somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শিশু নির্যাতনঃ ঘরের ভেতরের নির্যাতনের একটা চিত্র!!!

২০ শে অক্টোবর, ২০২০ সকাল ১১:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমাদের ব্লগের একজন অন্যতম জনপ্রিয় ব্লগার, জনাব রাজীব নুর। উনি সব পোষ্টেই কিছু না কিছু মন্তব্য করেন। অভ্যাস খুবই ভালো। তবে মন্তব্যের কোয়ান্টিটি বজায় রাখতে গেলে যা হয়, কোয়ালিটিতে কম্প্রোমাইজ করতেই হয়। তাই বেশীরভাগ সময়েই উনার মন্তব্যের গভীরতা কম। সে যাই হোক, ব্লগার রাজীব নুরের অত্যাশ্চর্য মন্তব্যগুলির ব্যবচ্ছেদ করা আমার এই পোষ্টের উদ্দেশ্য না। গতপরশু উনার একটা মন্তব্যের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে। মন্তব্যটা শিরোনামের ছবিতে দিয়েছি। তবুও আবার দেই, ''যদিও বা আইনের ভয়ে বাইরের নির্যাতন বন্ধ হয়। ঘরের ভেতর যে নির্যাতন হয় সেগুলির কি হবে?''

এক লাইনের ছোট্ট একটা মন্তব্য, কিন্তু অনেক গভীরে এর শেকড়। মন্তব্যটা পড়ে আমার বেশ অনেক বছর আগের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল; আর ঘটনাটা আপনাদেরকে বলতে মন চাইলো। খুবই কম মানুষের সাথেই এটা শেয়ার করেছি আমি। কারনটা পড়লেই বুঝতে পারবেন।

যে সময়টার কথা বলছি, তখন আমি একটা বিশেষ কারনে দু'মাসের জন্য দেশে গিয়েছি। শুক্রবার ছুটির দিন, আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর বাসায় যাচ্ছি। বাসার কাছে গিয়ে কি মনে করে বাসায় আছে কি নাই জানার জন্য ওকে ফোন দিলাম। ও বললো, বাসায় মলি আছে। তুই গিয়ে আড্ডা দে, আমি একটু বাইরে, চলে আসছি। উল্লেখ্য, আমরা বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, বন্ধুদের বউদেরকে ভাবী বলি না। নাম ধরে ডাকি আর তুমি করে বলি। যাই হোক, বাসায় গিয়ে দেখি মলি আর ওদের বছর সাতেকের মেয়ে তানিশা (নাম দু‘টি অবশ্যই কাল্পনিক) ড্রয়িংরুমেই আছে। বছর তিরিশের কাছাকাছি এক যুবকও বসা। পরিচিত হলাম, মলির কাজিন। টেবিলে দেখি অনেক বিস্কিট/চকলেটের প্যাকেট। মেয়ে মায়ের কোল ঘেষে দাড়িয়ে, আর যুবকটা মেয়েকে বলছে, মা তানিশা, দেখো তোমার জন্য কত্তোকিছু এনেছি, আসো আমার কোলে আসো। ছেলেটা যতোই ওকে ডাকে, ও ততোই চোখমুখ শক্ত করে মায়ের কোল ঘেষে দাড়ায়। মলিও বলছে, যাও, মামার কাছে যাও। মেয়ে নিরুত্তর। লোকটা এবার উঠে দাড়িয়ে ওকে কোলে নিতে গেল। সবাইকে হতচকিত করে দিয়ে তানিশা একলাফে ওর মার কোলে চড়ে বসলো, আর সেই সাথে চিৎকার করে কান্না। আমরা সবাই অপ্রস্তুত। এর পরে তো আর কথা আগায় না। অতঃপর দু‘একটা কথা বলে যুবকের প্রস্থান।

মলি কোল থেকে তানিশাকে নামিয়ে দিয়ে বললো, তুমি চাচ্চুর সাথে গল্প করো। আমি চা-নাস্তা বানিয়ে আনছি। এমনিতে তানিশার সাথে আমার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তবে, একটু আগের অভিজ্ঞতার কারনে ভয়ে ভয়ে বললাম; আমি তো তোমার জন্য অনেক কিছু আনি নাই, মাত্র এক প্যাকেট চকলেট এনেছি। চাচ্চুর কাছে আসবে?

পুতুলের মতো মেয়েটা ঘাড় কাৎ করে চোখ মুছতে মুছতে সোফায় আমার পাশে এসে বসলো, আর আমিও এতোক্ষণ টেনশানে আটকে রাখা দম ফেললাম কোনও রকমে। ওকে একহাতে জড়িয়ে ধরে চকলেট দিতে দিতে বললাম, মামার কাছে গেলে না কেন? তোমাকে কত্তো আদর করে। তোমার জন্য কতোকিছু এনেছে!!

ও আমার ঘাড়ের উপর দিয়ে রান্নাঘরে ওর মাকে দেখার চেষ্টা করতে করতে ফিসফিস করে বললো, এই মামাকে না আমার একদম ভালো লাগে না! ওর ভাবভঙ্গি দেখে মলিকে চিৎকার করে বললাম, আমি তানিশাকে নিয়ে বারান্দায় যাচ্ছি, তুমি চা-নাস্তা নিয়ে বারান্দায় আসো। তারপরে তানিশাকে কোলে নিয়ে বারান্দায় গেলাম।

তানিশাকে বললাম, ওই মামাকে তোমার ভালো লাগে না কেন মামনি? তোমাকে তো অনেক আদর করে!

ও আমাকে হতবাক করে দিয়ে আবার ফোপাতে ফোপাতে বললো, জানো চাচ্চু এই মামাটা না আমার এইখানে জোরে কিস করে, বলে ঠোট দেখালো। আমার ব্যাথা লাগে। আর কোথায় কোথায় হাত দেয়!!! আমি বাকরুদ্ধ। ভয়ের চোটে তাড়াতাড়ি ওকে কোল থেকে নামিয়ে দিলাম। এই ধরনের পরিস্থিতিতে এদের এক্সট্রা সেন্সিটিভ হয়ে যাওয়াটা অসম্ভব কিছু না।

এরই মধ্যে মলি চা-নাস্তা নিয়ে এসে আমার গা ঘেষে তানিশাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বললো, এ্যহ্, চাচ্চুর সাথে তো দেখি ঠিকই বারান্দায় এসেছো শয়তান মেয়ে! আর মামার কাছেই যাও না। দিনকে দিন অসামাজিক হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। আসুক আজকে তোর বাবা!!

মলিকে আমি কিছুই বলি নাই। যা বলার আমার বন্ধুকে বলেছিলাম। আর এরপর থেকে বদমাশটার জন্য ওই বাড়ির দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, মলি একজন স্নাতক পাশ শিক্ষিত মেয়ে। তারপরেও সে তার মেয়ের বিষয়টা বোঝে নাই, বা বুঝলেও ততোটা গুরুত্ব দেয় নাই। মেয়েও যে কারনেই হোক, হয়তোবা ভয়ে তার মা‘কে বিষয়টা খোলাখুলি জানায় নাই। আমাকে কেন বললো, সেটাও একটা রহস্য। তবে আমার বন্ধুর কাছ থেকে যতোটা জেনেছি, তানিশা মাকে ওর অপছন্দের কথা বলেছিল, মা সেটা অসামাজিকতা মনে করে উড়িয়ে দেয়ায় ওখানেই ঘটনার সমাপ্তি ঘটে।

ঘরের ভেতরে নির্যাতনের বয়সভেদে বিভিন্ন মাত্রা আছে। প্রাপ্তবয়স্কদের উপর নির্যাতন গোপন রাখা যায় না; কোন না কোন ভাবে একসময়ে বের হয়েই আসে। কিন্তু শিশু নির্যাতন বেশীরভাগ সময়ই লোক-চক্ষুর অন্তরালে থেকে যায়। কোন কোন সময়ে এটা কোনো এক পর্যায়ে প্রকাশ্যে আসলেও বেশীরভাগ সময়েই অনেক দেরী হয়ে যায়……..ফলে করার তেমন কিছুই থাকে না। আমি মনে করি, এ‘ক্ষেত্রে মা‘দের ভূমিকা বেশী গুরুত্বপূর্ণ। কর্মজীবি না হলে, সন্তানদের সাথে উনারাই সবচেয়ে বেশী সময় ব্যয় করেন। আর মা কর্মজীবি হলে দায়বদ্ধতা বাবা-মায়ের সমান সমান। সন্তানদের যে কোনও সমস্যা বা অভিযােগ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত। আর সন্তান ইন্ট্রোভার্ট টাইপের হলে তাদের আচার-আচরণের পরিবর্তন, কথা-বার্তার ধরন আর একাকী থাকার প্রবণতাকে স্বাভাবিকভাবে না নেয়াই ভালো। অন্ততঃ এর পেছনের কারন খতিয়ে দেখা দরকার। এই ধরনের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের করার বহুকিছুই আছে; অবহেলা করার কোন অবকাশ একেবারেই নাই।

গবেষণায় দেখা গিয়েছে, নির্যাতিত শিশুরা সাধারনতঃ রুগ্ন-স্বাস্থ্যের হয়ে থাকে। শিশুদের নিগ্রহের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবগুলির মধ্যে রয়েছে অনেকগুলি অসুস্থতা এবং অক্ষমতা। উচ্চ রক্তচাপ, দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি, অপুষ্টি এবং প্রজনন তন্ত্র এবং প্রসবের সমস্যাগুলি অনেকসময়েই চাইল্ড মলেস্টেশানের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এ‘ছাড়াও নির্যাতিত শিশুদের মনোঃজগতে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটে যায়। যারা সময়ের সাথে সাথে এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা কাটিয়ে উঠতে পারে, তারা ভাগ্যবান। বেশীরভাগেরই সেই সৌভাগ্য হয় না। ফলে বাকী জীবনটাতে সেই শৈশবকালীন দুঃস্বপ্ন তাদের তাড়া করে ফেরে। অনেকে বড় হয়ে নিজেরাও একই ধরনের কাজ করাকে খারাপ মনে করে না। আসলে আমাদের বুঝতে হবে, সব কিছুই গবেষণাতে উঠে আসে না। মানুষের মন অত্যন্ত জটিল একটা জিনিস। কার মন কোন পরিস্থিতিতে কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে…….এটা অনেকসময়, এমনকি সেই মনের অধিকারী মানুষটাও বুঝতে পারে না।

পরিশেষে বলি, অন্যান্য সব নির্যাতনের মতো শিশু নির্যাতনও হয়তো চিরতরে বন্ধ করা সম্ভব না। তবে, সচেতন হলে এটা উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা সম্ভব। শুধু দরকার শিশুদের প্রতি অখন্ড মনোযোগ, তাদের যে কোনও কথাকে উড়িয়ে না দিয়ে সেটার গুরুত্ব দেয়া আর সন্দেহজনক কোন চরিত্রকে বাড়ির কিংবা শিশুর আশেপাশে ভিড়তে না দেয়া।

''ঘরের ভেতরের নির্যাতন'' অত্যন্ত ডাইভার্স একটা বিষয়। আমি শুধু শিশু নির্যাতন নিয়েই বললাম। আর আমি সচেতনভাবেই শুধুমাত্র মেয়ে শিশু নির্যাতন না বলে ''শিশু নির্যাতন'' বলেছি, কারন অনেক ছেলে শিশুও এ'ধরনের ঘরোয়া নির্যাতনের শিকার হয় অহরহ। মেয়ে শিশুদের যৌণ নির্যাতন বিষয়ে একটা অত্যন্ত চমৎকার হিন্দী মুভি আছে। অনেকেই হয়তো দেখেছেন। আলিয়া ভাট আর রণ্দ্বীপ হুডা অভিনীতঃ হাইওয়ে। যারা দেখেন নাই, একবার দেখতে পারেন। পোষ্টটা লেখার সময়ে মুভিটা নিয়ে কিছু বলার জন্য মন আইঢাই করছিল, কিন্তু কিছু বললাম না, যারা দেখেন নাই তাদের জন্য স্পয়লার হয়ে যেতে পারে।

একটা অনুরোধ। বাবা-মা'য়েরা একজন আরেকজনকে সকল সময়ে মনে করিয়ে দিবেন, Did you listen to your child carefully when they told you about any ABUSE? কারন, it’s a saying that, A woman has three greatest enemies: men, another woman, and silence……….!!!! কথাটা কিন্তু সব নির্যাতিতদের জন্যই প্রযোজ্য।

এই ব্লগের অন্যতম সুপারস্টার ব্লগার ;) রাজীব নুরের উল্লেখিত মন্তব্যের সূত্র ধরেই এই পোস্টের সূত্রপাত। সেই চিন্তা থেকেই পোষ্টটা উনাকে উৎসর্গ করা হইলো।

মূল ছবিটা গুগল থেকে নেয়া। ছবির ভিতরের ক্যারিকেচারটা আমারই কাচা হাতের কাজ।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০২০ সকাল ১১:৪৮
৫০টি মন্তব্য ৫০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×