
''হীরক রাজার দেশে'' মুভিটা দেখেন নাই, এমন মানুষ বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠিতে খুজে পাওয়া খুবই দুষ্কর। সত্যজিৎ রায়ের এই মুভিটা বাংলা মুভির ইতিহাসে একটা মাইলফলক। বর্তমান বিশ্বে এখনও এর বিষয়বস্তু আর বিভিন্ন সংলাপ, গান প্রচন্ডভাবে প্রাসঙ্গিক। দিনে দিনে বয়স কম হলো না, তারপরেও দুনিয়ার রঙ্গ দেখতে বিরক্ত লাগে না। বড়ই আমোদিত হই। যখনই আমোদিত হই, সর্বাগ্রে এই গানটা মনের অজান্তেই গুন গুন করে গাই। দারুন একটা গান!!!
স্থান-কাল-পাত্রভেদে দেশ-বিদেশের এমনই বেশ কিছু রঙ্গ কয়েকটা দিন ধরে মাথায় ঘুরছে। আপনাদের সাথে কিঞ্চিৎ ভাগাভাগি করার লোভ সামলাতে পারছি না।
পশ্চিমা বিশ্বের গুনগান করতে গিয়ে এই ব্লগেই অনেকে আবেগে কাইন্দালান। এরা সভ্য, গুনে-মানে উন্নত; গনতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার ধ্বজাধারী........ইত্যাদি ইত্যাদি বহুরকমের বাকোয়াজ। একটা উদাহরন দেই। ২০২১ সালের অগাষ্টে একটা পোষ্ট দিয়েছিলাম, আস্তিকতা, নাস্তিকতা এবং বাক-স্বাধীনতা শিরোনামে। সেখানে লিখেছিলাম, ফ্রান্সের শার্লী এবদো ম্যাগাজিন যখন মহানবী (সাঃ) এর ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন প্রকাশ করে, তখন সারা দুনিয়ার মুসলমানরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এটা নিয়ে জল কম ঘোলা হয় নাই। কিন্তু ফরাসী প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রন তখন কারো বাক-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যাবে না, এই যুক্তি দেখিয়ে এই ম্যাগাজিনের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয় নাই। ব্লগেও নাস্তিক আর ছদ্ম-মুসলমানরা ফরাসী সরকারের এই মনোভাবের প্রশংসা করে আর মুসলমানদের উগ্রতার নিন্দা করে পোষ্টের পর পোষ্ট আপলোড করতে থাকে। ক'দিন আগের খবর। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট একটি বিলবোর্ড মালিকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করছেন যিনি তাকে কোভিড -১ বিধিনিষেধের প্রতিবাদে অ্যাডলফ হিটলার হিসাবে চিত্রিত করেছিলেন। এই ব্যাপারে সেই বিলবোর্ড মালিক Michel-Ange Flori এর প্রতিক্রিয়া হলো, ''In Macronia you can make fun of the prophet's ass, that's satire, but to make the president look like a dictator is blasphemy.'' ব্লগের সেইসব অত্যুৎসাহী ব্লগাররা এখন এই বিষয়ে নীরব কারন তাদের কাছে বাক-স্বাধীনতার সংজ্ঞা ব্যক্তিবিশেষের উপর নির্ভরশীল।
মজার না বিষয়টা?
আর আমাদের সবার প্রিয় আম্রিকার ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের কথা বলে তো শেষ করা যাবে না। এরা নিত্য-নতুন রঙ্গের উপাদান পৃথিবীর ইতিহাসে যোগ করছে প্রতিনিয়ত। সেটা মানবতা, গনতন্ত্র, সন্ত্রাসবাদ, ইসলামোফোবসহ যাই হোক না কেন!!! নিজেদের স্বার্থে তারা যে কোনও সংজ্ঞাই পাল্টে ফেলে রাতারাতি।
আচ্ছা, বাদ দেন আম্রিকা তথা পশ্চিমা বিশ্বের কথা। আমাদের পাশের দেশ বিশ্ব মোড়লের দাবীদার ভারতের কথায় আসি। চিন্ময় মহারাজকে ইসকন থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল শিশু নির্যাতনের জন্য। তার জন্য ভারত কেদে কেটে নাকের পানি, চোখের পানি এক করে ফেলেছে; সেটাকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের তকমা দিচ্ছে। তাকে নাকি বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়েছে। অথচ ২০২২ এর কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভের হিসাবে ভারতে ৩ লক্ষ ৭২ হাজার বন্দী আছে বিনা বিচারে। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০২০ এর ফেব্রুয়ারী মাসে দিল্লীতে এক ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল। সেই দাঙ্গার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিল গুলফিসা ফাতিমা, মীরন হায়দার, আতাহার খান,খালিদ সাইফি, উমর খালিদ প্রমুখসহ আরো অনেক মুসলমান। এর মধ্যে খালেদ উমর ডক্টরেট করা, মোদির মতো আগে মাস্টার্স করে পরে গ্র্যাজুয়েট করে নাই!!!! এদের কারো বিচারের শুনানিই শুরু হয় নাই এখনও। এরা কোন মুখে আমাদের দেশের ব্যাপারে কথা বলে? মানব শরীরের যে কোনও ছিদ্র কিংবা গর্ত দিয়ে আওয়াজ বেরুলেই তাকে ''কথা বলা'' বলে না, জানেন নিশ্চয়ই!!!
ভারত-বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের আরো কিছু তুলনামূলক রঙ্গচিত্র তুলে ধরি। বাংলাদেশে ২৮ থেকে ৩০ শতাংশ হিন্দু (মোট জন সংখ্যার ৮-৯ শতাংশ) যারা সরকারী চাকুরে। আর ভারতে ৩ শতাংশ মুসলমান (মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ) সরকারী চাকুরীতে আছে। তাছাড়া আযান দেয়ার জন্য দুই লক্ষ টাকা জরিমানা, পুলিশ কর্তৃক সেজদারত মুসল্লীর পেছনে লাথি মারা, গো-মাংস রাখার, বহনের বা ভক্ষণের সন্দেহে মুসলমানদের পিটিয়ে মেরে ফেলা........এসব তো ভারতে অহরহ ঘটছে। আর তারা আসে আমাদের দেশের হিন্দুদের ব্যাপারে সবক দিতে। আমরা বাংলাদেশের হিন্দুদেরকে বাংলাদেশী হিসাবে দেখি, সংখ্যালঘু হিসাবে না। কাজেই পাঠার দল রঙ্গ করতে থাকুক। হু কেয়ার্স!!! নিজের দেশের খবর নাই, বাংলাদেশের চিন্তায় ঘুম নাই!!! লজ্জাও করে না ওদের, সংখ্যালঘু নিয়ে কথা বলতে!!!!
কানাডার ভূমিকে ব্যবহার করে খালিস্তানপন্থীরা ভারত বিরোধী কাজ করছে, সেটা নিয়ে ভারত সোচ্চার। খুনী পাঠিয়ে খালিস্তানপন্থী এক নেতাকে সেখানে খুন করা হয়েছে। দাউদ পাকিস্তানে বসে ভারত বিরোধী কাজ করছে। সেটা নিয়েও ভারতের মাথাব্যথা। আর হাসিনাকে তার বাকীসব পলাতক সাঙ্গপাঙ্গসহ আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণার কাজে সহায়তা করছে। আবার জয়শঙ্কর বলে কিনা, ''বাংলাদেশকেই ঠিক করতে হবে, তারা কেমন সম্পর্ক চায়''। পুরাই আবাল একটা!!!
আসেন, এইবার তাদের অন্যতম একটা ইন্টারেস্টিং রঙ্গ নিয়ে কিছুক্ষণ কচলা-কচলি করি। আপনারা কি জানেন, ভারত বিশ্বের সবচাইতে বড় গো-মাংস রফতানীকারক দেশ? একটা পরিসংখ্যান দেই........২০১৫ সালে ভারত ১৪ লক্ষ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন গো-মাংস রফতানী করে। কতোগুলো ''মাতা'' হত্যা করলে এই পরিমান মাংস হয়? গো-মাংস রফতানী করে ভারত বছরে গড়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকা আয় করে। এই রফতানী কিন্তু প্রতি বছর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটার একটা গালভরা নামও তারা দিয়েছে; Pink Revolution বা গোলাপী বিপ্লব। বলাই বাহুল্য, তাদের মাতার মাংসের গোলাপী রং থেকেই এই নামের উৎপত্তি!!! এর একটা বড় অংশই যায় মধ্যপ্রাচ্যে হালাল সীলমোহর নিয়ে। এই রফতানী যেসব বড় বড় প্রতিষ্ঠান করে, তাদের মোটামুটি সবার মালিক হিন্দু। আরো রঙ্গের বিষয় হলো, এই দুষ্কর্মের জন্য দায়ী অন্যতম বৃহৎ দু'টা প্রতিষ্ঠান গো-রক্ষার সবচাইতে বড় ধ্বজাধারী যোগী আদিত্যনাথের উত্তর প্রদেশে, যেখানে গো-হত্যা সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ। এর একটি হলো AOV Exports Pvt. Ltd. যার মালিক ওম প্রকাশ অরোরা আর Standard Frozen Foods Exports Limited যার সুযোগ্য মালিক কমলকান্ত ভার্মা। আমি দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছি, এই পর্যন্ত পড়েই আপনাদের অনেকের সবগুলো দাত বের হয়ে গিয়েছে। হওয়ারই কথা, কারন এই লেভেলের রঙ্গ একমাত্র মহান ভারতেই সম্ভব!!!!
দেখলেন তো, গো-মাতা নিয়ে তাদের কতো রঙ্গ-তামাশা? কোন সীমা-পরিসীমা আছে কি? নাই.........একেবারেই নাই। সেইসাথে এদের হায়া-শরমও নাই। অবশ্য মায়ের গোশত বেচে খাওয়ার মতো রঙ্গ যারা করতে পারে, তাদের কাছ থেকে এর চাইতে বেশী কিছু আশা করাও দুরাশা!!! আমার প্রয়াত নানী অনেক মজার মজার উপমা দিতেন। 'চালুন সুইরে বলে, ওই তোর পাছায় ফুটা'.......এটা প্রথম উনার কাছ থেকেই শোনা। নানী বেচে থাকলে আজ চালুন নামের মোদির ভারতকে এই কথাই বলতেন নিঃসন্দেহে।
ইউরোপ-আম্রিকা আর মহান ভারতের রঙ্গের উপর খানিকটা আলোকপাত করলাম। এইবার দেশের দিকে নজর দেয়া যাক। দেশের সবকিছু ছাপিয়ে এখন আমার মনে দুইটা বিষয় খেলা করছে। প্রথমটা বলি, আমাদের শ্বশুরালয়ে হিজরত করা প্রাণপ্রিয় আপা তার সর্বশেষ অনলাইন ভাষণে জানতে চেয়েছেন, ''আমার কি অপরাধ!! আমার অপরাধটা কি, আমি জানতে চাই!!!'' এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে কেউ আমারে মাইরালায় না ক্যান?? হাসির দমকে কিছু বলতে পারছি না। আপনারা কেউ পারলে উনারে জানায়েন যে, উনার কি অপরাধ!!!!
আর দ্বিতীয় বিষয়টা আমাদের সেনাপ্রধানকে নিয়ে হলেও বিস্তারিত কিছু বলতে চাই না। উনার নামে যেসকল অভিযোগ বাজারে প্রচলিত আছে তার কোন যথাযথ এবং গ্রহনযোগ্য উত্তর না দিয়ে উনি দিচ্ছেন হুমকি-ধামকি। মানুষ এখন অনেক সচেতন, তারা এইসব রঙ্গ আর খায় না। উনার উচিত ঝেড়ে কাশা।
অনেক রঙ্গ আলাপ করলাম। তবে আমাদের এই ব্লগ নিয়ে যদি কিছু না বলি, তাহলে আমার এই আলাপটা পূর্ণতাই পায় না। পোষ্ট বড় হয়ে যাচ্ছে, তাই এই নিয়েও বিস্তারিত বলতে চাই না। শুধু বলি, বাক-স্বাধীনতার নামে এখানে মহানবী (সাঃ)কে ''মরুভূমির ডাকাত'' বলা যায়, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুসকে ''চোর'' বলা যায়, ২৪এর আন্দোলনের সমর্থক তথা অংশগ্রহনকারীদের ''বান্দীর পুত'' বলা যায়। শুধু দেশনেত্রী, জনদরদী আর মানবতার ফেরীওয়ালা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ''পতিতা স্বৈরাচার'' বলা যায় না। সাব্বাশ!!!
ছবিসূত্রঃ https://www.freepik.com/free-ai-image/
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ দুপুর ২:০৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


