দুপুর গড়িয়ে বিকেলের পথে পা বাড়াচ্ছে সূর্যমামা, ঘড়িতে সময় দেখলে ৩.১৯ বাজছে। এই সময়টা তে খুব ভাতের খিদা পায় হোসেনের। আজ প্রায় দু বছর হতে চলল হোসেন দুপুরে ভাত খায় না। অনেকটা ইচ্ছে করেই খায় না। আরেক জনের ভাত খাওয়া দেখতে খুব ভাল লাগে। ক্ষুধার্থ একজন প্লেটে ভাত নিয়ে, তরকারি অর্ধেক ঢেলে, মরিচে একটু একটু করে কামড় দিয়ে, মাখিয়ে ভাত খাওয়া দেখতেই খুব ভাল লাগে, যেন একধরনের প্রশান্তি।
আজও রাস্তার ফুটপাথের পাশে চা এর দোকানে বসে চা খাচ্ছে আর ভূমিসুতা কখন এই রাস্তাটা দিয়ে যাবে তার জন্য অপেক্ষা করছে। চা এর দোকান টা ট্রান্সফরমার এর খুটির একটু পাশেই। শহুরে পাতি কাক গুলির যেন এক আড্ডাখানা এই ট্রান্সফরমার। দুটা, তিনটা, চারটা এসে বসে আর কা কা করে যায়।যেন কি জম্পেশ একটা আড্ডা।
ভূমি এখন ও আসছে না, আরেক কাপ চা এর অর্ডার দিল হোসেন। সবকিছুই তার দূর থেকে দেখতে ভাল লাগে। নিজেকে কেন জানি নিজেই অস্পৃশ্য ভাবে।
ফুটপাথ টা হোসেনের ডান হাতে ধরা চায়ের কাপের দিক থেকে প্রায় ২০ফিট এর মত সোজা গিয়ে বামে বাক নিয়েছে। ওই বাকের মোড়েই এক ভীষন বৃদ্ধ মাথা নিচু করে, দেয়াল এ পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। কোন নড়াচড়া নেই। যেন মনে হচ্ছে ধ্যানরত, অনেকটা নির্জীব।
হোসেন উঠে দাড়াতে যাবে এমন সময় বিকট শব্দে কি যেন ফাটল। অনেকটা ছোটবেলায় জুস এর প্যাকেট ফুলিয়ে লাফিয়ে পা দিয়ে ফাটানোর সময় যেরকম শব্দ, সেই শব্দটা যদি মাইক্রফোনের সামনে নিয়ে মাইকে ছাড়া যেত অনেকটা সেরকম। হোসেনের মনে হোল মাথার উপরেই কিছু একটা ঘটেছে। চমকে কিছুটা দূরে এসে দাড়ালো।
কাকের আড্ডা খানায় গোলযোগ। ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ। নিচে একটা কাক পড়ে আছে। পুড়ে গেছে অনেকটাই। মারা কিছুক্ষনের মধ্য ই। খুব খুব হাল্কা শব্দে ডাকছে। মিনিট পাচেক পড়ে একটা জীবিত কাক এসে পাসে দাঁড়ালো। এদিক ওদিক তাকিয়ে কর্কশ কন্ঠে ডাকছে। কিছুক্ষনের মধ্য দুটি, চারটি, বারোটি দেখতে দেখতে অনেক অনেক কাক, মৃতপ্রায় কাক টি কে ঘিরে দাঁড়াল। যেন ওরা মরতে দেবে না ওদের সজাত কে। কিছুতেই না। মৃতপ্রায় কাক টি আর ডাকছে না। হয়ত মারা গেছে। ঘিরে থাকা কাক গুলি ডেকেই চলেছে। তাদের ডাক তীব্র থেকে হচ্ছে আরো তীব্রতর, হারানোর বেদনা হয়ত বাড়ছে তীব্রভাবে।
হোসেন দাঁড়িয়ে আছে, দেখছে। ফুটপাথের বাকে মানুশ হেটে যাবার সময় একটু দাড়াচ্ছে, অথবা আড়চোখে তাকিয়ে দ্রুত হেটে চলে যাচ্ছে, কেউ কেউ ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তায় নেমে এড়িয়ে চলে যাচ্চে। ফুটপাথের বাকে হেলান দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকা বৃদ্ধটির প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে আগেই। উতসুক কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করছে মারা টারা গেছে নাকি!! কেউ বলছে ইশ কি অবস্থা! আবার শোনা যাচ্চে উফ এদের জালায় এই শ হ রে আর থাকা গেল নাহ।
আচ্ছা মারা যাবার আগে কি বৃদ্ধ কি কিছু বলতে চাইছিল? কিছু কি আশা করছিল? সজাতির মুখ কি একবার হলেও দেখবার সাধ জেগেছিল? হয়ত।
হোসেন কাক গুলির দিকে একবার তাকায়, বৃদ্ধর দিকে একবার তাকায়। ক্ষনিকবাদে রাস্তার দিকেই তাকায়, আবার কিছুক্ষন বিকেল হয়ে যাওয়া দেখে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ১১:৫৭