আমাকে নিরন্তর চলতে হয়।
তাই নানা রকম অভিজ্ঞতা অর্জন করি।
প্রতি ক্ষণে ক্ষণে আমার সুখ-দুঃখ মোকাবিলা করতে হয়।
দুঃখটাই বেশি থাকে।
সুখ থাকে সামান্য।
তাতেই আমি মহা খুশি থাকতে চাই।
আমি শৈশবেই জেনে গিয়েছিলাম জীবন বড় কঠিন।
বিশেষ করে অর্থনৈতিক দৈন্যতা মানুষকে ধীরে ধীরে অনেক খাটো করে ফেলে।
আমার মনে পড়ে প্রায় পনের বছর আগে আমার পরিবারের একজন সদস্য এক
আত্নীয় এর নিকট হতে ত্রিশ হাজার টাকা ধার করেছিলো।
সুদসহ টাকাটা সময় মতো দিতে পারে নি বলে কতটা
যে অকথ্য ভাষায় কথা বলেছে
তার সীমারেখা নেই।আমি আড়ালে থেকে শুনছিলাম।
আর কাঁপছিলাম। তখন খুব কান্না পাচ্ছিলো।
আমি কাঁদতে পারি নি।
কাঁদতে পারলে হয়তো এতদিনে ভুলে যেতে পারতাম।
দ্বিতীয় ঘটনা।
আমার বাবা একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরি করেন।
মাস শেষে সামান্য কিছু অর্থ পান, আমরা কখনো সে ভাবে জীবন-যাপন করতে পারি নি।
বিশেষ করে পোশাক-আশাকে।
খাবার-দাবার যা কিছু হতো
মায়ের হাতে ছিলো অমৃত।
তাই খাবার-দাবারের
কোনো আক্ষেপ আমার নেই।
আমি তখন ৬ষ্ঠ শ্রেনীর ছাত্র,
একদিন আমি আর মা যাই এক ঘনিষ্ট আত্মীয়ের বাড়ি।
সেই আত্মীয়ের বাড়িতে ওই সময় মেয়ে পক্ষের লোকজন আসবে ছেলের বাড়ির ঠায়-ঠিকানা দেখতে।
যতক্ষণ মেয়ে পক্ষের লোকজন ছিলো ততক্ষণ আমার অবস্থান নির্দিষ্ট করে দেয়া হয় স্টোর রুম।
কারণ,আমার পোশাক ছিলো খুবই নিম্ন মানের।
কতটুকু বয়স আমার তখন।
খুব কষ্ট পেয়েছিলাম আমার ঘনিষ্ট আত্মীয়ের ওই আচরণে।
এ কথা আর কেউ জানে না।
শুধু আমি জানি,
সেদিনও আমি কাঁদতে পারি নি।
তাই আজও ওই ঘটনা আমার চোখে জ্বলজ্বল করে।
আমার সকল সত্তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে সে কথা আমাকে প্রতি নিয়ত জানান দেয়।
এমন আরও বহু ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছে বলা
যায় বিনা দোষে।
কঠিন শাস্তি পেয়েছি আমি।
যা আমাকে পাবার কথা নয়।
তৃতীয় ঘটনা,
প্রায় পাঁচ ক্রোশ পথ হেঁটে
আমাকে বিদ্যালয়ে যেতে হতো।
রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পথ চলতে হতো।
কাছে বিদ্যালয় থাকা সত্বেও সেখানে পড়তে পারিনি,কারনটা,স্কুলের বেতন।
ভাইবোনদের স্কুলের বই,খাতা,কলম, ফি বাবা ঠিকমত দিতে পারতো না।
পরিক্ষার ফি আর স্কুল ড্রেসের জন্য স্যারদের অনেক
কটু কথা শুনতাম।
পরিক্ষা এলেই আমার খুব খারাপ লাগতো,
স্কুলের বারান্দায় দাড়িয়ে স্যারের অনুমতিপত্র নেবার জন্য দীর্ঘসময় অপেক্ষার প্রহর।
কখনো কখনো আধা ঘন্টা অতিক্রম হবার পরে
পরিক্ষা দিতাম,কখনো বা
বাড়ি ফিরে আসতাম।
দূরে দাড়িয়ে দেখতাম সহপাঠিরা পরিক্ষা দিচ্ছে।
অন্যরা টিকা টিপ্পনি
কাটতো প্রকাশ্যেই।
খুব কস্ট পেতাম মনে মনে,
বাড়ি ফিরে কখনো কখনো দু তিন দিনে বাড়ির জল পযন্ত স্পর্শ করতাম না।
অভিমানে বাড়ির কারও সাথে কথা বলতাম না।
বড়বোন জানতে চাইলে,
কোন উত্তর দিতে পারতাম না।
আমি কাঁদতে পারি নি।
কারণ,আমাকে জীবনভর এই
ঘটনা মনে রাখতে হবে।
প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নয়।
অতটা নির্বোধ আমি নই।
কোনো বোধহীন মানুষকে যে কোনো আঘাত করে আমি অস্পৃশ্য হয়ে পড়ি।
তবে আমি মনে রেখেছি।
আমি মনে রাখবো মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। লড়াই করে যাবো অবস্থার পরিবর্তন আনার জন্য।
আমার ভাগ্য আসলে খারাপ।
আমার সাথে যারা এসেছে শেষ পর্যন্ত আমার হয়ে থাকতে পারে নি।
তারা আমার চেয়ে অন্যকে
বেশি পছন্দ করতো।
কিন্তু প্রকৃত তাদের আপনজন আমি ছিলাম।
বলা হয়ে থাতে সত্য কঠিন।
সেই কাঠিন্য সবাই মানতে পারে না।সহ্য করতে পারে না।
যারা অবাস্তব স্বপ্ন দেখাতে পারে তাদের
কাছে সব বিসর্জন দিয়ে বসে।
আমার কাছে যদি সামান্য পুঁজি থাকতো তবে এ ধরণের অবস্থায় আমাকে পড়তে হতো না।
আজও আমি সেই সঙ্কটকাল পার করছি।
অনেক ঘা আছে যা সহজে সেরে যায় না।
কখনও কখনও মৃত্যু ডেকে আনে।
আমার কই মাছের প্রাণ,সহজে মরি না।
গরম কড়াইয়ের উপরও নাচতে থাকি।না নেচে উপায় নেই।
আজ এমন একটি ঘটনার সম্মূখীন হতে হয়েছে যার জন্য আমাকে চিৎকার করে কাঁদা উচিত।
আমি আজও কাঁদিনি।
হাঁসি মুখে ব্যথা লুঁকানোর চেস্টা করি।জমতে থাকুক না কান্না যত কাহিনী আছে।
একদিন সব কান্না বুকে করে কাউকে কাউকে কাঁদিয়ে চলে যাবো চিরতরে।