ছবি: দেয়ালিকা বিপাশা
শৈশবের একটা স্মৃতি এখনো বেশ মনে পড়ে! যতবার মনে পড়ে ততবারই যেন চোখের সামনে স্মৃতিগুলো সব জীবন্ত হয়ে ওঠে! আজ এখানে আমার নিজের একটি স্মৃতি এবং আমার প্রিয় দুজন মানুষকে নিয়ে গল্প বলবো !! আশা করি পাঠকদের ভালো লাগবে!!
ছবি: ছোটবেলায় নানুর বাড়িতে কাটানো কিছু স্মৃতিময় মুহূর্ত
ছোটবেলার প্রথম শাড়ি পরার অভিজ্ঞতা:
ছোটবেলার ছিলাম বড় বোনের ভক্ত, অবশ্য এর বিশেষ কিছু কারণ ছিল! মাকে ভয় পেতাম অনেক বেশি! তিন ভাই বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট এবং আমার বোন সবার বড়। বড় বোন দাদির সাথে থেকে পড়াশোনা করত। বড় ভাইকেই সঙ্গী করে নিতে হয়েছে খেলার সাথী হিসেবে। ছোটবেলায় খুব কম সময় বড় বোনকে কাছে পেয়েছি কিন্তু আদর পেয়েছি অসম্ভব!! আর বড় ভাই যা উদ্ভট কাণ্ড করত সেগুলো নিরবে সহ্য করা লাগতো!! যেমন ভূত সেজে বাইরে বের হাওয়া!! সে নিজেও ভূত সেজে বের হতো এবং আমাকেও ভূত বানাত। আমার বেলায় মনের মাধুরী মিশিয়ে আমাকে ভূত বানাত। হরর সিরিয়াল সে নিজে একা দেখবে না আমাকে জোর করে এনে বসায় দেখতো। আমি ভয়ে হাউমাউ করে কান্না করতে শুরু করতাম। আর আমারে মাথায় একটা জোরে থাপ্পড় মেরে বলতো এই গাধা এইটা দেখলে মনে সাহস বাড়বে চুপ করে বসে বসে দেখ!! আর এর প্রতিফল ঘটতো রাতের বেলা যখন অন্ধকারে ঘুমাতে যেতাম পাশে মানুষ থাকলেও কান্নাকাটি শুরু করতাম!
আমি সাধারণ কানামাছি খেলতে গেলেও সবার আগে ধরা পড়তাম , যেন আমি নিজেই হেঁটে হেঁটে গিয়ে চোখ বাধা ব্যক্তির সামনে গিয়ে ধরা দিতাম। আর সেখানে আমাকে নিয়ে ক্রিকেট খেলতো! বোলিং টা না হয় যে সেই করে কোন রকমে পারতাম। কিন্তু ব্যাটিং করতে দিলে ভাই যখন অভিজ্ঞ বলার এর মত আমার দিকে ছুটে আসতো বল নিয়ে তখনই আমি বল পিটাবো কি ভয়ের চোটে ব্যাট ফেলেই দৌড় দিতাম!!! স্কুলের দৌড় প্রতিযোগিতা অংশগ্রহণ করতে গিয়ে বাঁশি ফুক দিলেই সবাই দৌড়ে চলে গেল আর আমি? আমি পিছনে পিছনে দৌড়াতে থাকতাম এবং একটা পর্যায়ে থেমে গিয়ে কান্না করতে শুরু করতাম কেন আমাকে রেখে সবাই দৌড়ে চলে গেল!!
এখনো বেশ মনে আছে ছোটবেলায় একপ্রকারের চকলেট পাওয়া যেত, চকলেট দিয়ে হাতে ঘড়ি বানিয়ে দিত !! বেশ মজা করে খেতাম সে চকলেটটা!! যখনই চকলেট ওয়ালা আঙ্কেল আসত তখনই দৌড়ে গিয়ে ভাইকে বলতাম ভাইয়া ভাইয়া চকলেট খাব!! ভাই আমার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে আমাকে সে চকলেট খাওয়াতো। এই চকলেট খাইতে গিয়ে যে দুই ভাই বোনে কত মাইর খাইছি কিন্তু তাও ভাইয়ের চকলেট খাওয়ানো কোনদিনও বন্ধ হয়নি !! আলহামদুলিল্লাহ!! সে যাই হোক বড় ভাই এবং বোন দুজনের কাছ থেকে অসম্ভব ভালোবাসা পেয়ে বড় হয়েছি! কিন্তু বড় ভাইয়ের ভালোবাসাটা ছিল থাপরাইয়া থাপড়াইয়া আদর করত আর বড় বোন ছিলেন মাথায় হাত বুলিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে শান্ত করতেন!! আমি ওরে এখনো বলি আপনি আসলে আমাকে মায়ের মত আগলে রেখেছেন!
যাই হোক মূল কথায় আসি, প্রথমে কথাগুলো বলা জরুরি ছিল কারণ বড় বোনের অবদানটা যেমন আমার প্রতি ভাইয়েরটাও কিন্তু কম না! আমি আবার একজনকে বেশি একজনকে কম প্রায়রিটি এই মতবাদে বিশ্বাসী না !! মূলত এখানে আমার ছোটবেলায় প্রথম শাড়ি পরার অভিজ্ঞতা নিয়ে গল্প বলা!!
তখন আমার বয়স ঠিক কত সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই কিন্তু মনে হয় আমি চার কি পাঁচ বছরের হব সম্ভবত। আগে বলেছি বড় বোন দাদীর সাথে থেকে পড়াশোনা করতেন। দাদি এবং আমরা ঢাকার মধ্যে থেকেছি কিন্তু ভিন্ন এলাকায় ছিলাম। আমরা তখন থাকতাম বনানীতে আর দাদী থাকতেন কিছুটা দূরে। তো মাঝে মাঝে যখন আমার বড় বোন বনানীতে আসতেন আব্বা আম্মার সাথে দেখা করতে বা ছুটিতে তখন আমার জন্য প্রায় ঈদের দিন থাকতো!! তখন এত ছোটই ছিলাম বুঝতাম না যে সে আমার আপন বোন!! কিন্তু এটা বুঝতে পারতাম এই বড় আপুটা আসলে আমাকে খুব আদর করবে, আমার জন্য অনেক চকলেট নিয়ে আসবে ,আমার জন্য অনেক অনেক গিফট নিয়ে আসবে!! আমি নিজে ছিলাম কুটুস খানি একটা মানুষ, ভাইয়ের উদ্ভট কান্ডের সঙ্গী তাই আমার নিজের তেমন কোন বন্ধু বান্ধব ছিল না। ভাইয়ের বন্ধু-বান্ধবও আমার বন্ধুবান্ধব আবার বড় বোন আসলে তার বন্ধু-বান্ধবও আমার বন্ধুবান্ধব!
একদিন বিকেলে বড় আপু তার বান্ধবীদের সাথে মিলে শাড়ি পড়ে ঘুরতে যাবে ঠিক করেছে এবং সেটা আমি সহ! কেননা আমার বোন বড় বোনের সঙ্গীদের লিস্টে সবার আগে নামটা আমারই থাকে!! যাইহোক আমার হাইট তখন এতটাই শর্ট ছিল এত ছোট মানুষের জন্য শাড়ি পাওয়া গেলেও ঠিক ওই মুহূর্তটাতে আমার জন্য কোন শাড়ি ছিল না। আপা ও তার বান্ধবীরা তো শাড়ি পরে খুব সুন্দর ভাবে সেজেগুজে রেডি এখন আমার কি উপায় হবে? ওয়েল আমার বড় বোন যেখানে উপস্থিত সেখানে আমার জন্য একটা না একটা উপায় রেডি হয়েই যায়!! আমার এখনো মনে আছে আমার আম্মার গোলাপি রঙের একটি জর্জেট শাড়ি সেদিন আমি পড়েছিলাম। যেহেতু বড় মানুষের শাড়ি আর আমি মানুষটা খুবই ছোট সেহেতু শাড়িটাকে মাঝে থেকে দুই ভাঁজ করে শাড়ির চওড়াটাকে ছোট করে আমাকে পরিয়ে দেয়া হয়েছিল।ফলাফল হয়ে দাঁড়ালো এই ছোট্ট একটা মানুষের গায়ে বারো হাতের শাড়ি একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল!! তারপরও আমি তো মহা খুশি!! আমার নাচুনি কাকে বলে!! আমাকে শাড়ি পরিয়ে দিতে পেরে আমার বোন ও মহা আনন্দিত আমাকে নাকি বেশ কিউট লাগছিল!! অবশেষে শাড়ি পড়ে সবাই তৈরি হয়ে যখন পার্কের দিকে ঘুরতে যাচ্ছি ঠিক তখনই মাঝপথে আমার খুশির ঠেলায় আর নাচুনির ঝাকুনিতে আমার জর্জেট শাড়ির কুচি গুলো প্রায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঝড়ঝড় করে মাটিতে পড়ে গেছে!! আমি তো পুরা টাশকি!! হায় হায় কি হইলো!! আমার আপা আমার অবস্থা দেখে শাড়ির কুচি গুলো ধরে হাসতে হাসতে প্রায় অজ্ঞান অবস্থা!! শুধু কি তাই?? অপমানিত হওয়ার একটা লিমিট থাকে আপার বান্ধবীরা যারা ছিল সকলেই হাসতে হাসতে প্রায় খুন হয়ে গেছে ইতিমধ্যে!! আমার এখনো মনে আছে আপার বেস্ট ফ্রেন্ড ইয়াসমিন আপু আমার এই শাড়ির কুচি খোলা দেখে হাসতে হাসতে আপাকে বলতেছে হায় হায় ওরে এই শাড়ি কেমনে পড়িয়েছিলি? আর এদিকে আমার অবস্থা আমি লজ্জায় চেহারা লাল হয়ে গেছে !! আপু তাড়াতাড়ি ওই রকম অবস্থাতে আমার শাড়ির কুচি গুলো ঠিক করে আমাকে আবার শাড়িটা পরিয়ে দিল!! আর ওই যে লজ্জায় চেহারা লাল হয়ে গিয়েছিল ওই লজ্জাতে আমার নাচুনিও বন্ধ হয়েছিল ঝাঁকুনিও বন্ধ হয়েছিল!! একে তো আত্মকেন্দ্রিক মানুষ তার উপরে লাজুক প্রকৃতির সেই ছোটবেলা থেকেই, তার উপরে এই ঘটনা ,লজ্জায় আমি প্রায় কিছুদিন বাসা থেকে বের হয়নি!!! এখনো এই স্মৃতিটা বেশ মনে পড়ে!! আপার এখনো মনে আছে কিনা জানিনা কিন্তু যখনই আমার মনে পড়ে তখন আমি নিজেই একা একা খুব হাসি!!
ছবি : সেই গোলাপি রঙের শাড়িটি, আপা এবং ছোট্ট আমি
যদিও সেই শাড়ি পরা অবস্থাতে কোন ছবি তুলতে পারিনি কিন্তু নিজের শৈশবের অনেক ছবি আমার কাছে আছে! বাবা আমাদের প্রচুর ছবি তুলতেন সেখান থেকে একটা অ্যালবাম আমি নিজে সংগ্রহ করে রেখেছি!! প্রায়ই আমি সেই অ্যালবামটা খুলে নিজের ছোটবেলার স্মৃতি গুলোকে চোখের সামনে জীবন্ত করে তুলি !! সত্যিই কতই না সুন্দর ছিল শৈশবের সেই স্মৃতি গুলো!!!