কথায় আছেঃ বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।।
পোষ্টটা দিয়েছিলাম গ্রুপে, ছবি বাদে। মূল পোষ্টের ছবিগুলো সেখানে দিতে পারিনি। তাই একটু ফাইন টিউন করে এখানে পোষ্টাইলাম। যেখানের পোষ্ট সেখানেই মানায়.....কি বলেন আপনারা?
কি কারনে জানিনা, ছোটবেলা থেকেই পাহাড় আমাকে টানে প্রচন্ডভাবে। তুলনায় সমুদ্র আমার কাছে মোটামুটি একটা একঘেয়ে বিষয়। আশির দশকের শুরুর দিকে আমার জীবনে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম আর পার্বত্য চট্টগ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম। হালিশহরে আমার বড়চাচা থাকতেন তখন। উনাদের এবং আমাদের পরিবারের সবাই একসাথে রাঙ্গামাটি আর বান্দরবানও গিয়েছিলাম। এর আগে দেশের পাহাড় দেখা বলতে আমার ঝুলিতে ছিল টাঙ্গাইল, কুমিল্লার ছোটখাট পাহাড় বা টিলা দর্শন। চাচা যখন বললেন, চিটাগাং আয়, দেশের পাহাড় কি জিনিস, দেখবি……বলতে গেলে তারপর থেকেই আব্বার জীবন আমি অতীষ্ঠ করে তুলেছিলাম চিটাগাং যাওয়ার জন্য। ততদিনে অবশ্য দেশের বাইরের বেশকিছু পাহাড়ী এলাকার দর্শন হয়ে গিয়েছে আমার।
ভাবনায় ছিল চট্টগ্রামের পাহাড় আর কি হবে, টাঙ্গাইল, কুমিল্লার মতোই কিছু একটা! শুনে চাচা যেভাবে তাচ্ছিল্যের সাথে ‘টাঙ্গাইল, কুমিল্লার পাহাড়, হুহ!!’ বলেছিলেন তাতেই আমার আগ্রহ যেন শতগুনে বেড়ে গিয়েছিল।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম পার হওয়ার পর চট্টগ্রাম ঢুকতেই বামদিকে পাহাড়ের সারি দেখে গাড়ীর জানালায় সেই যে নাক লাগিয়েছিলাম, পরবর্তী দশদিন আমি সেই মুগ্ধতা থেকে আর বের হতে পারিনি। চট্টগ্রাম শহরটা তখন ছিল দারুন সুন্দর। ছিমছাম আর নিরিবিলি পাহাড়ময় একটা শহর।
ঝুকিতে টাইগার পাস;
পরের বার চট্টগ্রাম যাই নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে। পরিস্কার মনে আছে, শহরে ঢুকে আতকে উঠেছিলাম। একেবারে যেন ঢাকার কার্বন কপি! শহরের পাহাড় বেশীরভাগই উধাও। এরপরে অনেকবারই বিভিন্ন কারনে চট্টগ্রাম যাওয়ার কথা উঠেছে, আর আমি বিভিন্নভাবে এড়িয়ে গিয়েছি। আর যাইনি। কক্সবাজারেও কয়েকবার গিয়েছি চট্টগ্রাম এড়িয়ে, বিমানে। কেন? বলতে দ্বিধা নেই, মনের দুঃখে। দার্জিলিংয়ের মতো হতে পারতো যে শহরটা, সেটার একি দশা! এর নাম যদি উন্নতি হয়, তাহলে এ’ধরনের উন্নতি থেকে একশত হাত দূরে থাকা উচিত। প্রকৃতিকে ধ্বংস করলে প্রকৃতিও প্রতিশোধ নিতে ছাড়েনা কখনও। মোটামুটিভাবে গত ত্রিশ/চল্লিশ বছরে চট্টগ্রাম বিভাগে পাহাড় ধসে কি পরিমান প্রানহানি হয়েছে? পাহাড়ধস এর আগেও হতো নিশ্চয়ই। কিন্তু এর ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেয়েছে কতোগুন? এর ফ্রিকোয়েন্সিই বা কতোটা বেড়েছে? পরিস্থিতি এখন এমন, বর্ষাকাল এলেই বাংলাদেশের খবরের ওয়েবসাইটগুলো ভয়ে ভয়ে খুলি, না জানি কি দেখবো……..কতোটা প্রানহানি অপেক্ষা করছে এ’বছর!
কোন দোষ না করেও কিছু অসহায় মানুষকে এমন পরিনতি ভোগ করতে হয়;
আমাদের দেশের পাহাড়গুলোতে ধস নামে কেন? সবকিছুর মতো এখানেও দলীয় রাজনীতি। সরকার আর তাদের অনুসারীরা বলবে, এটা প্রাকৃতিক একটা দূর্যোগ। বিরোধীরা বলবে, এটা সরকারের দূর্ণীতি এবং অব্যবস্থাপনার প্রকৃষ্ট উদাহরন…..যেটা একেবারে মিথ্যা নয়। কিন্তু আসল ঘটনা হলো, অন্যদলগুলো যখন ক্ষমতায় ছিল, তারাও সেই একই কাজ করেছে। এদের চুলাচুলি না দেখে বরং বিশেষজ্ঞরা কি বলে দেখি।
মূলতঃ অতিবর্ষণের ফলে পাহাড়ের মাটি আলগা হয়ে ধস নামে। মজার ব্যাপার হলো, যে কেউ বলবে, এটাতো সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক একটা ব্যাপার! এখানে অব্যবস্থাপনা এবং দূর্ণীতির কালোহাত কোথায়? অবৈধভাবে পাহাড়ের মাটি আর গাছপালা কাটা, পাহাড়ের মাটি আলগা হওয়ার প্রধান কারন। এগুলোর বিক্রয়মুল্য অত্যন্ত উচ্চ। একশ্রেণীর ঠিকাদার এই কাজ করে প্রশাসনের ছত্রছায়ায়। এখানে শাসকশ্রেনীর মুনাফা কোথায়, এই মুনাফার ভাগ-বাটোয়ারা নীচ থেকে উপর পর্যন্ত কিভাবে যায় তা আশাকরি ভেঙ্গে বলার দরকার নেই। এদের সীমাহীন লোভের কাছে দেশ তথা মানুষের জান-মাল, দেশের প্রকৃতিক ভারসাম্য, নান্দনিকতা কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়। এরা দিনশেষে বোঝে শুধু টাকার অংক। এই টাকা দিয়েই তারা বিদেশে গোপনে মোটা ব্যাংক ব্যালেন্স করে, সন্তানের বিদেশে পড়ালেখা নিশ্চিত করে, পরিবারের বিদেশে সু-চিকিৎসাও নিশ্চিত করে। কাজেই দেশ এবং দেশের মানুষ গোল্লায় গেলেও এদের কিছুই যায় আসে না।
পাহাড়ধস আর ধসজনিত জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য কি করা উচিত? সমাধান খুবই সহজ। প্রথমেই সরকার এবং প্রশাসনের সীমাহীন লোভ বন্ধ করা উচিত। তারপর পাহাড়ের মাটি আর গাছপালা কাটা বন্ধ করা উচিত। প্রচুর বনায়ন করা উচিত। সবশেষে, যারা ঝুকির মধ্যে বসবাস করছে, তাদের অন্যত্র সরিয়ে দেয়া উচিত।
পাহাড়ের জায়গাগুলো সরকারের খাস জমির মতো। যে পারে, ছলে-বলে-কৌশলে দখল নেয়। তারপর সেখানে কোনরকমে বাড়ীঘর তৈরী করে গরীব, ভাসমান লোকজনের কাছে ভাড়া দেয়। ক্ষমতাবান না হলে তো এটা সম্ভব না। এই ক্ষমতাবানরা তাদের এই কর্মের কারনে কে ঝুকিতে আছে, কে মরলো কিংবা আহত হলো, এসবের কোন তোয়াক্কা করে না। এ’ব্যাপারে ২০১৭ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পাহাড়ের পাদদেশে অপরিকল্পিতভাবে বসতি স্থাপনের কারণে ধসের ঘটনা বাড়ছে বলে জানিয়েছিলেন। তাই দুর্যোগের পর ’রি অ্যাকটিভ’ ভূমিকা না নিয়ে আগে থেকেই ’প্রো অ্যাকটিভ’ ভূমিকা নিতে প্রশাসনকে নির্দেশ দেন ওবায়দুল কাদের। আর এসব কাজে রাজনৈতিক কোনো হস্তক্ষেপ সহ্য করা হবে না বলেও জানান মন্ত্রী। এখন আপনারাই বলেন, পাহাড় কেটে ঘরবাড়ী বানিয়ে ফেলা কি একদিনের কাজ? দেশের কেউ আবাসনহীন থাকবে না, এটা সরকারের মন্ত্রী এমপিরা অহরহ বলেন, সেটার বাস্তবায়ন কি পাহাড় কেটে? এইসব কথার কথা আর কতদিন?
২০০৭ সালে পাহাড় ধসে ১২৭ জনের যে মর্মান্তিক প্রাণহানি ঘটে তার প্রেক্ষিতে গঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে ৩৬টি সুপারিশ দেওয়া হয়েছিল। সেগুলোর কোন গতি করার ইচ্ছা সরকারের আদৌ আছে নাকি ফাইল চাপা পরে গিয়েছে? সেই কমিটির সুপারিশগুলো বাতিলের কোন খবরও তো নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল ইসলাম বলেছেন, ‘বেশিরভাগ পাহাড় ধস হচ্ছে মনুষ্যসৃষ্ট কারণে। পাহাড়কে পাহাড়ের মতো থাকতে না দিলে ধস নামবেই। যেখানে পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি করা হবে, সেখানে পাহাড় ধস তো হবেই।’ বাংলাদেশের পাহাড়গুলোতে মাটির পরিমান বেশী, পাথরের পরিমান কম। সুতরাং মাটি, গাছপালা কাটলে মাটি আলগা হবেই। একটা সুষ্ঠ, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার বিকল্প অন্ততঃ এ’ক্ষেত্রে নেই। আমাদের দেশে বন, নদী, পাহাড়, খাল-বিল সবকিছু রক্ষারই আইন আছে। তারপরও এগুলো রক্ষা করা যায় না। কেন? এগুলো তো দেশের বাইরে থেকে কেউ এসে দখল করে না, নাকি করে? রক্ষক যখন ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন আসলে করার কিছুই থাকে না।
বান্দরবান সদর উপজেলার একটা ঘটনা সংক্ষেপে বলি।
উন্নয়ন কাজের নামে সেখানে এসক্যাভেটর দিয়ে পাহাড় কেটে আশপাশের নীচু জায়গা ভরাট করা হচ্ছিল। দু’টা ক্রাইম একসাথে। এ’ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বান্দরবান পৌরসভার সচিব জানান, পাহাড় কাটার ব্যাপারে উনি কিছুই জানেন না আর এর দায়িত্বও পৌরসভা নিবে না। আর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানানো হলে উনি বলেন, পাহাড় কাটার কোন অনুমতি নেই। অবৈধভাবে পাহাড় কাটা বন্ধে দ্রুতই ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে ফলাফল হচ্ছে, ব্যবস্থা নেয়ার আগেই পাহাড় আর জলাশয়ের সমতল ভূমিতে পরিনত হওয়া!!!
কি তামশা! বাত্তি ছাড়াই সব ফকফকা, কি বলেন! অনেক দেশই ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হলো, কিন্তু এমনতরো ভাণুমতির খেল আর কোথাও হয় বলে দেখিনি বা শুনিনি। আপনাদের এমন বিরল সৌভাগ্য কখনও হয়ে থাকলে শেয়ার করতে ভূলবেন না যেন!
তামশার একটা নমুনা;
অরন্যে রোদনেরও একটা নমুনা;
এসব রিলিফ যাতে করে না দিতে হয়, তার ব্যবস্থা করা কি খুবই কঠিন?
আমি জানি, এসব লেখা অরন্যে রোদনেরই নামান্তর। তারপরও যখন মনে হয় আর সহ্য করা যাচ্ছে না, তখন লেখি। এ’ছাড়া আমাদের মতো আম-জনতার আর করারও কিছু বোধহয় নেই। এটাও জানি যে, আবারও একদিন কিছু অসহায় মানষের করুণ মৃত্যু হবে কিংবা সহায়সম্বলহীন হবে। নিহতদের পরিবারপ্রতি সরকার হয়তো ২০ হাজার আর আহতদের ১০ হাজার টাকা করে দিবে। অতি আবাদের আমাদের এই দেশে আম-আদমীর দাম তো এর থেকে বেশী কিছু না। হয়তোবা পরিবার প্রতি ৩০ কেজি চাল এবং শুকনা কিছু খাবার দেয়া হবে……কারন দেশে খাদ্যের কোন অভাব নেই। খাদ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ! সরকারের তরফ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে নিহত এবং আহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো হবে। তারপর একসময় সবাই সবকিছু ভূলে যাবে, ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার আগে পর্যন্ত। এটাই পাহাড়ে বাস করা দরিদ্র মানুষদের নিয়তি……সেইসঙ্গে অভাগা এই সোনার দেশটা্র নিয়তিও বটে!!!
ছবি ও তথ্যঃ নেট থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২০ সকাল ১০:৪২