মরক্কোর তান্জিয়ার থেকে আমার মোবাইলে তোলা ছবিটা স্ট্রেইট অফ জিব্রাল্টার বা জিব্রাল্টার প্রণালীর। ওইপাড়ে স্পেন। এই প্রণালী স্পেন আর মরক্কোকে আলাদা করেছে। কিংবা বলা যায়, ইউরোপ মহাদেশ থেকে আফ্রিকা মহাদেশকে আলাদা করেছে আর আটলান্টিক মহাসাগর আর ভু-মধ্য সাগর বা মেডিটেরিয়ান সী কে সংযুক্ত করেছে।
এই মাসের শুরুর দিকের ঘটনা।
এক সকালে আমার অর্ধাঙ্গিনীর সাথে তুমুল ঝগড়া হলো। ঝগড়া হলে সাধারনতঃ আমার কথা বলার সুযোগ থাকে কম। বিশদ পরিসংখ্যান কেমন যেন ভোজবাজীর মতো আমার বউয়ের মানসচক্ষে চলে আসে। সেখান থেকে যুৎসই তথ্য বের করে আমার দিকে একের পর এক তীর ছুড়তে থাকে, আর আমি ঘায়েল হতে থাকি। ঝগড়ার শেষে, ফ্রন্ট যখন শান্ত হয় তখনই মনে পড়ে………. আরে! এই কথাটা তো আমি বলতে পারতাম!! কিন্তু তখন সময় শেষ। টাইম ইজ ওভার। দরকারের সময়ে প্রয়োজনীয় পরিসংখ্যান আমার চোখে ভাসে না, কিন্তু ওর চোখে সবসময়েই কেন ভাসে, এটা ভেবে কোন কূল-কিনারা পাই না। মহান সৃষ্টিকর্তার এ কেমন অবিচার!!!
বিষয়টা খুলেই বলি তাহলে। ওর এক ঘনিষ্ঠজনের বিয়ে। কার্ডিফে। সেই বিয়েতে আমাকে সপরিবারে উপস্থিত থাকতে হবে। এই ধরনের সোশ্যাল গ্যাদারিংয়ে সশরীরে থাকা আমার খুব একটা পছন্দ না হলেও বেশীরভাগ সময়েই যাই কিংবা বলা ভালো, যেতে বাধ্য হই। কিন্তু আলোচ্য বিয়েতে এমন কিছু মানুষ থাকবে, যাদেরকে আমি এক চক্ষেও দেখতে পারি না। কিছু মানুষ আছে না, আশেপাশে থাকলেও গা চুলকায়, সেই রকমের। আমার আবার পছন্দ বা অপছন্দ, দু'টাই খুব তীব্র। আর এসব ক্ষেত্রে আমি পারতে কম্প্রোমাইজ করি না। তো আমি বীর বিক্রমে বলে দিলাম, আমি যেতে পারবো না। তোমরা যাও।
আমার কথা মাটিতে পড়ার আগেই পাল্টা আক্রমন শুরু হয়ে গেল। কয়েকটা নমুনা দেই…….
এমন বদ এবং অথর্ব স্বামী আল্লাহ যেন আর কাউকে না দেয়।
আমার জীবনটা ফানা ফানা হয়ে গেল এই লোকের সাথে থাকতে থাকতে।
এই বদ লোকের জন্য কোন সামাজিকতা করা যায় না। হে আল্লাহ! এমন অসামাজিক জীব আমার কপালেই কেন জুটলো!!…...........ইত্যাদি ইত্যাদি।
সেই সাথে কবে আমার লোকজন,আত্মীয়-স্বজনের জন্য সে কি কি স্যাক্রিফাইস করেছে তার বিশদ বিবরণ!! কই যাবো? একেবারে কোনঠাসা অবস্থা। আপনারা কুকুর-বিড়ালের ঝগড়ার সাথে নিশ্চয়ই পরিচিত! কুকুরের আক্রমনের মুখে বিলাইয়ের ধান্ধা থাকে কোন এক চিপা দিয়া কিভাবে পিঠটান দেয়া যায়। কিন্তু যখন দেখে পালানোর কোন পথ খোলা নাই, তখন ঘুরে দাড়িয়ে ফোস করে উঠে। তো আমিও কোন দিশা-মিশা না পেয়ে ফোস করে উঠলাম। বললাম, যাবো না। যা পারো করো গিয়া! আমারে হাতী দিয়া বাইন্ধাও নিতে পারবা না। ইন ফ্যাক্ট, আমি ওই সময়ে দেশেই (মানে ইংল্যান্ডে আর কি!!) থাকবো না। এইটা আমার অনেক আগের করা প্ল্যান। এইটুকু বলে মহিলা হিটলারকে নব উদ্যোমে আক্রমণের সুযোগ না দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে আসলাম।
আমাদের বাসার কাছে একটা পার্ক আছে। সেখানে আমি প্রায়ই সময় পেলে যাই। কবুতর, কাঠ বিড়ালী আর খরগোশদের সাথে খানা-খাদ্য ভাগাভাগি করে খাই, দুই-চারটা সুখ-দুঃখের কথা শেয়ার করি। আমার ক্রিয়েটিভ কাজ বা কোন পরিকল্পনা ফাইনাল শেইপে আসে প্রধানতঃ তিনটা জায়গায়। টয়লেট, বাথরুম আর এই পার্কে। পার্কে বসে বসে ভাবছি, তেজের চোটে বলে তো আসলাম ইংল্যান্ডেই থাকবো না, কিন্তু দু'দিনের জন্য যাবোটা কোথায়? হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো আইডিয়া খেলে গেল। মরোক্কোর তান্জিয়ারে যাবো। ইয়েস!!!
এই ট্যুর প্ল্যানটা অনেকদিন ধরেই আমার মাথায় ঘুরছে; বরং বলা ভালো সেই বাল্যকাল থেকেই। চমকাবেন না, সত্যিই। সেই যখন স্কুলে পড়ি, তখন থেকে। পরে বিস্তারিত বলবো, আপাততঃ এইটুকুনই থাক। বিভিন্ন কারনে সেটা এতোদিনেও আলোর মুখ না দেখলেও আমার মাথায় একটা যন্ত্রণা হয়েই ছিল এতোদিন। তো, পরিকল্পনাটা মাথায় আসার সাথে সাথে দেরী না করে কাজে নেমে পড়লাম। পার্কে বসেই মোবাইল বের করে প্লেনের টিকেট করলাম। হোটেল বুক করলাম, তারপরে খুশীর চোটে সূর্যের হাসি মার্কা একটা হাসি ঠোটের কোনে ঝুলিয়ে বাসায় ফিরলাম। শনি/রবি সাপ্তাহিক ছুটি; শুধু শুক্রবারটা ছুটি নিতে হবে। সেটা ম্যানেজ করে ফেলবো। কিভাবে করবো, তার একটা টাইট প্ল্যানও করে ফেললাম। তখন কি জানতাম, আমার খুশী দেখে সৃষ্টিকর্তা অলক্ষ্যে বিদ্রুপের হাসি হাসছেন? কে-ই বা জানতো যে, আমার সামনে একগাদা দূর্ভোগ অপেক্ষা করছে!!
চলেন, একে একে আমার সেই দূর্ভোগগুলো আপনাদের সাথে ভাগাভাগি করে হাল্কা হই।
৯ই সেপ্টেম্বর, শুক্রবার দুপুর বারোটা দশ মিনিটে আমার ফ্লাইট। স্ট্যানস্টেড এয়ারপোর্ট থেকে। ন্যাশনাল এক্সপ্রেসের টিকেট করলাম। আমার শহর থেকে কোচ ছাড়বে সকাল ৭:৫০এ। আমার বাসা থেকে বাস স্ট্যান্ড গাড়িতে যেতে লাগে দশ মিনিট। হিসাব করে উবার কল করলাম। দেখালো ৫ মিনিটে চলে আসবে। সেই উবার আসলো ১৫ মিনিট পরে। বাস স্ট্যান্ডে পৌছাতে পৌছাতে আমার চোখের সামনে দিয়ে কোচটা আমাকে না নিয়ে বের হয়ে গেল। আমার তো মাথায় হাত! পরের কোচ প্রায় তিন ঘন্টা পরে। উপায় না দেখে আবার উবার নিলাম এয়ারপোর্ট পর্যন্ত একগাদা টাকা খরচা করে। মনের মধ্যে কেমন যেন একটা কু-ডাক দিল। ডাকটা ঠিকই ছিল। কারন, ভোগান্তির সেটা ছিল শুরু মাত্র।
যাই হোক, তান্জিয়ারে ঠিক-ঠাক মতো পৌছলাম। আফ্রিকা মহাদেশে এটাই আমার প্রথম পদধূলি; ফলে স্বাভাবিকভাবেই খানিকটা এক্সাইটেড! হোটেলে গিয়ে দেখি হোটেল বুকিং একদিনের। আমি করলাম দুইদিনের জন্য, হয়ে আছে একদিন! ঘটনাটা কি? দোষ কি আমার নাকি বুকিং ডট কমের বুঝলাম না। ভরা সিজনে এডভান্স বুকিং না থাকলে কায়দামতো হোটেল পাওয়া মুশকিল; পেলেও ভাড়া অনেক বেশী। কি আর করা! করলাম আরেকটা হোটেল বুকিং আরো একদিনের জন্য। হুদাই খসে গেল আরো কিছু অতিরিক্ত টাকা।
বিশেষ করে যেই স্থান দর্শনে আসা, গিয়ে দেখি সেটা সাময়িকভাবে বন্ধ (আপাততঃ বিষয়টা খোলাসা করছি না।) উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের জন্য। মনকে প্রবোধ দিলাম, ব্যাপারটা ঘ্রানে অর্ধভোজনের মতো হলেও ভোজন তো করতে পারলাম অবশেষে!!!
আড়াই দিনে মরক্কোর তান্জিয়ার শহরটা ভাজা ভাজা করে ফেললাম। ভু-মধ্য সাগর আর আটলান্টিক মহাসাগরের মিলনস্থলে অবস্থিত এই নগরী বেড়ানোর জন্য চমৎকার একটা জায়গা, কোন রকমের সন্দেহ ছাড়াই বলা যায়।
ফেরার দিনে বেশ আগেই এয়ারপোর্ট পৌছে গেলাম কোচ মিসের কথা মনে করে। কিন্তু পোড়া কপাল, ডিপারচার বোর্ডে দেখি আমার ফ্লাইটটাই নাই। এমন ভৌতিক কান্ড কস্মিনকালেও দেখি নাই। ইনফরমেশান ডেস্কে গিয়েও ফ্লাইটের কোন হদিস পেলাম না। আমার ইউকে'র সিম মরক্কোতে কাজ করে না। ব্যবহার করছিলাম লোকাল সিম, সেটা দিয়ে আবার ইন্টারন্যাশনাল কল করা যায় না। ফলে আমার ট্রাভেল এজেন্টকেও কন্টাক্ট করতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত ইমেইল আর মেসেজের মাধ্যমে কন্টাক্ট করতে পারলাম। এয়ারপোর্টে পৌছেছিলাম সকাল সাড়ে ছয়টায়, আর প্রচুর কথোপকথনের পর দুপুর ১২টার সময়ে তারা আমাকে যে ফ্লাইট অফার করলো, সেটা কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য না। এয়ারপোর্টে বসেই নিয়ার-বাই এয়ারপোর্টের লন্ডনগামী ফ্লাইট সার্চ করে যেটা পছন্দ হলো, সেটা ছাড়বে স্পেনের মালাগা এয়ারপোর্ট থেকে রাত ১১:৫০এ। কি আর করা, সেটা ধরাই মনস্থ করলাম।
এইবার নতুন যাত্রা শুরু। তান্জিয়ার এয়ারপোর্ট শহর থেকে বেশ বাইরে। ট্যাক্সি নিয়ে গেলাম তান্জিয়ার ফেরী পোর্টে। সেখান থেকে ফেরী ধরে জিব্রাল্টার প্রণালী পার হয়ে স্পেনের টারিফা। টারিফা থেকে বাসে আলজেসিয়ারাস। সেখান থেকে ডাইরেক্ট কোচ ধরে মালাগা। এখানে বলে রাখি, রাতের ফ্লাইট তখনও কনফার্ম করি নাই, পাছে এই দীর্ঘ যাত্রায় আবার কোন ফ্যাসাদে পড়ি সেই ভয়ে। কোচ ছাড়লো, নিশ্চিত হলাম যে সময় মতো মালাগা পৌছাতে পারবো। চলন্ত কোন কিছুতে আমি পড়া বা মোবাইল টেপাটিপি করতে পারি না, মাথা ঘোরানো শুরু হয়, আর সেটা শেষ হয় বমি দিয়ে; কিন্তু উপায় না থাকায় কোচে বসেই টিকেট প্রসেসিং শুরু করলাম। শেষে যা হওয়ার তাই হলো। একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ ভরে ফেললাম বমি করে!! মরক্কোর খাবার সব উগরে দিলাম স্পেনে!!!
বমি করে যখন নেতিয়ে পড়েছি, তখন আমাদের কোচটা থেমে গেল। শো আসলে তখনও বাকী ছিল; কোচ থেমে যাওয়ার কারন ছিল যান্ত্রিক গোলযোগ। শেষ পর্যন্ত রিকোভারী কল করে অল্টারনেটিভ কোচ দিয়ে মালাগা পৌছলাম।
ক্লান্ত, বিধ্বস্ত এবং পর্যদুস্ত আমি যখন কোচ থেকে নেমে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে এয়ারপোর্টে পৌছলাম, ঘড়িতে তখন জ্বলজ্বল করছে রাত সাড়ে এগারোটা। ফ্লাইট মিস সুনিশ্চিত!!!
আবার ফ্লাইট খোজাখুজি। শেষ পর্যন্ত যেটা পছন্দ হলো, সেটা সকাল সাড়ে নয়টায়। শরীর একেবারেই আর চলতে চাইছিল না, কোন এক সফেদ বিছানা আমাকে যেন মোহনীয় স্বরে ডাকছিল……..আয়! আয়!! তারপরেও হোটেলে যাওয়ার রিস্ক নিলাম না। এককাপ কড়া করে কফি বিড়ি সহযোগে মেরে দিয়ে এলার্ম সেট করে এয়ারপোর্টেরই এক বেঞ্চে লম্বা হলাম।
আমি বলতে গেলে সারাটা জীবনই ঘুরে বেড়িয়েছি; দেশে-বিদেশে যখন যেভাবে পেরেছি। তবে একটা নির্দিষ্ট ট্যুরে গিয়ে এই পরিমান দূর্ভোগের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা আমার জীবনে এই প্রথম। আপনাদেরকে সবটা বললাম না, লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে। আরো কিছু ছোট-মাঝারী দূর্ভোগ ফেইস করতে হয়েছে এই যাত্রায়। ট্যুরটাতে যেমন টাকার শ্রাদ্ধ হয়েছে অজস্র, তেমনি সময়ের অপচয়ও হয়েছে; প্রচুর ঝামেলার শিকারও হয়েছি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আনন্দও করেছি প্রচুর। আর আপনারা তো জানেনই, ট্যাকা আমার কাছে ত্যাজপাতা! কাজেই ওইদিক দিয়ে নো টেনশান!! সর্বোপরি ....... নতুন দেশ, নতুন সংস্কৃতি আর ভিন্ন স্বাদের খানাদানার সাথে নতুন মহাদেশের ভ্রমনটা সার্থকই বলা যায় এক প্রকারের।
যাই হোক, বাসায় ফিরে সবকিছু বউয়ের কাছে সবিস্তারে বর্ণনা করে বললাম, তুমি কি আজকাল কালা যাদু জাতীয় কিছুর প্র্যাক্টিস করছো নাকি? তোমার সাথে ঝগড়া করে বের হয়েছিলাম, মানছি। কিন্তু তোমার বদদোয়া না করে দোয়া করা উচিত ছিল। তাহলে আমার ভোগান্তি কিছুটা হলেও কমতো! একজন নিরীহ গোবেচারা স্বামীর প্রতি স্ত্রীর এমন ব্যবহার কিন্তু আল্লাহপাক সহ্য করবে না।
সে মুখে একটা অর্থপূর্ণ হাসির ঝিলিক দেখিয়ে বললো, বদ মানুষের জন্য দোয়া করলে সেটা অনেক সময়ে বদ দোয়া হয়ে যায়!!!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ সকাল ১১:৩০