একটা বিষয়ে কেউ সম্ভবতঃ দ্বি-মত পোষণ করবেন না যে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আওয়ামী লীগ ছিল একমাত্র নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল। স্বাধীনতার পরে বেশ কয়েকটা রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ঘটে যার সবকটাই ছিল প্রধানতঃ বাম ঘরানার। কিন্তু সেগুলো ঠিকমতো প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই শেখ মুজিবুর রহমান একদলীয় শাসনব্যবস্থা 'বাকশাল' কায়েম করেন। বুঝতেই পারছেন, একদলীয় শাসনব্যবস্থায় আর কোন দলের কোন রকমের কার্যক্রম পরিচালনার উপায় ছিল না। এভাবেই একটা সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে প্রথমবারের মতো গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানো হয়।
এই বাকশাল সফল হতো, নাকি বিফল; সেই এসিড টেস্টের আগেই '৭৫ এর পট-পরিবর্তন ঘটে যায়। পরবর্তী বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন এবং বহুদলীয় রাজনীতি চালুর মাধ্যমে দেশে আবার গণতন্ত্রায়নের উদ্যোগ নেন। এর ফলেই আওয়ামী লীগ এবং সেই সাথে জামায়াতে ইসলামীও দেশে রাজনীতি করার সুযোগ লাভ করে।
আমি এতোক্ষণ অতি সংক্ষেপে জিয়াউর রহমানের রেইজিম পর্যন্ত বাংলাদেশের গণতন্ত্রের উত্থান-পতনের সার-সংক্ষেপ তুলে ধরলাম। এরপরেও গণতন্ত্র নিয়ে বিভিন্ন শাসকের রাজত্বকালে বিভিন্ন লেভেলের খেলা আমরা দেখেছি, সেগুলো আপাততঃ আলোচনার বিষয়বস্তু না। আমি জানি এসব বিষয় ব্লগারগন সবাই কম-বেশি জানেন; তারপরেও বললাম। খানিকটা রিমাইন্ড করাই মূল উদ্দেশ্য। কারন, এরপরে যেই আলোচনাটা করবো তার জন্য এইটুকু গ্রাউন্ড ওয়ার্কের দরকার আছে।
আমাদের দেশে সাধারনভাবে যেই রাজনীতি প্রচলিত, সেটা হলো ধান্ধাবাজি আর অসহিষ্ণুতার রাজনীতি। কিভাবে? মনে হয়না এটা নিয়ে কিছু বলার প্রয়োজন আছে। প্রতিটা সরকার যখনই ক্ষমতায় এসেছে, চেয়েছে যেন-তেনভাবে ক্ষমতায় থেকে যেতে। সেইজন্য বিভিন্ন রকমের ছলাকলা তারা করেছে, বিরোধীদের উপর চালিয়েছে দমন-পীড়ন। তবে এর মধ্যে সবচাইতে বড় খেলোয়াড় ছিল আওয়ামী লীগ। তারা সব সময়েই প্রচার করেছে যে, তারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি। অথচ যখনই প্রয়োজন হয়েছে স্বাধীনতার তৎকালীন বিপক্ষ শক্তি জামায়াতে ইসলামীর সাথে আতাত করেছে। আবার যখন প্রয়োজন ফুরিয়েছে, তাদেরকে ছুড়ে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দন্ড উচিয়ে ধরেছে। এসবই হলো একটা জন-বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক দলের কাজ; জনপ্রিয় হলে এগুলোর প্রয়োজন পড়ে না।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রতিটা নাগরিক তার পছন্দ / অপছন্দ অনুসারে মত প্রকাশের অধিকার রাখে। আবার একই সঙ্গে যে কোনও রাজনৈতিক দল করার কিংবা সমর্থন করারও অধিকার রাখে, যদি না সেটা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যায়। কিন্তু গতমাসে দেখা গেল ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি আখ্যা দিয়ে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো। এটা কি তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত করার জন্য করেছিল? তাহলে প্রশ্ন উঠে এতোদিন করে নাই কেন? আসলে এটা তারা করেছিল ধান্ধাবাজির কারনে।
এখন কথা হলো, ১৯৭১ এর দেশ বিরোধী পাকিপন্থী কর্মকান্ডের কারনে জামায়াত যদি ২০২৪ এ এসে নিষিদ্ধ হয় তাহলে ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ২০২৪ এ এসে ''ভারতের কাছে দেশ বিক্রি'' সংক্রান্ত দেশ বিরোধী কর্মকান্ডের জন্য কেন নিষিদ্ধ হবে না? আসেন, বিষয়টাকে আরেকটু খোলাসা করে দেখি।
''জ্ঞানপাপী'' বলে একটা নেতিবাচক শব্দ প্রচলিত আছে। এর মানে হলো ''জেনেশুনে অন্যায় করে এমন ব্যক্তি''। সামান্য ব্যাখ্যায় যদি যাই তাহলে বলতে হয়, একজন সৎ কিন্তু মূর্খের চাইতে একজন অসৎ কিন্তু জ্ঞানী পরিত্যজ্য। কথা হলো, জামায়াতের মতো একটা দল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী কাজ করলে মেনে নেয়া যায়, কারন তাদের কাছে আমাদের কোন প্রত্যাশা নাই। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো একটা দল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী কাজ করলে মেনে নেয়া যায় না। কারন, তাদের কাছে আমাদের উচ্চমাত্রার প্রত্যাশা রয়েছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারা আমাদের সেই প্রত্যাশা পূরণের ধারে কাছে দিয়ে হাটে নাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দন্ড উচিয়ে ধরা দলটা গত ৫৩ বছরে যখনই সুযোগ পেয়েছে.........হত্যা, খুন, গুম, ধর্ষণ, দূর্ণীতি, লুটপাট, অরাজকতা সৃষ্টিসহ হেন কোন কুকর্ম নাই, যেটা তারা করে নাই। পক্ষান্তরে জামায়াত তেমন কোন সুযোগ না পেলেও যতোটুকু পেয়েছে, তাদের কর্মকান্ড দিয়ে সাধারন জনগনের মধ্যে ঘৃণা উৎপাদন করে নাই। ফলে, আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত এবং প্রচারিত জামায়াত জুজুর তেমন কোন ভিত্তি প্রতিষ্ঠা পায় নাই। একই কথা প্রযোজ্য আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ আর জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের জন্য। ফলে এখন প্রশ্ন উঠছে, গত ৫৩ বছরে আওয়ামী লীগ ক্রমাগত জাতিকে বিভক্তির যে রাজনীতি চালিয়ে এসেছে, সেটাকে আরো চলতে দেয়া যায় কি না। দেশ এখন যেই ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে সেখানে জুজুর ভয়ের চাইতে চিহ্নিত আর প্রমাণিত ক্রিমিনালরাই অধিকতর ভয়াবহ। নয় কি?
আমাদের সেনাপ্রধানকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। উনি জাতিকে বিভক্ত করার দিকে না গিয়ে তথাকথিত নিষিদ্ধ জামায়াতসহ সব দলের নেতাদের সাথেই বসেছেন। ''তথাকথিত নিষিদ্ধ'' বললাম এই কারনে যে, একটা স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট অবৈধ সরকারের নেয়া কোন বিভক্তিমূলক পদক্ষেপই এখন আর বৈধ না। আজ ২০২৪ এ এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ১৯৭১ এ জামায়াত যেই কাজ করে ঘৃণিত হয়েছিল, সেই একই কাজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী দলটা অবলীলায় চালিয়ে গিয়েছে। এই সংক্রান্ত সব রকমের প্রতিবাদকে তারা বিভিন্ন ধরনের কালা-কানুন দিয়ে প্রতিহত করেছে। তারপরেও যখন পারে নাই, আবরারের মতো হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে।
শেখ হাসিনার শেষ মুহুর্তের যেসব খবর সামনে আসছে, তা এক কথায় ভয়াবহ। সে ক্ষমতায় থাকার জন্য বাহিনীগুলোকে আরো কঠোর হওয়ার, আরো রক্তপাত ঘটানোর জন্য চাপ দিচ্ছিলো। মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমত যে আমাদের বাহিনীগুলোতে এখনও সুস্থ মস্তিষ্কের দেশ প্রেমিক মানুষের পরিমান বেশী। ফলে ওই সময়ে তাদের যথাযথ এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারনে একটা শীতল রক্তের রক্তপিপাসু উন্মাদের এই হত্যাকান্ড চালিয়ে যাওয়ার বাসনা রুখতে পারা সম্ভব হয়েছে............না হলে কি হতো চিন্তা করলেও গা শিউরে ওঠে!!!
যাই হোক, সিরিয়াল কিলার সাইকো হাসিনা বিদায় নিয়েছে। এখন সবাই মিলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পালা। এই যাত্রায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যথাযথ সময় দিতে হবে। কারন, আরেকটা নির্বাচন দিয়ে আরেক স্বৈরাচারের আসার পথ করে দেয়াই এই সরকারের একমাত্র কাজ না। এই সরকারের প্রধান কাজ হবে আগে প্রয়োজনীয় রিফর্ম করে আরেক স্বৈরাচারের আসার পথ রুদ্ধ করা। তারপরে পরিস্থিতি বুঝে নির্বাচন দেয়া। আর আমাদের সবার দায়িত্ব হবে যার যার অবস্থান থেকে সরকারকে সহায়তা প্রদান করা।
মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে এখন একটাই প্রার্থনা...........কোন ধরনের অপশক্তিই যেন এই দেশটার অগ্রযাত্রার পথে আর কোন ধরনের বাধার সৃষ্টি না করতে পারে। ছাত্র-জনতার এই বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।
ছবিসূত্র।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০২৪ ভোর ৪:১০