সময়টা আশির দশকের প্রথম দিকে। চারিদিকে বন্ধু-বান্ধবদের হাতে তখন "গেইম এন্ড ওয়াচ" নামক ততকালীন এক প্রবল আকর্ষনীয় গেজেটের ছড়াছড়ি। কতবার আব্বাকে বললাম, কিন্তু আব্বা তেমন একটা সাড়া দিতেন না। মনে মনে প্রচন্ড রাগ হতো।
একদিন আব্বা আমাকে মৌচাক মার্কেটের এক দোকানে নিয়ে গেলেন, প্রায় কিনেই ফেলেছিলাম সেই অমূল্য "গেইম এন্ড ওয়াচ"। যখন দাম জিজ্ঞেস করা হলো তখন দোকানী বলল, মাত্র ৩৫০ টাকা(!!!)। আমি তো খুশিতে বাকবাকুম। হটাৎ আব্বা বললেন আজ না, আরেকদিন। কিছু বুঝে উঠার আগেই তিনি আমাকে নিয়ে রিতিমত টেনে হিচড়ে বাসায় নিয়ে এলেন। আমাদের বাসা ছিলো সিদ্বেশ্বরী উচ্চ বালক বিদ্যালয়ের পাশেই। এমন রাগ লাগছিলো, মনে মনে ভাবছিলামঃ আব্বা এত্ত বড় এক ব্যাঙ্কে চাকরী করে তাও আমাকে একটা গেইম এন্ড ওয়াচও কিনে দিতে পারে না!!! ছোট ছিলাম, তাই মনে হতো এরপরে দোকানে গেলে আব্বাকেই বদলে নিয়ে আসবো। এরপরে এলো ১৯৮৭ সাল, চলে গেলাম ক্যাডেট কলেজে। গেইম এণ্ড ওয়াচের ভূতও মাথা থেকে নেমেগেলো কখন যে টেরই পেলাম না।
এত্তদিন পরে বুঝতে পারি কেনো তখন আব্বা আমার শখ পুরো করতে পারেননি। ছয়জনের একটি সংসারে আব্বার প্রধান উপার্জন ছিলো সততা। কোটি কোটি টাকার জিম্মাদার সরকারী ব্যাঙ্কের এক কর্মকর্তা হয়েও আমার আব্বা পারতেন না তাঁর সন্তানদের ছোটছোট শখ পুরো করতে। সেদিন মৌচাক মার্কেট থেকে বের হবার সময় আসলে আব্বা রুমাল বের করে বারবার তার চশমা পরিষ্কার করছিলেন নাকি আন্য কিছু করছিলেন তা আজ বুঝতে পারি।
পরবর্তীতে এক বেসরকারী ব্যাঙ্কে উচ্চপদে আসীন হয়েও আমার আব্বা তার সততা থেকে সরে আসতে পারেননি বলেই হয়তোবা চাকুরী জীবনের শেষেও তাঁকে অনেক বঞ্চনা সহ্য করতে হয়েছে। সততার জন্যই কিনা জানিনা, তার ছিল প্রচন্ড রাগ। আর এই রাগের কারণেই অনেকেই ব্যাক্তিগত ও চাকুরীজীবনে তিনি অনেকের বিরাগভাজন হয়েছেন।
আমার অনেক বন্ধুরা, যারা তখন "৩৫০ টাকা" দামের গেম এণ্ড ওয়াচ নিয়ে মাতামাতি করত, তারা অনেকেই আজ কিছুই হতে পারেনি অথবা হয়তোবা বাবার বানানো রাজ্যে পুতুল রাজা হয়ে বসে আছে। কিন্তু আমাকে "বঞ্চিতো" করা আমার বাবা কিন্তু আমার পোক্ত ভিত গড়ে দিয়ে গেছেন। আমাকে নিজের পায়ে দাড়াতে শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। আজ তিনি নিজে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। কিন্তু তিনি আমার ভেতরে তাঁর ছাপ রেখে গেছেন। তাঁকে হয়তোবা আজ জড়িয়ে ধরে হ্যাপি ফাদার্স ডে বলতে পারবোনা, কিন্তু আমার জন্য যতদিন আমি বেচে থাকবো ততদিনই হ্যাপি ফাদার্স ডে।
লিখতে লিখতে চোখের পানিতে লেখাগুলো কেমন যেনো ঝাপসা লাগছে, তাই বানানগূলো চেক করতে পারলাম না। কিন্তু আমার এই চোখের পানি কষ্টের নয়, গর্বের-আনন্দের। কারণ আমি আমার আব্বা মরহুম মুজিবর রহমানের সন্তান।
আজ আব্বা বেচে থাকলে এই লেখাটি যদি পড়তেন তাহলে এখনই হয়তো ফোন করে বলতেন, "এই গাধা, এত্তোগুলো বানান ভূল কেনো????"