটা রহস্য । তাই একজন ঈশ্বরের অসংখ্য মহাবিশ্বের স্বপ্ন দেখার যৌক্তিকতার চেয়ে অসংখ্য মানুষের একজন ঈশ্বরকে কল্পনা করা সহজ । আর তাই প্রকৃতির নিয়মকে কারো স্বপ্নের কাছে যেমন অনুমতিও নিতে হয় না তেমনি কারো শিঙ্গার ফুঁতে তা ধ্বংস হওয়ার জন্যও অপেক্ষা করতে হয় না । অবশ্য প্রকৃতির নিয়মকে গজব বলাও আরেকটি ধার্মিক উপাখ্যান ।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০১৩ রাত ১০:২৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



