১/ চট্টগ্রামের ছেলে আমি। ইন্টার পর্যন্ত এখানেই পড়ালেখা করেছি। ১৬র শেষের দিকে ঢাকাতে চলে যায় অনার্স করার জন্য। শুরুতে মামার বাসায় ছিলাম। পরবর্তীতে এক ক্লাসমেটের সাথে রুম নেই একটা ফ্লাটে। তো তার নাম ছিল মানিক, পাবনার ছেলে। তো এখন আমার রুমমেট পাবনার, আমি চট্টগ্রামের। আমি যদি ও শুদ্ধ ভাষাতে কথা বলে অভ্যস্ত কিন্তু একটা টান তো আছেই। আর আমি কথা বলতাম খুব ই দ্রুত। যাই হোক, কাহিনী তে আসি। সাধারণত আমাদের ক্লাস শুরু হতো ৮/৯টা থেকে। সাধারণত আমি ফযরের নামায পড়ে আর ঘুমাতাম না। আমি ডেকে দিতাম তাকে বেশীর ভাগ সময় ক্লাসের জন্য। কিন্তু সেদিন কেন জানি ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুমানোর আগে তাকে বললাম, যে আমি ঘুমাই যাচ্ছি, ডেকে দিস। ক্লাস মিস গেলে কিন্তু আমার দোষ না। বলে ঘুমিয়ে গেলাম। ঘন্টাখানেক পড়ে আমাকে মানিক ঘুম থেকে ডেকে দিল। আমাকে তাড়াহূড়ো করে বলল - "এই মাঈনু উটেক উটেক, আমি লাইবার যাচ্ছি, খাটিয়াগান পাড়েক।" আমি আধ জাগ্রত অবস্বায় তখন। তার কথা গেল আমার মাথার এক হাজার মাইল উপর দিয়ে। সে আমাকে কথাটা বলে বের হয়ে গেল রুম থেকে। আমি একটু চিন্তা করলাম সে কি বলছে, তারপর আবার ঘুম। কিছুক্ষণ পর সে রুমে এসে চিল্লাচিল্লি শুরু। - "আরে তোরে বলে গেলাম ঘুম থেকে উটে বিছানা গোছাতে, তুই শালা এখনো ঘুমাচ্ছস।" আমি তো পড়লাম আকাশ থেকে। আরে তুই আমারে উটতে কখন বললি, আর বিছানাই বা কখন গোছাতে বললি। তারপর আবিস্কার করলাম লাইবার মানে গোসল করা, পাড়েক মানে গোছানো, আর উটেক মানে, well, উটতে বলতেছে আর কি। শালার লাস্টে এক্সট্রা ক একটা লাগাই দিয়ে আমার পুরো মাথা আউলাই দিছে।
২/ পরে মানিক রুম চেঞ্জ করে পাশের বিল্ডিং এ নিচের তালায় চলে যায়। আর আমি পাশের রুমে সিনিয়র ভাইয়াদের কাছে শিফট করি। তো এবার আমার রুমমেট ভাইয়ারা ছিল সিলেটি আর কুড়িগ্রাম। সিলেটি ভাইয়ার নাম ছিল বিশ্বজিৎ। আমার খুব ই ক্লোজ এবং পছন্দের একজন হয়ে উটে একটা পর্যায়ে উনি। বিশ্ব দার ফ্রেন্ড সার্কেল এ আমি অনেক জনপ্রিয় ছিলাম। তিড়িংবিড়িং তো। আর আমি ও সিনিয়রদের সামনে গেল একটু নিষ্পাপ আর বাচ্চা সাজি। তারা প্রায় সবসময় তাদের আড্ডায় আমাকে নিয়ে যেত। প্রোগ্রামে আমাকে ইনক্লুড করত। ট্যুরে গেলে ও সম্ভব হলে আমাকে ইনভাইট করত। তো একদিন দাদাদের পুরো ফ্রেন্ড চার্কেল আসছে আমাদের বাসায়। রাত ১/২টা বাজে। আমরা সবাই মিলে উনো খেলছি। সাথে জালমুরী আছে। পেপসি, স্প্রাইট, ফ্রুটিকা মিস্ক করে কক্টেল বানিয়ে মাতলামির অভিনয় চলছে। তো আমার কাজিন অনলাইনে দেখে আমারে নক দিছে।
-কিরে ভাইয়া, কি করতচস যে এত রাতে???
-দাদার ফ্রেন্ডরা আসছে। কার্ড খেলতেছি আর মুড়ি খাচ্ছি। (ছবি ও তুলে পাটালাম)
-ওডা, এডে যাই ইন গরদ্দে নে!!! হাড়া আম্মি রে হইর। (ওখানে গিয়ে এসব করতচস, না? অপেক্ষা কর, আম্মুরে বলছি)
অই মুহুর্তে আমি জোবায়ের ভাই নামে একজনের গায়ে হেলান দিয়ে শুয়ে ছিলাম। এই ভাই মনে হয় ঢাকার ই ছিল। মনে নাই। তো সে এই লাইন্টা খেয়াল করে লাফাই উটল। যে এটা কি বলল তোর কাজিন। বাংলিশে ছিল লেখাটা। সে অনেক কষ্ট করে কোন ভাবে পড়ল লেখাটা ভুলভাল। আমি ঠিক করে দিলাম। অর্থ জানতে চাইল। তো এখন বিশ্বদা প্রস্তাব দিল তাদের অর্থ বের করতে। যদি তারা অর্থ কাছাকাছি ও বের করতে পারে তাহলে আমাকে নিচে গিয়ে সবার জন্য সিগারেট নিয়ে আস্তে হবে। আর যদি না পারে তাহলে কালকে সকাল আর দুপুরের খাবার তারা খাওয়াবে। ব্যাস, সবাই মিলে বসে গেল ডিকোডিং করতে। প্রায় ৫/৬ মিনিট পরে তারা অর্থ বের করেছিল কিছুটা এরকম - আমি হেটে হেটে তোর বাড়িতে যাচ্ছি আম্মুর সাথে। কীভাবে কোথা থেকে এই অর্থ বের করেছিল তারাই ভাল জানে। যাই হোক আমি তাদের বলে দিলাম অর্থ word by word.
তার কয়েকদিন পর তারা ভার্সিটি থেকে ট্যুরে গিয়েছিল কক্সবাজার। এই কাহিনি আমার তাদের মুখে শোনা। বিস্তারিত মনে নেই, সত্য কিনা বানোয়াট সেটা ও জানিনা। তো সারমর্ম ছিল এরকম - বিশ্বদা নাকি তাদের অন্যান্য বন্ধুদের এই গল্প শূনিয়েছিল। এবং বলেছিল প্রথম লাইনের অর্থ নাকি আমি তোমাকে ভালবাসি। এবং তাদের কোন এক লুইচ্ছা ফ্রেন্ড নাকি কক্সবাজারের কোন আঞ্চলিক মেয়েকে গিয়ে এই লাইন মেরে থাপ্পড় খেয়ে বসে। তারা অবশ্য অনেক লম্বা করে বলেছিল আমাকে এই কাহিনী। হাসতে হাসতে খুন হয়ে গিয়েছিলাম আমি।
৩/ এবারের কাহিনী মানিকের সাথে। তো মানিক রুম চেঞ্জ করে পাশের বিল্ডিং এ চলে যায়। ওর বাড়ি থেকে ওর দুরসম্পর্কের এক ভাগ্নে আর এক বন্ধু আসে ঢাকায়। তারা ছিল ওর নিউ রুমমেট। দুজনের বয়স ই আমাদের কাছাকাছি ছিল। তারা নিজেরাই রান্না করে খেত। মাসে একদুবার করা আসর বসাত খিচুড়ির। সেদিন সবাই মিলে খিচুড়ি রান্না করত। আর মানিকের বন্ধু সোহাগের খিচুরি ছিল অতুলনীয়। আমি আর সবকিছু বাদ, খিচুরীর লোভে হলে ও যেতাম। সেরকম ই একদিনের কথা। আমি বের হচ্ছি নাস্তা কিনতে। সোহাগ আমাকে কিছু বাজার ও কিনে নিয়ে আসতে বলে সাথে। আলু, মরিচ, কদু, তেল, ডিম, হাবি জাবি। আমি সবগুলো ঠিক মত নিয়ে আসি। এনে থলে খুলে সোহাগ গরম - তোর বন্ধুরে বললাম কদু আনতে, তোর বন্ধু লাউ নিয়ে আসছে। মানিক বলে সেইম কথা। তোরে লাউ আনতে কে বলছে। আমি তথমত। কদু আর লাউ-র মধ্যে পার্থক্য কী!!! জানতে পারলাম তাদের কাছে, লাউ মানে লাউ, কদু মানে মিষ্টিকুমড়ো। এটা একটা কথা!!!
৪/ আমরা চাটগাইয়ারা শুদ্ধ ভাষায় কথা বললে ও মাঝে মধ্যে দু-একটা চাটগাইয়া শব্দ মেরে দেই। একদিন আড্ডা মারছিলাম। মানিক কথা নাই বার্তা নাই দুম করে মেরে দিল আমারে একটা কিল। আমি গরম হয়ে গেলাম - "আত্তাম্মারেবাপ, আফসারাফ গায়ে হাত তুলস কেন!!!" এখন আফসারাফ মানে হচ্ছে কোন কারণ ছাড়া। এটা যে বাংলা না সেটা আমি সেদিন ই প্রথম জানতে পেরেছিলাম। কারণ আমার কথা শুনে মানিকের প্রতিক্রিয়া ছিল - আফসারাফ এটা কে!!!
এইখানে আরেকটা মজার কাহিনী ঘটেছিল "আত্তাম্মারেবাপ" শব্দটা নিয়ে। এটা ছিল আমদের গালি যে - "তোর মারে বাপ"। কিন্তু দ্রুততা আর চাটগাইয়া টানের কারণে এটা শোনাত এরকম। এখন আমি এটা প্রচুর ব্যাবহার করতাম। কথায় কথায় ব্যাবহার করতাম তখন, আল্লাহ মাফ করুক। প্রায় দু-বছর পর জানতে পেরেছিলাম থার্ড ইয়ারে উটে, মানিক এতদিন এটাকে "ধ্যাততারিকা"র মত নরমাল রিএকশন মনে করে এসেছিল। তার কোন ধারণাই ছিল না যে এটা গালি।
৫/ চায়ের দোকানে বসে আড্ডা মারছি মানিকের সাথে। পিছনের সিটে বসে দুজন কায়্যিক শ্রমিক গল্প করছে। হঠাত করেই শুনলাম যে একজন বলছে - "কালা গু খাইতম ন। ভালা লাগে না। লাল গু ই ভালা তার থেইকা।" আমার আর মানিকের বমি চলে আসার অবস্থা কথা শুনে। তো তারা ছিল সিলেটি। বিশ্বদার সাথে সাথে থাকতে হালকা ধারণা হয়ে গিয়েছিল সিলেটি টানের সাথে। তো বিশ্বদারে গিয়ে এই কাহিনী বললে, বিশ্ব দা ডিকোডিং করে দিল যে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় নাকি গু মানে মিষ্টি। লাল গু মানে লালমোহন, আর কালা গু মানে কালোজাম। বুঝেন অবস্থা
এরকম আরো অনেক মজার কাহিনি আছে। ভাল-গম নিয়ে, পুকুড় আর ফইড় নিয়ে, অগণিত মজার এক্সপেরিয়েন্স হয়েছে আমার অনার্সের ৪/৫ বছরে এই আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে। সব বলা পসিবল না। সব মনে ও নেই। যেগুলো বেশী মনে আছে সেগুলোই উল্লেখ করলাম।
বাই দ্যা ওয়ে, সকল ছবি গুগল থেকে কালেক্টেড, কোন ছবি ই আমার তোলা না।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:২১