গন্তব্য কোথায়??
শিহাব আহমেদ। একজন নব্য ধনী। অল্প কয়েক বছরে অভাবনীয় উত্থান হয়েছে তার। নগদ এবং সম্পত্তি মিলিয়ে কতশত কোটি টাকা তার আছে সেটা নিজেও জানেনা। এর কোন উপার্জনই সরল পথে হয় নাই। ক্যাসিনো ব্যবসা, মাদক ব্যবসা, সোনা চোরাচালানী থেকে শুরু করে হেন কুকর্ম নাই যা সে টাকার জন্য করে না। তার কালোহাত যতো লম্বা হয়, সরকার এবং প্রশাসনের তত মাথা কিনে নেয় সে। টাকাই তার কাছে এখন ইশ্বর!
গ্রামে দু‘একর জায়গার উপর বিশাল জমকালো এক বাড়ী তৈরী করেছে। গ্রামের মানুষের কাছে সে রাজা, কাজেই তার বাড়ীটাকে রাজ প্রাসাদই বলে গ্রামের লোকেরা। আজ সেই বাড়ীতে তার প্রথমবারের মতো গৃহ প্রবেশ ঘটবে। সেটাকে স্মরণীয় করে রাখার মানসে ঢাকা থেকে বাড়ীতে উড়ে যাওয়ার জন্যে হেলিকপ্টার ভাড়া করেছে। পুরোটা গ্রাম এবং আশেপাশে আরো কয়েকটা গ্রামের সব মানুষকে দাওয়াত দিয়েছে। রাজার গ্রামে যাওয়া রাজকীয় না হলে কি মানায়?
এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য গাড়ীতে উঠতে যাবে এমন সময় দেখলো বড় গোলাপ ঝাড়টার কাছে কালো আলখাল্লা পরা একলোক দাড়িয়ে আছে। কে লোকটা? পাশ ফিরে থাকায় চেহারা ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। ভুরু কুচকে উঠলো শিহাব আহমেদের। তার কঠোর নিরাপত্তার চাদরে ঘেরা বাড়ীর ভিতরে এই লোক ঢুকলো কি করে? তার সাথে সবসময় দু‘জন অস্ত্রধারী রক্ষী থাকে। তাদেরকে বলতে গিয়ে চোখ সরিয়ে আবার কি মনে করে ঝাড়টার দিকে তাকালো…...কেউ নাই সেখানে। আশ্চর্য তো! এইমাত্রই না দেখলো!! দাড়োয়ানদেরকে ব্যাপারটা জানিয়ে খুজে বের করতে বললো লোকটাকে। হাতে সময় নাই, বহু গন্যমান্য লোক আসবে নতুন বাড়ীতে। তার আগেই পৌছুতে হবে সবকিছুর তদারকীর জন্য।
মনটা কেমন যেন একটু খচ খচ করছিল, হেলিকপ্টারে উঠে খুবই স্বস্তি বোধ করলো। হেলিকপ্টারটা বাড়ীর কাছে চলে এসেছে…..এই তো, আর একটু পরেই নামা শুরু করবে। আগামী সময়গুলোর কথা ভেবে খুবই উত্তেজনা অনুভব করছে সে। ঠিক এমনি সময়ে কাধে কয়েকটা টোকা পরাতে পিছনে তাকালো। বাগানের সেই লোকটা বসে আছে পিছনের সীটে। ভয়ে আত্মারাম খাচাছাড়া হয়ে গেল শিহাব আহমেদের।
ভীষণদর্শন লোকটা বললো, তৈরী হয়ে নাও। তোমাকে এখনই আমার সাথে যেতে হবে।
আপনি কে? কাপা কাপা গলায় প্রশ্ন করলো শিহাব আহমেদ।
আজরাইল। জলদগম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো আগন্তুক!!
অসম্ভব পরিণতি
রাত দু‘টা বাজে। ঘুম আসছে না। বসার ঘরে একা একা দাবা খেলছি। সময় কাটানোর খুবই প্রিয় উপায় এটা আমার। হঠাৎ তীব্র পিপাসা পেল। উঠে গিয়ে পানি খেতে হবে, কিন্তু চরম আলসেমিতে পেয়ে বসেছে; উঠতে ইচ্ছা করছে না একেবারেই। সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। পিপাসার সাথে সাথে কেমন যেন টায়ার্ডও লাগছে। দাবায় মন বসাতে পারছি না একদম!
পানি নাও।
চোখ খুলে দেখি পানির গ্লাস হাতে পাশে এসে দাড়িয়েছে মিলি। মিলি….আমার স্ত্রী। অবিশ্বাসে চোখ যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো, তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে এক দৌড়ে শোবার ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিলাম। তীব্র আতংকে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গিয়েছে আমার। মুখ হা করে বড় শ্বাস নিয়ে ফুসফুসটাকে অক্সিজেন দিয়ে ভরিয়ে ফেলতে চাইলাম। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে ভাবছি, এটা তো অসম্ভব। নিশ্চয়ই ভুল দেখেছি। মিলি? কিভাবে??
বাইরে খুটখাট শব্দ হচ্ছে। কেউ যেন হাটাহাটি করছে। কিন্তু বাসায় তো আমি ছাড়া আর কেউ নাই। কে হতে পারে? মিলি? মাথা কাজ করছে না একেবারেই।
এতো ভয় পাচ্ছো কেন? নিজের বউকে কেউ এতো ভয় পায়?? পিছনে তাকিয়ে দেখি বিছানার ওপাশে মিলি দাড়িয়ে আছে। মুখে কেমন যেন একটা বিদ্রুপাত্মক হাসি। তাকিয়ে আছি ওর দিকে, মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না আমার। ও তেমনই আছে…...মাস ছয়েক আগে এক ঝড়ের রাতে যেমনটা দেখেছিলাম।
ঝট করে উঠে রুম থেকে বের হতে চাইলাম। কিন্তু দরজা কোথায়? যেখানে থাকার কথা ছিল সেখানে নাই! কেমন যেন শীতল একটা পৈশাচিক মৃদু হাসির শব্দ শুনতে পেলাম।
মিলি বিছানা ঘুরে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আমার দিকে, যেন হাওয়ায় ভাসছে। কি চায় ও? এখানে এলোই বা কিভাবে? ছয় মাস আগে এই রুমে এমন সময়েই ওকে গলা টিপে খুন করে বাড়ীর পিছনে মৃতদেহটাকে মাটিচাপা দিয়েছিলাম না! তাহলে!!
তীব্র আতঙ্কের শ্বাসকষ্ট তীব্রতর হয়ে উঠলো আমার। মনে হচ্ছে, কে যেন চাপ দিয়ে বুকের পাজর ভেঙ্গে ফেলছে। মিলি এখন আমার ঠিক সামনে এসে দাড়িয়েছে। মণিবিহীন সাদা চোখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আর সহ্য করতে পারলাম না। আমার হাত দু‘টো আপনা আপনি উঠে গেল গলার দিকে…….দড়াম করে আমার দেহটা আছড়ে পড়লো মেঝের উপর!!!
পালানোর পথ নাই
খুব ভোরে, সূর্য ওঠার আগে সপ্তাহে পাচ দিন জগিং করা আমার অনেকদিনের অভ্যাস।
আমি থাকি আজিমপুর নতুন পল্টন লাইনে। বাসা থেকে বের হয়ে বিডিআর ৩ নং গেইট পর্যন্ত হেটে আসি। তারপরে জগিং করতে করতে আজিমপুর কবরস্থানকে ডানে আর নিউমার্কেটকে বায়ে রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দিয়ে সোহরাওয়ার্দী পার্ক পযন্ত দৌড়াই।
অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও ফজরের আজানের সাথে সাথে উঠে তৈরী হয়ে বেড়িয়ে পরলাম। বাসার বাইরে দেখলাম হিজ মাষ্টার্স ভয়েস ভঙ্গিতে একটা কুকুর বসে আছে, যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছে। আশপাশে বেওয়ারিশ কুকুরের অভাব নাই। কাজেই গুরুত্ব না দিয়ে হাটা শুরু করলাম। বায়ে বাড়িঘর আর ডানে আজিমপুর কবরস্থানের সীমানা প্রাচীর, বিডিআর গেইট পর্যন্ত এই রাস্তাটায় ভোরের নির্জন অন্ধকারে একটু গা ছমছমে ভাব থাকে। যেতে যেতে কি মনে করে পিছনে তাকিয়ে দেখি, সেই কুকুরটাও আমার পিছনে পিছনে আসছে। আসলে আসুক, পাত্তা দিলাম না। সম্ভবত এই রাস্তায় ওরও একটু ভয় ভয় করে! বিডিআর গেইটের সামনে এসে ধীরে ধীরে দৌড় শুরু করলাম। দেখি দু‘টা কুকুর আমার পিছনে পিছনে দৌড়াচ্ছে। আরে! আরেকটা এলো কোত্থেকে!! পিছনে দু‘টা কুকুর, দৌড়ানো ঠিক হবে না। এবার হাটা শুরু করলাম।
ফাকা রাস্তায় লক্ষ্য করলাম, সামনে, কবরস্থানের সীমানা শেষ হওয়ার একটু আগে রাস্তার ঠিক মধ্যিখানে প্রথম কুকুরটার ভঙ্গিতে আরো দু‘টা কুকুর বসে আছে। সামনে দু‘টা পিছনে দু‘টা কুকুর, মাঝখানে আমি। একেবারে ঘেরাও অবস্থা। এবার সত্যি সত্যি ভয় পেতে শুরু করলাম। পিছনের কুকুর দু‘টা গর গর করে উঠলো। ঝেড়ে দৌড় দেয়ার প্রশ্নই আসে না; পুরাপুরি দাড়িয়ে গেলাম। আশেপাশে কেউ নাই, একেবারে নির্জন রাস্তা। ভাবছি, কি করা যায়!
নিউমার্কেটের পোষ্টঅফিসের দিক থেকে কালো রংয়ের আরো একটা বিশাল কুকুর এগিয়ে এলো, সাথে একটা বাচ্চা কুকুর, সাদা রংয়ের। বাকী চারটা কুকুর যেন এদের অপেক্ষাতেই ছিল। এবার আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেললো।
লাইটপোষ্টের আলোতে বাচ্চা কুকুরটাকে দেখে আমার গায়ের সব রোম দাড়িয়ে গেল। শরীরে কেমন যেন একটা শিরশিরে অনুভূতি। চার পাচ দিন আগে বিকালবেলা খেলার ছলে এটাকে লাথি দিয়ে ড্রেনে ফেলে দিয়েছিলাম না! ওটাই তো! গলার লম্বা দড়িটাও তো দেখি ঠিকঠাক আছে! কিন্তু ওটা তো মরে গিয়েছিল! গন্ধ বেরুতে শুরু করায় গত পরশুদিন মেথরকে কিছু টাকা দিয়ে মৃতদেহটা সরানো হয়েছিল! এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আমার আত্মা শুকিয়ে গেল। এরা কি তাহলে প্রতিশোধ নিতে এসেছে!
কালো কুকুরটা রক্তহিম করা ভয়ংকর এক গর্জন দিয়ে আমার উপর ঝাপিয়ে পরলো। সেইসঙ্গে বাকী চারটাও।
ছবি: গুগল থেকে।
পাদটীকা: আগামীকাল (৩১শে অক্টোবর) হ্যালোউইন উদযাপিত হবে এখানে। স্টোরগুলো কুমড়া আর ভৌতিক সব জিনিসপত্রে বোঝাই। আশেপাশের পরিবেশও কেমন যেন বদলে গিয়েছে। তাই ভাবলাম, আমিও ব্লগে একটু ভৌতিক আমেজ আনার চেষ্টা করে দেখি!
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০১৯ বিকাল ৩:৫৯