করোনা ভাইরাসের উপুর্যপুরি হামলায় বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত সারা বিশ্ব এবং তার অর্থনীতি। বিশ্ব-অর্থনীতির হর্তাকর্তাদের ধারনা, এই বিপর্যস্ততা সহসা কাটবার নয়। উল্লেখ্য, বিশ্ব-অর্থনীতির প্রধান ধারক-বাহক এবং প্রভাব বিস্তারকারী বলয় হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব (বিশেষ করে আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপ) এবং চীন। করোনা ভাইরাসের প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠে চীনের নজর এখন সামনের দিকে। এদিকে আমেরিকা এবং ইউরোপ এখনও এই সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছে। আজ যদি মনে হয় পরিস্থিতি একটু উন্নতির দিকে, তো কাল মনে হয়, না…..'দিল্লি হনুজ দূর অস্ত' অর্থাৎ দিল্লি এখনো অনেক দূর! এমনি এক অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে এক জমজমাট চিত্রনাট্য রচনা হতে যাচ্ছে, যা এখনও হয়তোবা সবার মনোযোগ সেইভাবে আকর্ষণ করে উঠতে পারে নাই। কি সেটা? মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির প্রধান কুশীলব যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপ। যার পিছনের কারন, সেই আদি এবং অকৃত্রিম তেল এবং অবশ্যই, হালের করোনা ভাইরাস।
আমেরিকা সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে তারা তাদের সৌদি আরবে মোতায়েন চার ব্যাটারী সারফেস টু এয়ার প্যাট্রিয়ট ক্ষেপনাস্ত্র এবং তার সাপোর্টিং বিমান এবং লোকজন সরিয়ে নিবে। ঘোষণা অনুযায়ী আমেরিকা ইতোমধ্যেই দু'টি ব্যাটারী, তাদের দুই স্কোয়াড্রন যুদ্ধবিমান এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সামরিক লোকজন (সংখ্যাটা প্রায় তিন শত) সরিয়ে নিয়েছে। তাছাড়া আমেরিকা গাল্ফ উপসাগরীয় অন্চলে তাদের নৌবাহিনীর উপস্থিতিও হ্রাস করতে যাচ্ছে। আমেরিকার ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল আর কাতারের আল জাজিরাতে প্রকাশিত এই সংবাদে সৌদিদের আরামের ঘুম হারাম হওয়ার উপক্রম। 'প্যাট্রিয়ট' নামধারী এই ডিফেন্সিভ মিসাইল সিস্টেমটা আসলে কি? অতি সংক্ষেপে বলতে গেলে, এটি শত্রুপক্ষের মিসাইলকে লক্ষ্যে আঘাত হানার আগেই আকাশে ধ্বংস করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে দৃশ্যতঃ ইরানের হুমকি থেকে সৌদি তেল স্থাপনাগুলোকে রক্ষা করার জন্যই এই সিস্টেমটাকে সেখানে মোতায়েন করা হয়। তাছাড়া সম্প্রতিকালে ইয়েমেনের হুতি মিলিশিয়াদের মিসাইল আক্রমনের মুখেও এটা সৌদিদের একটা বড় ভরসাস্থল ছিল।
আমেরিকা এই সিদ্ধান্ত কেন নিল? তাদের তরফ থেকে সোজাসাপ্টাভাবে বলা হচ্ছে, বর্তমানে ইরান এই অন্চলে যুক্তরাস্ট্রের কৌশলগত ইন্টারেস্টের জন্য কোন তাৎক্ষণিক হুমকি বলে আর প্রতীয়মান হচ্ছে না। আমেরিকান নীতি-নির্ধারকদের মতে, জানুয়ারীতে জেনারেল কাশেম সোলাইমানীর হত্যাকান্ড আর সাম্প্রতিক করোনার আক্রমনের ফলে ইরান ছ্যাড়াবেড়া হয়ে এ'অন্চলে তাদের কর্তৃত্ব স্থাপনের সক্ষমতা হারিয়েছে। ফলে পেন্টাগন ভাবছে, মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েনকৃত রিসোর্স বরং এশিয়া প্যাসিফিকে চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক প্রভাবের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো হোক। কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলেই তাই? আমেরিকা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি যতোই চীনের দিকে ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা করুক না কেন, দুনিয়ার হালচালের খবর যারা রাখে তারা কিন্তু তাদের বেহাল অবস্থা ঠিকই আচ করতে পারছে। ব্যাপারটা আরেকটু পরিস্কার করার জন্য বরং চলুন, অল্প একটু পিছনে যাই।
অনেক বিশ্লেষকের মতে, সাম্প্রতিক করোনা ভাইরাসের আক্রমনে বিপর্যস্ত যুক্তরাষ্ট্র তাদের ব্যয় কমানোর কৌশল হিসাবে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের উপস্থিতি হ্রাস করছে। তবে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, অতিসম্প্রতি সৌদি আরব কর্তৃক তেলের উৎপাদন বাড়ানো আর দাম কমানো নিয়ে ওয়াশিংটনের সাথে রিয়াদের মনকষাকষি তুঙ্গে ওঠে। ঘটনার সূত্রপাত হয় সাম্প্রতিক সৌদি-রাশিয়া তেল যুদ্ধের মাধ্যমে। গত মার্চে তেলের দাম মডারেট রাখার লক্ষ্যে সৌদি আরব চেয়েছিল রাশিয়া তাদের তেল উৎপাদন ওপেকের সাথে মিল রেখে কমিয়ে আনুক; এটা একই সঙ্গে আমেরিকারও চাওয়া ছিল। কিন্তু রাশিয়া সৌদিদের বা অন্যকথায়, ওপেকের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন কমাতে রাজি হয় নি। তাই সৌদি আরবও বাধ্য হয়ে উৎপাদন চালু রাখে, যার ফলশ্রুতিতে ৮ই মার্চ নব্বুই সালের গাল্ফ যুদ্ধের পরে তেলের সবচেয়ে বড় দরপতন ঘটে।
মনে রাখতে হবে, আমেরিকা একই সাথে তেলের আমদানি এবং রপ্তানীকারক দেশ। এরা অপরিশোধিত তেল আমদানী করে, আর পরিশোধিত তেল রপ্তানী করে। এখন ঘটনা হলো, এরা রেগুলার দামে তেল আমদানী করে তাদের রিজার্ভয়ারগুলোকে উপচানো অবস্থায় রেখেছে, আর করোনা ভাইরাসের কারনে বিশ্বব্যাপি তেলের ব্যবহার ভীষণভাবে কমে যাওয়ার ফলে যেহেতু রপ্তানী করতে পারছে না, সেটাও, অর্থাৎ রপ্তানীযোগ্য তেল, উপচানো অবস্থায় আছে। সত্যি বলতে সোজা বাংলায়, এই মজুতদারীর কারনে তেল রাখার আর জায়গা নাই আমেরিকায়। এদিকে গোদের উপর বিষফোড়ার মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তাদের উৎপাদন বাড়িয়ে ক্রেতাদেরকে ডিসকাউন্ট দিচ্ছে। ফলে আমেরিকান তেল কোম্পানীগুলোর পক্ষে আগের দামে কেনা তেল বর্তমান দামে বিক্রয় করা আত্মহত্যার শামিল, তাই তারা অনেকেই এখন দেউলিয়া হবার পথে। আমেরিকার অর্থনীতি তথা স্টক মার্কেটে তেল কোম্পানীগুলোর প্রভাব সুবিদিত। এদের হয়ে অনেক সিনেটরই নীতি-নির্ধারনী লড়াই করে আমেরিকান রাজনীতিতে। এরা এ'লক্ষ্যে হোয়াইট হাউজকেও চাপের উপরে রাখে। এমনি একজন, নর্থ ডাকোটার সিনেটর কেভিন ক্র্যামার বলেন, আমরা আমাদের তেলের বাজার ধ্বংস করার জন্য সৌদি আরবকে অনুমতি দেইনি। আমাদের 'বন্ধুদেশ' যদি আমাদের স্বার্থ না দেখে, তবে তাদের রক্ষার জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করতে যাবো কোন দুঃখে!?
এসব কারনেই তেল উৎপাদন কমানোর জন্য সৌদি আরবের উপর আমেরিকান চাপ অব্যাহত থাকে। রয়টার্স জানায়, এপ্রিলে সৌদি যুবরাজ সালমানকে হুমকি দিয়ে ট্রাম্প বলে, তোমরা যদি কথা না শোনো, তাহলে সেখান থেকে আমেরিকান ফ্যাসিলিটিজ প্রত্যাহার করা হবে। ফলতঃ এই প্রত্যাহার তারই একটা পদক্ষেপ। এখানে এই অভাবের দিনে আমেরিকার আরেকটা লাভ হওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল। ইরান আর হুতিদের ভয়ে কম্পমান বদমাশ সৌদি যুবরাজ তথা সৌদি প্রশাসন নিজস্ব প্যাট্রিয়ট ব্যাটারীর অর্ডার দিয়ে বসতে পারে! সাথে ঘাটতি পূরনের জন্য অন্যান্য অস্ত্রপাতির ব্যাপার স্যাপার তো আছেই!! সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা আবালীয় রাজতন্ত্রের দেশ সৌদি আরবের আরেকটা বিলিয়ন ডলারের ক্রয়চুক্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র! আপনারা অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন যে, সর্বস্ব নিবেদনকারী প্রমানীত বন্ধুর সাথে আমেরিকার সাপ মারা এবং লাঠি না ভাঙ্গার এই 'ইমোশনাল অত্যাচার' কেন? কারন এটাই যুক্তরাষ্ট্রের নীতি!
একসময়ে শুধুমাত্র ইসরায়েলকে বলা হতো মধ্যপ্রাচ্যের ক্যান্সার…...দুষ্ট ক্ষত। এখন যুক্ত হয়েছে সৌদি আরব। এরা মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোর মধ্যে বর্তমানে একটা ক্যান্সারের মতো। ইন ফ্যাক্ট, মধ্যপ্রাচ্যের বলতে গেলে প্রায় সবক'টা দেশই প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে বর্তমানে ইসরায়েলের মিত্র দেশে পরিনত হয়েছে। তাই আমেরিকার পদ লেহনকারী সৌদি আর তার দোসরদের একটা উচিত শিক্ষার দরকার আছে। ইরানের ইতিহাস বলে, এরা মন্দের ভালো। কারন এরা আগ বাড়িয়ে কারো সাথে যুদ্ধে জড়ায় না, তবে কেউ বেশী মাতবরী করলে উচিত শিক্ষা দিতেও ছাড়ে না। ইরানের আরেকটা ভালো দিক হলো, এরা সৌদি আর তার দোসরদের মতো ফিলিস্তিন জনগনের সাথে বেইমানী করে নাই। আমেরিকা আর ইসরাইলকে পশ্চাদ্দেশ খুলে না দিয়ে বরং এই দুই দেশকে (একটা সন্ত্রাসীর সহায়তাকারী, আরেকটা আপাদমস্তক সন্ত্রাসী) চাপে রেখেছে।
স্বভাবিকভাবেই আমেরিকার এই পদক্ষেপ আন্চলিক প্রভাব বিস্তারে ইরানের জন্য একটা সুবর্ণ সুযোগ। তবে ইরানের পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নে রক্ষনশীল রেভ্যুলেশনারী গার্ড বাহিনী আর উদারপন্থিদের মধ্যে দ্বন্ধ রয়েছে। রেভ্যুলেশনারী গার্ড এখনই পদক্ষেপ নেয়ার পক্ষে, তবে উদারপন্থিরা আমেরিকার আগামী নির্বাচন পযন্ত অপেক্ষা করার পক্ষপাতি। আসল কথা হলো, তাড়াহুড়ার কিছু নাই বরং করোনা আর অর্থনীতির ঝামেলাই এখন সবচেয়ে বড় ঝামেলা!
আমাদের আগের যুগের জমিদারদের কথা সবাই জানেন। তারা জমিদারী হারানোর পরেও ঠাটবাট বজায় রাখার চেষ্টা করতো। কিন্তু আয় না থাকলে ব্যয় কিভাবে হবে? তাই ইজ্জতের উপরে হামলা স্বীকার করে, অভাবের কথা ইনডাইরেক্টলি মেনে নিয়ে একসময়ে তারা টোন ডাউন করতে বাধ্য হয়। পরাক্রম আমেরিকার অবস্থাও অনেকটাই সেইরকমের এখন। হেন করেঙ্গা, তেন করেঙ্গা বাদ দিয়ে তারা এখন তাদের নিজেদের লুঙ্গি সামলাতে ব্যস্ত। যেমন, আফগানিস্থানে তালেবানদের সাথে শান্তিচুক্তি, সিরিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার, ইরাকী পার্লামেন্টের সিদ্ধান্ত অমান্য করে সৈন্য মোতায়েন রেখে এখন প্রত্যাহার করা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তবে সাপ মরার আগেও সুযোগ পেলে একবার ছোবল মারে। করোনার ঝামেলা মিটলে আমেরিকা সেই ছোবল মারবে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়ে। তাতে করে তারা তদের মারনাস্ত্র দু'পক্ষের কাছেই বিক্রি করে নিজেদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার চেষ্টা চালাবে। বলা যায় না, বাংলাদেশ আর মায়ানমারের মধ্যেও যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারে! সাপকে কোন বিশ্বাস নাই।
অতএব…...সাধু সাবধান!!!
ফটো এবং তথ্য ক্রেডিটঃ গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০২০ সকাল ১০:০৭