সময়টা তখন ১৯৮২-৮৩ সাল, ক্লাস টুতে পড়ি। কতই বা বয়স ছিলো, ৭ কি ৮ বছর বয়স। তখন আমরা থাকতাম সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে মাঠের পাশে একটা ভাড়া বাসায়। স্বাভাবিকভাবেই বাড়িওয়ালার ছেলে, আমারই সমবয়সী, আদনান এর খেলার সময় মাতব্বরী সবসময় সহ্য করতো হত। ওই বয়সে আমাদের অন্যতম প্রধান খেলা ছিলো বেলুন নিয়ে, তাও আবার বিভিন্ন রকম উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে। মনে আছে একটি বেলুনের দাম ছিলো আট আনা থেকে এক টাকা। বাবার সীমিত আয়ে তাও সবসময় কপালে জুটতো না। তাই দেখা যেত বেশিরভাগ সময়ই বেলুনের সাপ্লাই আসতো আদনানের বাসা থেকে, আর উপরি হিসেবে ছিলো ওই বেটার আলগা মাতব্বরী।
এমনি সময় আমাদের কপাল খুলে গেলো। আমরা যে ফ্ল্যাটের একতলায় থাকতাম তার দোতলায় এলেন এক নতুন আঙ্কেল আর আন্টি, দুজনেই কম বয়সী আর আমাদেরও খুব আদর করেন। দেখা হলেই আদর, চকলেট সব কিছুই জুটতো। উনাদের নাকি নতুন বিয়ে হয়েছিল, তাই বাচ্চা কাচ্চাও ছিলো না।
কিন্তু আসল ঘটনা সেখানে না, ঘটনা হচ্ছে উনাদের আসার পরদিন সকল থেকেই উনাদের বেডরুম বরাবর জানালার নিচে, মাটিতে, এক ধরনের নতুন সেইপের বেলুন পড়ে থাকতে দেখা যেতে লাগলো। কোনদিন একটা, কোনদিন দুইটা; এমনকি কপাল ভালো থাকলে কোনদিন তিন চারটা পর্যন্ত বেলুন পাওয়া যেতে লাগলো। সাথে মাঝে মাঝে বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর (ব্যাঘ্রজাতীয়) ইংরেজি নাম লেখা চারকোনা ধরনের ছেড়া প্যাকেট।
আমাদের পালের গোদা ছিলো আদনান। ওর পারমিশন ছাড়া তো আর আমাদের এই আবিস্কার করা "অমূল্য গুপ্তধন" ভোগ করা যাবে না!!! কিন্তু ওই বেটা প্রথমেই ঘোষণা দিল এই বলে যে আমাদের সদ্য আবিস্কৃত গুপ্তধনের ও তার পরবর্তী সাপ্লাই নাকি পুরোটাই ওর নিজের মালিকানার, যেহেতু এই বাড়ি ওর বাবার, তাই। কি আর করা, মেনে নিতে হলো। আর ওর যে ষন্ডা মার্কা সাইজ, তাতে ওকে ঘটানোর বুকের পাটা আমাদের কারোও ছিলো না। চোখের সামনে ওই বেটা বাড়িওয়ালার ছেলে বেলুনগুলো নিজের মুখে ফুলিয়ে তা দিয়ে খেলত কিন্তু আমাদের ছুয়েও দেখতে দিত না।
কিন্তু এমন অনাচার কাহাতক সহ্য হয়??? মাসখানেক পর প্রথমে মৃদু প্রতিবাদ এবং পরে তা আমাদের, ভাড়াটিয়ার বাচ্চা কাচ্চাদের, "সহিংস" আন্দোলনে রূপ নেয়। ফলশ্রুতিতে বাড়িওয়ালা আঙ্কেল-আন্টির সভাপতিত্বে আমাদের সবার আব্বা আম্মার অংশগ্রহনে বিচার সভা। সেখানে আমরা একঝাঁক পিচ্চির দল কাঁদতে কাঁদতে পুরো ঘটনার আদ্যপান্ত খুলে বললে বিচার সভায় কেমন জানি পিনপতন নিরবতা নেমে আসে। বিচার মুলতবি রেখেই কেন জানি বড়রা সবাই মিলে দুইতলার সেই নতুন আঙ্কেল আন্টির বাসায় দল বেধে গিয়ে মিটিং করেন।
আর এতেই আমাদের কপাল পুড়লো। এর পরের দিন থেকে আমরা আর বেলুন পাই না!!! তবে গুপ্তধনের সাপ্লাই হারানোর দু:খ ভুলে গিয়েছিলাম যখন দেখেছিলাম ভিলেইনের পিঠে বাড়িওয়ালা আঙ্কেলের বাজানো হার্ডরক কনসার্টের ড্রামিং!!! এরপরে যতদিন ওই বাসায় ছিলাম, কোনদিন ওই "স্বৈরাচারী" আমাদের সাথে লাগতে আসার সাহস করে নি।
ওই ঘটনার সাথে কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, তখন ওই বয়সে বুঝতে না পারলেও, কিছুদিন পরে আমরা পিচ্চির দল ভাসা ভাসা শুনতে পারলাম, আমাদের দোতলার সেই সুইট নতুন আন্টির নাকি একটা ছোট্ট বাবু হবে।
মোরাল অফ দা স্টোরি: সকল প্রাপ্তিই লাভের নয়, আবার সকল অপ্রাপ্তিই লোকসানের নয়!!!!!