অনলাইনে নানা কাজে আমরা সময় ব্যয় করি। আসুন, কিছুটা সময় ব্যয় করি ওয়েবের দুনিয়ার অন্য ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার যোগাযোগকে সমৃদ্ধ করতে। প্রতিদিন কিছুটা সময় বাংলা অনুবাদের মান উন্নয়নে ব্যয় করলে আমরা অল্প সময়ের মধ্যে মানসম্মত অনুবাদ পাব। আসুন, আমাদের ভাষা আমরাই সাজাই।
গুগল ট্রান্সলেশন সার্ভিসে যুক্ত হয়েছে আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা। গুগল বাংলা ট্রান্সলেশন সার্ভিসের আলফা ভার্সন শুরু হয়েছে গত ২১ জুন। গুগল ট্রান্সলেটর (ঃৎধহংষধঃব.মড়ড়মষব.পড়স) যাত্রা শুরু করেছিল ২০০৬ সালের ২৮ এপ্রিল। আরবি থেকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল গুগলের ট্রান্সলেশনের সার্ভিস। তারপর একে একে যোগ হয় অন্যান্য ভাষা। ২০০৭ সালের অক্টোবর নাগাদ ২৫টি ভাষার অনুবাদ শুরু হয়। এতদিন গুগল ট্রান্সলেশনের ভাষা সংখ্যা ছিল ৫৮। সর্বশেষ ২৩ জুন ৫টি নতুন ভাষা যুক্ত হওয়ায় মোট ভাষা সংখ্যা হয়েছে ৬৩।
গুগল ট্রান্সলেশন সার্ভিসে বাংলা যুক্ত হওয়ার কারণে ওয়েবে অন্য আরও ৬২টি ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার যোগাযোগ প্রক্রিয়া শুরু হলো। এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে আমরা বাংলা ভাষাকে অনলাইনে ছড়িয়ে দিতে পারব। গুগল ট্রান্সলেশনে বাংলা ভাষা যুক্ত হওয়া মানে কেবল ইংরেজি থেকে বাংলা ও বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদ নয়। গুগল ট্রান্সলেশন সার্ভিসের বাকি ভাষাগুলোর সঙ্গেও বাংলা ভাষার যোগাযোগ প্রক্রিয়াকে সহজলভ্য করতে হবে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন প্রবাসী বাঙালিরা। যেমন যিনি জাপানে থাকেন তিনি জাপানিজ ভাষা থেকে বাংলা ও বাংলা থেকে জাপানিজ ভাষার অনুবাদের মান উন্নয়নে কাজ করতে পারেন। অন্যদিকে যিনি জার্মানিতে থাকছেন তিনি পারবেন জার্মান ও বাংলা ভাষার যোগাযোগকে সংহত করতে। গুগল ট্রান্সলেশনে বাংলা অনুবাদ মানসম্মত হলে আমাদের জন্য তা নানাভাবে সুবিধাজনক হবে। অন্যান্য ভাষার ওয়েবসাইট এবং ওয়েব কনটেন্ট আমরা বাংলায় দেখতে পারব। বর্তমানে অনেক বাংলাদেশি সাইটকে বাংলা ও ইংরেজি আলাদা আলাদা সংস্করণ রাখতে হচ্ছে। গুগল বাংলা অনুবাদের মান ভালো হলে আলাদা করে সংস্করণ রাখার দরকার পড়বে না।
কেউ কেউ আবার এরই মধ্যে অভিযোগ তুলেছেন, সরকারি পর্যায় থেকে কেন এই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলো না। একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, এই ধরনের মেশিন অনুবাদ কাজে অনেক প্যারাট্রান্সলেশন ডকুমেন্ট দরকার। সরকারি পর্যায় থেকে এতগুলো ভাষার সঙ্গে বাংলার যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয়তো কষ্টসাধ্য ব্যাপার হতো। এর আগেও একজন বাঙালি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদের একটি অনলাইন অনুবাদক সফটওয়্যার তৈরি করেছিল। সেটি খুব বেশি সফল হয়নি প্যারাট্রান্সলেশনের অভাবের কারণে। এবার যেহেতু গুগল একটি উদ্যোগ নিয়েছে আমাদের সেই উদ্যোগে অংশ নিয়ে ওয়েবে বাংলা ভাষার প্রসার ঘটানো উচিত।
ইংরেজি ভাষার গঠনশৈলীর তুলনায় বাংলা ভাষার গঠনশৈলী অনেক ভিন্ন। বাংলা ভাষা যেখানে সাবজেক্ট-অবজেক্ট-ভার্ব (এসওভি) অর্ডার মেনে চলে, সেখানে ইংরেজি ভাষা মেনে চলে সাবজেক্ট-ভার্ব-অবজেক্ট অর্ডার। ফলে বাংলা ভাষায় ট্রান্সলেশন সার্ভিস চালু করা গুগলের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল। তবে আশার কথা, জাপানিজ ভাষাও বাংলার মতো এসওভি অর্ডার মেনে চলে এবং জাপানিজ ভাষা নিয়ে গুগলের গবেষকদের কাজ বাংলা ভাষার অনুবাদের ক্ষেত্রেও কাজে লাগবে। জাপানিজ ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদের কাজ শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালের দিকে। বর্তমানে অনুবাদের মান বেশ ভালো। এই মানই আমাদের আশান্বিত করে তোলে। ইংরেজি থেকে জাপানিজ অনুবাদের মান ভালো হলে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও তা সম্ভব।
বাংলায় গুগল অনুবাদের মান এখনও তেমন ভালো নয়। অনুবাদ উল্টাপাল্টা হচ্ছে। যেহেতু গুগল স্ট্যাটিসটিক্যাল মেশিন ট্রান্সলেশন পদ্ধতি অনুসরণ করে তাই একটি বাক্যের একদমই ভিন্ন একটি অনুবাদ আসতে পারে। অনেকেই ভুল অনুবাদের জন্য গুগলকে দোষারোপ করছেন। এভাবে কেবল দোষারোপ করে গেলে কাঙ্ক্ষিত মানের অনুবাদ প্রাপ্তি দীর্ঘায়িত হবে। আমরা বাংলা ভাষাভাষী ব্যবহারকারীরা গুগলের বাংলা অনুবাদের মান বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারি। ব্যবহারকারীরা যাতে অনুবাদের মান উন্নয়নে সহায়তা করতে পারেন সে পথ খোলা রেখেছে গুগল। গুগল ট্রান্সলেশন ব্যবহার করে অনুবাদ করলে দুই ধরনের ভুল অনুবাদ হতে পারে। এক. বাক্যের অর্থ ভুল আসা, দুই. বাক্যের গঠন ঠিক না হওয়া। অনুবাদ ঠিক করার জন্য দু'ভাবে সাহায্য করা সম্ভব। প্রথমত, বাক্যের অর্থ ঠিকমতো না হলে সঠিক অর্থ করে দেওয়ার মাধ্যমে সহায়তা করা সম্ভব। অনুবাদকৃত বাক্যের শব্দগুলোর ওপর কার্সর রাখলে হলুদ দেখাবে। তাতে ক্লিক করলে বিকল্প শব্দের প্রস্তাব আসবে। বিকল্প শব্দ পছন্দ না হলে নতুন করে শব্দ দেওয়া যাবে। দ্বিতীয়ত, বাক্যের গঠন ঠিকমতো না হলে তা ঠিক করে দেওয়ার মাধ্যমে সহায়তা করা সম্ভব। বাক্যে শব্দের বিন্যাস ঠিক করতে হলে 'শিফট' কি চেপে ধরে যে কোনো একটি শব্দ নির্বাচন করুন, তারপর তা টেনে সঠিক স্থানে বসিয়ে দিন। তাহলেই বাক্যের বিন্যাস ঠিক হয়ে যাবে। আপনার ঠিক করা অনুবাদ গুগল ট্রান্সলেটর স্বয়ংক্রিয়ভাবে মনে রাখবে। পরবর্তী সময়ে ব্যবহারকারীরা সঠিক অনুবাদ দেখতে পারবেন। তবে অনেক সময় সঙ্গে সঙ্গে সঠিক অনুবাদ কাজ না-ও করতে পারে। কারণ গুগল ট্রান্সলেটরের সফটওয়্যার ব্যবহারকারীদের করা অনুবাদ মনে রাখে। পরে সময় নিয়ে সঠিকভাবে উপস্থাপন করে থাকে। অনুবাদ ঠিক করার জন্য একটি সহজ উপায় হতে পারে উইকিপিডিয়ার ভুক্তিগুলো অনুবাদ করা। ইংরেজি উইকিপিডিয়া থেকে ভুক্তিগুলো গুগল ট্রান্সলেটর ব্যবহার করে বাংলায় অনুবাদ করলে প্রাথমিকভাবে কিছু ভুল দেখাবে। সেই ভুলগুলো ঠিক করে করে সঠিক অনুবাদ আসবে। এতে দু'ধরনের লাভ হবে। গুগল বাংলা অনুবাদের মান উন্নত হবে এবং বাংলা উইকিপিডিয়ার ভুক্তিসংখ্যা বাড়বে।
বাংলা গুগল ট্রান্সলেশন সার্ভিস চালু হওয়ার পর থেকেই একটা বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে_ অনেকেই মজা করার জন্য ভুল অনুবাদ ইনপুট দিচ্ছেন। অনেকেই আবার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ভুল অনুবাদ ইনপুট দিচ্ছেন। এ রকম বেশ কিছু অনুবাদ নজরে পড়েছে। এ রকম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভুল অনুবাদ আমাদের ভাবমূর্তিকেই নষ্ট করবে। মনে রাখা দরকার, গুগল স্ট্যাটিসটিক্যাল মেশিন ট্রান্সলেশন মেনে চলে। প্যারাট্রান্সলেশনগুলো গুগল ট্রান্সলেটর স্বয়ংক্রিয়ভাবে মনে রাখে। এভাবে ভুল অনুবাদ ইনপুট দিলে মানসম্মত বাংলা অনুবাদ পাওয়া কষ্টকর হবে।
গুগলের বাংলা অনুবাদের মান উন্নয়নে সহায়তা করার জন্য ফেসবুকে 'গুগল ট্রান্সলেশন ইন বাংলা' (িি.িভধপবনড়ড়শ.পড়স/মড়ড়মষবনধহমষধ) নামে একটি কমিউনিটি পেজ খোলা হয়েছে। যারা গুগলের বাংলা অনুবাদের মান উন্নয়নে কাজ করতে আগ্রহী তারা ফেসবুকের কমিউনিটি পেজটিতে যোগ দিতে পারেন। অনলাইনে নানা কাজে আমরা সময় ব্যয় করি। আসুন, কিছুটা সময় ব্যয় করি ওয়েবের দুনিয়ার অন্য ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার যোগাযোগকে সমৃদ্ধ করতে। প্রতিদিন কিছুটা সময় বাংলা অনুবাদের মান উন্নয়নে ব্যয় করলে আমরা অল্প সময়ের মধ্যে মানসম্মত অনুবাদ পাব। আসুন, আমাদের ভাষা আমরাই সাজাই।
একরামুল হক শামীম : সাংবাদিক ও গুগল বাংলা অনুবাদের স্বেচ্ছাসেবী