ছবি : নেট
শেষ অংশ
এমনই উদ্বেগ পূর্ণ পরিস্থিতিতে প্রায় একমাস পর সারা আমার বাসায় আসলো। মাসখানেক হলো আমার সঙ্গে সারার কোন দেখা সাক্ষাত নেই।এতদিন পর দেখা হওয়ায় খুশি হবার বদলে আমার উদ্বিগ্নতা যেন আরো বেড়ে গেলো। একি হল সারার? চুলগুলো রুক্ষ-শুস্ক, মুখ কালো হয়ে গেছে সম্ভবত ওজন কমে গেছে আগের তুলনায়। কতদিন যে না খেয়ে না ঘুমিয়ে এমন পরিস্থিতি হল তা আমার ধারণার বাইরে। যদিও সে স্বাভাবিক আচরণ করছে তবুও তার পরিবর্তন আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। সর্বদাই কেমন যেন একটা হতাশার মধ্যেই দিনযাপন করছে সারা। হঠাৎ করেই আমার বাড়িতে চলে আসায় প্রথমে খানিকটা সংকোচ বোধ করলো সারা। ওর সংকোচ বোধ দেখে কিছুটা অবাক হই।কেননা আজ ঘনিষ্ঠতম বান্ধবীর বাড়িতে অপ্রত্যাশিত আগমনে কিছুটা সংকোচ ও উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করলেও এমন কত যে অপ্রত্যাশিত আগমন ঘটেছে সে গল্প ব্যাখ্যাতীত। যাইহোক সব সময়কার মত স্বাভাবিক গল্প-গুজবে মশগুল থাকলেও কথায় কথায় কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল সারা। কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। অবশেষে খানিকক্ষণ গল্প করার পর তাকে জিজ্ঞেস করলাম ,
- তোর কি হয়েছে?
সারা একটু চুপ থেকে বলল,
- দোস্ত, আমি এবার এইচএসসি পরীক্ষাটা ড্রপ দিয়েছি।
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম! কেননা কোনো বিশেষ কারণ ছাড়া কখনোই কেউ বোর্ড পরীক্ষা ড্রপ দেয় না! আমি উদ্বিগ্নতার সাথে সারার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সারা আমাকে বলল,
- আমি যে কেনো পরীক্ষাটা দিলাম না তা আমি আজও জানি না। তবে এটুকু জানি পরীক্ষা দেবার মতো কোনো মানসিক প্রস্তুতি আমার ছিলনা। পরীক্ষার হল থেকে শিক্ষকরা আমাকে বারবার কল করছিলেন কিন্তু আমি ফোন রিসিভ করিনি। মা এবং মামা আমার রুমের দরজায় এসে বারবার নক করছিলেন যে কেন আমি পরীক্ষার হলে গেলাম না কিন্তু কোনো জবাব আমার কাছে ছিল না।
বলেই সারা মাথা নিচু করে অন্যমনস্ক হয়ে বসে রইল। এতসব হবার পিছনের কারণটা জানতে চাইলে সারা চুপ করে রইলো। আমি সারাকে শান্তভাবে বললাম,
- সারা আমাকে সব খুলে বল তোর কি হয়েছে ?
সারা ধীরে ধীরে সমস্ত ব্যাপারটা আমার কাছে খুলে বলতে শুরু করল। যদিও কিছুটা সংকোচ বোধ কাজ করছিল তার মাঝে। একটু নিঃশ্বাস নিয়ে সে বলতে শুরু করল ,
- তুই ঠিকই বলেছিলি নিবিড় ভালো ছেলে নয়। ওর আসল রূপটা আমার কাছে সর্বদা অজানাই ছিল। প্রথমে আমাদের পরিচয় হয় একই কোচিংয়ে পড়ার সুবাদে। তারপর সে আমাকে অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করে। অল্প কিছু দিনেই আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে যাই। একটা সময় সে আমাকে প্রপোজ করে। যদিও আমি কোনভাবেই রিলেশনশিপে যেতে চাইনি কিন্তু তার আচরণ আমাকে তার প্রতি মুগ্ধ করে। সে এমন একটি ছেলে যার থেকে চোখ ফেরানো কঠিন। যার মিষ্টি কথায় না এসে পারা যায় না। অবশেষে রিলেশনশিপে যাওয়ার পর শুরুর দিকে সব ঠিকই ছিল কিন্তু আস্তে আস্তে যেন ওর নতুন রূপ জানতে পারছিলাম। ঈশিতা শুধু ওর বান্ধবী না বান্ধবীর চেয়েও বেশি কিছু। এমনকি ঈশিতার সঙ্গে পরামর্শ করেই নিবিড় আমার সঙ্গে রিলেশনশিপে যায়। শুধু তাই নয় মীরা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে ওর দীর্ঘ তিন বছরের সম্পর্ক। সে সম্পর্কে গভীর অন্তরঙ্গতা রয়েছে। ঈশিতা মীরার ব্যাপারে সব জানে এবং মীরাও ঈশিতার ব্যাপারে অবগত। নিবিড় পড়াশোনা শেষ করে নাকি মীরাকে বিয়ে করবে। কেননা মীরা এবং নিবিড়ের সম্পর্কটা শুধু আবেগিক দিক দিয়েই নয় বরং এখন তা বহুদূর গরিয়ে গিয়েছে! তাছাড়া নতুন নতুন মেয়েদের সাথে নিবিড়ের রিলেশনশিপে জড়ানোটা ওদের তিনজনের কাছে নিত্য নতুন খেলা! ওরা তিনজন বেশ ঘনিষ্ঠ এবং প্ল্যানিং করে আমাকে টার্গেট করেছিল। আসলে আমাকে পটানোটা ছিল নিবিড় এর জন্য মীরা এবং ঈশিতার দেয়া একটি চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জের জিতে যাবার পর যখন দেখল আমি নিবিড়ের প্রতি খুব সিরিয়াস তখন নিবিড় মিথ্যা নাটক সাজিয়ে আমাকে দূরে সরিয়ে দেয়। যেদিন মিথ্যা নাটক সাজিয়ে নিবিড় আমার সঙ্গে ব্রেকআপ করে, সেদিন সন্ধায় ওরা তিনজন মিলে চ্যালেঞ্জ জেতার সেলিব্রেশন করেছিল।
একটু থেমে সারা আবার বলতে শুরু করল ,
- জানিস, আমি কোনদিন কারো জন্য এতটা অপেক্ষা করি নি কিন্তু নিবিড়ের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতাম শুধু ওকে একবার দেখার জন্য। নিবিড়কে পেয়ে আমি আমার জীবনের সব জটিলতাকে ভুলে থাকতাম। ডিভোর্স প্রাপ্ত বাবা-মায়ের যন্ত্রণাদায়ক জীবন থেকে সরে গিয়ে মানসিকভাবে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম। ঠিক এতটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম তাকে। নিবিড় মাঝে মাঝে আমার গভীর ভালোবাসা দেখে ভয় পেত। এমনকি একদিন সে আমাকে বলেছিল যে মীরাকেই বিয়ে করবে। ঈশিতা ওর বেস্টফ্রেন্ড হলেও ওদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক আছে! কিন্তু আমি ওর প্রেমে এতটাই পাগল ছিলাম যে, সে সকল কথা আমি বিশ্বাসই করতে পারতাম না। আমি শুধু জানতাম নিবিড় একমাত্র আমারই। ওকে পেয়ে আমার জীবনটা যেন পাল্টে যেতে লাগলো। মায়ের সাথে আমার সম্পর্কটাকে আমি সুন্দর করে ফেলেছিলাম। বাবার ফোন কল রিসিভ করে বাবাকে শুধু 'কেমন আছো?' প্রশ্নটাও জিজ্ঞেস করতে পারতাম। মনে কোনো জটিলতা , জীবনের প্রতি কোন অভিযোগ-ই আমার ছিলো না। পড়ালেখা, দৈনন্দিন জীবনের সব ব্যস্ততার পরও আমার সবকিছু জুড়ে যেন নিবিড়ের অস্তিত্বকে আমি অনুভব করতে পারতাম। কিন্তু যখন সে আমাকে ছেড়ে চলে গেল তখন যেন মনে হলো আমার পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেছে। আসলে দোষটা আমারই ছিলো। আমার গভীর ভালোবাসা দেখে নিবিড় আমার কাছে সব স্বীকার করলেও আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। আমি ওকে এতটাই ভালবেসে ফেলি যে ওর সব খারাপ স্বভাবগুলো আমার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে পড়ে। জীবন থেকে আমার শুধু একটি মাত্র চাওয়া ছিল তা শুধুই নিবিড়। এতটা ভালবাসতাম আমি তাকে। কিন্তু যখন নিবিড় আমাকে ছেড়ে চলে গেল তখন আমি বুঝতে পারলাম আমি নিজেকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছি? যেখানে আমার নিজের কোনো অস্তিত্ব নেই। যেখানে সবটা জুড়ে শুধুই নিবিড়! তখন ধীরে ধীরে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা বেড়ে গেল। পড়াশোনা একেবারে ছেড়ে দিলাম। সারাদিন-রাত একা অন্ধকার ঘরে পড়ে থাকতাম। ফোন বন্ধ করে সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম। মাঝে মাঝে এতটা অস্থির হয়ে যেতাম যে দুএকবার সুইসাইড করতেও গিয়েছিলাম, কিন্তু পারিনি , সাহস হয়নি। মরে যেতে চাইবার অবশ্য কারণও ছিল। আপন থেকেও তো আপন বলতে কেউ রইল না! বাবা-মা সব সময় আলাদা এবং তাদের জটিলতাপূর্ণ জীবন যে আমাকে সব সময় যন্ত্রণা দিত! এত জটিলতার মধ্যে একমাত্র ওকেই আমি আপন ভেবেছিলাম কিন্তু সেও শেষে আমার জীবনটাকে বিষাক্ত করে তুলল। এই সত্যটা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে কঠিন হয়ে গিয়েছি। একা থাকতে আমি ভয় পেতাম। একা থাকলেই হাজারো দুঃশ্চিন্তা আমাকে ঘিরে ফেলত। অন্ধকার ঘরে একা থাকতে থাকতে মাঝে মাঝেই ভয়ে চিৎকার করে উঠতাম। অবশেষে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলাম। কলেজের শিক্ষকদের জানালাম আমি মানসিকভাবে অসুস্থ থাকার কারণে পরীক্ষাগুলো দিতে পারেনি। কিছু শিক্ষক আমাকে সেই মূহূর্তে সাহস দিল। বন্ধুবান্ধব আমাকে সময় দিল, সাহস দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে আমাকে প্রেরণা দিল। সর্বোপরি আমার পাশে এসে দাঁড়াল মা! যাকে আমি সারা জীবন অবজ্ঞা করে গেছি! মা যদি আমার পাশে এসে না দাঁড়াতো তাহলে হয়ত আমি বেঁচে উঠতে পারতাম না! এতটা ভেঙে পড়ি আমি অথচ মা এসবের কিছুই জানতো না। মা শুধু জানে আমি পরীক্ষার যথাযথ প্রস্তুতি না নেয়ায় ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু আসল সত্যিটা জানতাম শুধু আমি এবং আমার অন্তর্যামী। আমি জানি, আমি কোন ভুল করিনি। কারণ আমি মন থেকে ভালোবেসেছি। কিন্তু সেই ভালবাসাটা যে আমাকে এভাবে ভেঙে চুরমার করে দেবে তা ভাবতে পারিনি!
আমি সারার কথাগুলো আর সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,
- এতো কিছু হয়ে গেল আর তুই একবার আমাকে জানালি না! জানালে হয়তো ব্যাপার গুলো এত দূর এগোতো না।
সারা তখন দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল,
- শুরুতে আমি তোকে কিছুই জানাতে চাইনি। কারণ তুই নিবিড়কে পছন্দ করতি না কিন্তু যখন আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে যায়, সে সময়ে সবার আগে তোর কথাই মনে পড়েছিল। ইচ্ছে হয়েছিল যেন ছুটে তোর কাছে এসে একবার সব বলি! হয়তো একমাত্র তুই আমার দুঃখের ভাগ নিতে পারবি কিন্তু তখন তোর সামনে এসে দাঁড়ানোর সাহসটুকু আমার ছিলনা। কারণ নিবিড় সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা তুই আমাকে আগেই দিয়েছিলি। আমি সেসব বিশ্বাস করিনি উল্টো তোকে অপমানও করেছিলাম। জানি, সেসব কিছুই তুই মনে রাখিস নি কিন্তু আমি যে সেসব ভুলতে পারিনি! আজ তোর কাছে এসেছি কারণ, দিন শেষে আমরা তার কাছেই ফিরে আসি যে আমাদের প্রকৃত বন্ধু!
আজ সারা নিবিড় নামের সেই ভয়ঙ্কর ছায়া হতে মুক্ত। কিন্তু আমি জানি, সেই অনুভূতি গুলো আজও কল্পনায় আঘাত হানে! সারার সাথে বন্ধুত্ব আজও ঘনিষ্ঠ কিন্তু যখন আজও নিরবে ওকে দেখি সেই দৃশ্যগুলো আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে! কি হাস্যজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত একটি মেয়ে ছিল সারা! এখনো আমার স্পষ্ট মনে পড়ে স্কুলের ক্লাস ফাকি দিয়ে কত যে সে ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিয়েছে। ছোট ছোট বাচ্চারা যখন ছুটির সময় দৌড়ে ক্লাস থেকে বের হতো তাদের পিছনে দাঁড়িয়ে আলতো করে চুলে টান দিয়ে অন্যদিকে ফিরে তাকাতো সারা। আর বাচ্চাদের দৌড়ানোর গতি থেমে যেত। নিজের এসব পাগলামিতে নিজেই হাসিতে ফেটে পড়তো। সর্বদাই উপদ্রব করে বেড়াত সে। ওর এসব উপদ্রপে বিরক্ত হলেও না হেসে থাকতে পারতাম না আমরা। আজও সে মন খুলে হাসে অথচ তার হাসিতে সেই সরলতা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু এই ছোট্ট পার্থক্যটা শুধু আমার চোখেই ধরা পড়ে!
ভুলবশত পোস্টটি মুছে গিয়েছিলো তাই পুনরায় আমার ব্লগে পোস্ট করা হলো।
- দেয়ালিকা বিপাশা
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০২১ রাত ১২:১৪