পৃথিবীতে স্বর্গের একটি অংশ হিসেবে কাশ্মীরকে প্রায়শই তুলনা করা হয়ে থাকে। সমগ্র এশিয়া জুড়ে কাশ্মীর একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে এবং সাধারণত এটিকে ‘এশিয়ার সুইজারল্যান্ড’ নামে ডাকা হয়। কাশ্মীরের অতুলনীয় সৌন্দর্যের কারণেই তাকে বলা হয় ‘পৃথিবীর জান্নাত বা স্বর্গ’।
কাশ্মীরের প্রকৃতির সৌন্দর্যে সারা বিশ্ব থেকে আগত মানুষ আকৃষ্ট হয়। প্রকৃতির সৃষ্টি উপভোগ করতে প্রতি বছর এখানে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়ে থাকে।
তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সবকিছু থাকা সত্ত্বেও পৃথিবীর এই স্বর্গ একরকম নরকে পরিণত হয়েছে এবং এর পিছনে রয়েছে মূলত রাজনৈতিক কারণ। এটা সত্যি যে, কাশ্মীরের ভূমির প্রতিটি খণ্ড প্রকৃতির আশীর্বাদ কিন্তু সেখানে অন্য আরেকটি বাস্তবতা রয়েছে। সেখানকার মানুষ চরম দুঃখ-দুর্দশার সঙ্গে দিনযাপন করছে।
একটি পুরানো এবং দীর্ঘদিনের বিতর্কিত এই অঞ্চলটি তিনটি পারমাণবিক ক্ষমতাধর দেশ (ভারতীয়, পাকিস্তান ও চীন) দ্বারা বেষ্টিত। এই দেশ তিনটি তাদের আঞ্চলিক সুবিধার জন্য কাশ্মীরে আক্রমণ করছে। তাদের প্রত্যেকেই কাশ্মীরের এক একটি অংশ দখল করে নিয়েছে এবং তাদের দখলকৃত অংশকে একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেছে। এই তিন দেশই স্বীকার করেছে যে, অতীতে যা কিছু ঘটেছে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বর্তমানে যা ঘটছে তাতে কাশ্মীরের আদি বাসিন্দারা সন্তুষ্ট নয়।
সবচেয়ে সমস্যাযুক্ত অঞ্চল হচ্ছে ভারত অধিকৃত কাশ্মীর। এ অঞ্চলের নিপীড়নের ইতিহাস শুরু হয় মহারাজা কর্তৃক ভারতের সঙ্গে সংযোজনের চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর থেকে। জনগণের দাবিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা পরে তিনি এ চুক্তিটি করেন। তারপরে কাশ্মীরের পণ্ডিত সম্প্রদায়ের সাথে নেহেরুর গভীর সংযোগের মাধ্যমে এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা হয়।
পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মীরের ঘনিষ্ট সংযোগে কাশ্মীরের প্রতি নেহেরুর কথিত দরদ, কাশ্মীর উপত্যকায় তার আবেগপ্রবণ সংযুক্তি, শেখ সম্প্রদায়ের সঙ্গে বন্ধুত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এসব ঘটনায় নেহেরু কাশ্মীরকে ‘ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ’ বলে দাবি করার জোড়ালো সাহস এনে দেয়।
আজকে ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে বারবার মানবাধিকার লঙ্ঘন, ধর্ষণ, অবৈধ আটক, গুম, পঙ্গু করা, মিডিয়ার কণ্ঠরোধ ইত্যাদি পৈশচিক ঘটনা ঘটেই চলেছে। কাশ্মীরের নাগরিকরাও পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ব্যাক-টু-ব্যাক গণজাগরণের ঘটনা ঘটাচ্ছে। এই গণজাগরণ বিগত অনেক বছর ধরেই কাশ্মীরের মানুষকে একটি বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ করেছে। প্রতিটি বিদ্রোহের মূলে আছে একটি কারণ আর তা হলো ‘ভারতের দখলদারিত্ব থেকে কাশ্মীরের জনগণ স্বাধীনতা’।
ভারতের দখলদারিত্ব থেকে স্বাধীনতার জন্য কাশ্মীরের জনগণ গত ৬৪ বছর ধরে দাবি জানিয়ে আসছে। ২০০৮ সালে ‘অমরনাথ জমি হস্তান্তর বিতর্ককে’ কেন্দ্র করে ভয়াবহ নাগরিক বিদ্রোহ ছড়িয়ে পরে। এটাই প্রথম জোড়ালো প্রচেষ্টা যা মানুষ দ্ব্যর্থহীনভাষায় ভারতের দখলদারিত্ব থেকে স্বাধীনতার দাবি তোলে। কাশ্মীরের ইতিহাসে প্রথমবারের জনগণ পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। এই বিদ্রোহ কাশ্মীরের জনগণকে ‘স্বনির্ভরতা’ অর্জনের শিক্ষা দেয়!
২০০৮ সালের ওই বিদ্রোহ দমনে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়। এসময় তাদের হাতে শোপিয়ান জেলার দুই তরুণীকে ধর্ষণের পর খুন করা হয়। এতে উপত্যকা জুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ সংঘটিত হলে ১২০ জন মানুষ নিহত হয় এবং ১ হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়। এর পর ২০১০ ও ২০১২ সালেও উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে।
এসব বিদ্রোহে পাকিস্তানের গভীর সংযোগ আছে বলে ভারত সরকার বারবার দাবি করে এবং এখনো দাবি করে আসছে। ভারতের দাবি, তারা (পাকিস্তান) কাশ্মীরে শান্তি প্রক্রিয়াকে অস্থিতিশীল করতে চায় যা একটি ডাহা মিথ্যা। কাশ্মীরে ভারতীদের প্রতিনিয়ত নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি অন্যদিকে বিক্ষিপ্ত করতেই দেশটির সরকার বারবার পাকিস্তান প্রসঙ্গ টেনে আনছে।
দক্ষিণ কাশ্মীরে স্বাধীনতার ডাক
স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে দক্ষিণ কাশ্মীর সবসময়ই পুরোভাগে থেকেছে। ২০১৬ সালের বিদ্রোহের গভীর শিকড়ও এই দক্ষিণ কাশ্মীর। দক্ষিণ কাশ্মিরের ছোট্ট একটি গ্রাম থেকে এই বিদ্রোহের সূচনা হয় যা পরবর্তীতে সমগ্র কাশ্মীরে ছড়িয়ে পড়ে। গত ৮ জুলাই কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনের জনপ্রিয় নেতা বুরহান ওয়ানি ভারতীর নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত হন। এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বর্তমান বিদ্রোহেও দক্ষিণের প্রধান অবদান রয়েছে।
নিরাপত্তা বাহিনীর বেষ্টনী ভেঙ্গে দক্ষিণের জনগণ ভারতীয় বাহিনীর মুখোমুখি হয়। এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে হাজার হাজার কাশ্মীরি রাস্তায় নেমে আসেন। এই বিক্ষোভে কেবল দক্ষিণেই এপর্যন্ত ৪৫ জন তরুণ তাদের জীবনকে উৎসর্গ করেছে এবং কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছে। সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা প্রায় ৮৫ জন। ২০০ জনেরও বেশি তরুণ ছররা গুলির আঘাতে তাদের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে।
ছোট্ট পল্লী গ্রাম থেকে শহরের সর্বত্রই মানুষের মুখে কেবল একটি আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ‘আজাদী’। ‘আমরা কি চাই? ফ্রিডম’, ‘জালেম ও নিষ্ঠুরেরা আমাদের কাশ্মীর ছেড়ে যাও’ ইত্যাদি।
দক্ষিণ কাশ্মীরের কানালওয়ান এলাকায় পরিচালিত একটি সাইকেল এবং গাড়ী সমাবেশ। স্বাধীনতার দাবিতে অনুষ্ঠিত এ সমাবেশ নস্যাৎ করতে ব্যর্থ হয়ে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী পরে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং বাড়ি-ঘর এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করে। তবুও তারা মানুষকে দমাতে পারেনি। তিন হাজারেরও বেশি বাইক এবং দুই হাজার গাড়ি র্যালিতে অংশ নেয়। পরে এক স্বাধীনতাকামীকে গুলি করে হত্যা করে ভারতীয় বাহিনী।
দক্ষিণ কাশ্মীরের মাতানের অনেক স্থানে বিক্ষোভকারীদের স্বাগত জানানো হয়। শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশকারী ছেলেদের প্রচেষ্টাকে তারা প্রশংসা করেন। এটি এমন এক পরিবেশের সৃষ্টি করে যে, স্বাধীনতা খুব বেশি দূরে নয়, প্রতিটি দিন যেন একটু একটু করে এটি কাছাকাছি আসছে।
সাইকেল এবং গাড়ির শোভাযাত্রার সময় তরুণরা তাদের শার্টের পিছনে এক টুকরা কাগজ টেপ দিয়ে আটকিয়ে নেয় যাতে লেখা ছিল ‘আমরা স্বাধীনতা চাই’।
কাশ্মীরে ভারতের অবৈধ দখলের প্রতিবাদে দুখতারান-ই-মিল্লাতসহ স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ নিকটবর্তী একটি এলাকায় নারীদের সমবেত হওয়ার আহ্বান জানালে তারা তাতে সাড়া দেন। দক্ষিণের নারীরা পাকিস্তানী পতাকা নিয়ে জমায়েত হয়। তারা স্বাধীনতাকামীদের প্রচেষ্টাকে প্রশংসার মাধ্যমে মূলত ভারতের দখলদারিত্বকে চ্যালেঞ্জ জানায়। নারীরা ভারতবিরোধী স্লোগানের পাশাপাশি স্বাধীনতার দাবি সম্বলিত বিভিন্ন স্লোগানও দেন।
দক্ষিণ কাশ্মীরের ইসলামাবাদের আং এ হুরিয়াত কর্মসূচিতে সাধারণ কাশ্মীরিরা একত্রে স্বাধীনতা শোভাযাত্রায় অংশ নেন। মানুষ তাদের হাত তুলে এবং কুরআনের উপর শপথ নেয় যে, বন্দুকের অধীনে পরিচালিত কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নিবে না। সমাবেশের পরে তারা আজাদী মার্চ বের করলে নিরাপত্তা বাহিনী প্রতিবাদকারীদের ওপর বুলেট ও ছররা গুলি ছোড়ে তা বানচাল করে দেয়। এতে চার ডজনেরও বেশি মানুষ আহত হয়। তাদের মধ্যে দুইজন চোখে মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত পান।
দক্ষিণ কাশ্মিরের ছোট্ট একটি গ্রাম জাবলিপুরায় অনুষ্ঠিত স্বাধীনতা সমাবেশ। নির্দোষ প্রতিবাদকারীদের উপর ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার ও দমননীতির তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয় এখানে। তারা মানুষের রক্তস্নানের অবসান ঘটিয়ে ভারতীয় দখলদারিত্ব থেকে স্বাধীনতার দাবি করেন।
দক্ষিণ কাশ্মীরের ভিরেনাগে স্থানীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মীর হাফিজুল্লাহর নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মানুষকে শান্তিপূর্ণ মিছিলে যোগদান এবং দরিদ্রদের সাহায্যের জন্য ধনীদের বেতন এক-তৃতীয়াংশ দানের জন্য আহ্বান জানানো হয়। তার বিশেষ অনুরোধে মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের সংযোগ পরিহার করেন।
স্বাধীনতা সমাবেশেরে সময় কঠোরতা বজায় রাখতে মীর দক্ষিণের মানুষকে অনুরোধ জানায়। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতা সমাবেশে যোগদানে অন্যদের উৎসাহিত করার এটাই উপযুক্ত সময়।’ তিনি এই সময়ে অতি দরিদ্র মানুষদের সাহায্যের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। তার অনুরোধে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে মানুষ যৌথ নেতৃত্বের কর্মসূচি গ্রহণ করে।
স্বাধীনতার দাবিতে খানাবাল থেকে বিজবেহারা পর্যন্ত একটি নৌকা সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এ সমাবেশ নস্যাৎ করতে ভারতীয় বাহিনী সড়ক অবরোধ করে রাখে। নিরাপত্তা বাহিনীর অবরোধকে অবজ্ঞা করে মানুষ প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দেয়।
দক্ষিণ কাশ্মিরের কুলগামে মুজাহিদীনদের সমাবেশে স্থানীয় তরুণেরা যোগ দিয়ে তাতে বক্তৃতা করছেন। তারা হুরিয়াত ক্যালেন্ডার অনুসরণের জন্য মানুষকে অনুরোধ জানান।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০১৬ রাত ৮:২৪