।। মা যখন অলৌকিক
---- পল্লব কীর্ত্তনীয়া ।।
এসব হচ্ছেটা কী ! মাদার টেরিজাকে সন্ত অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দিল রোমের ভ্যাটিকান। মাদার ঈশ্বরের প্রতিনিধি না হয়ে রক্তমাংসের মানব প্রতিনিধি হলে পার্থক্য কী হত তা নিয়ে কলকাতার আর্চ বিশপ হাউসের ফাদার ডি কস্টা মিডিয়ায় কী বলেছেন উদ্ধৃত করি :
'অনেক ফারাক হয়ে গেল। এখন থেকে ঈশ্বরের কাছে আমাদের প্রার্থনা, আমাদের মনের কথা পৌঁছে দেওয়া অনেক সহজ হয়ে গেল। আমরা এমন একজনকে পেলাম যিনি... ঈশ্বরের নির্বাচিত একজন মানুষ...আমরা তাঁর কাছেই প্রার্থনা জানাতে পারব। তিনি সরাসরি পৌঁছে দেবেন ঈশ্বরের কাছে।'
অর্থাৎ ঈশ্বরের কাছে ঠিকঠাক প্রার্থনা পৌঁছতে হলে একজন এজেন্ট লাগে ! সর্বশক্তিমান(?) ঈশ্বরকে তাহলে এরকম এজেন্টদের ওপর নির্ভর করতে হয়? তাই যদি সত্য হয় তাহলে সর্বশক্তিমান কথাটাই তো অর্থহীন হয়ে যায় ফাদার ! পেটের ভেতর কেমন একটা হাসি গুড়গুড় করে উঠছে না?
কিন্তু আমি হাসতে পারছি না, বরং শংকা হচ্ছে, আমার তিন বছর তিন মাস বয়সী শিশু পুত্রকে মধ্যযুগীয় অন্ধ বিশ্বাসের জগতে পৌঁছে দেবার শংকা।
ভেবে দেখুন মাদারের এই সন্ত হওয়া তাঁর মানবসেবার কারণে নয়। তিনি নাকি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী তাই আজ তাঁকে ঈশ্বরের প্রতিনিধির স্বীকৃতি। তাঁর মাথার চারপাশে এখন থেকে থাকবে ঐশ্বরিক আলোর বলয় ! দক্ষিণ দিনাজপুরের মণিকা বেসরা আর ব্রাজিলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যুবকের দাবি তাঁদের টিউমার নাকি মাদারের অলৌকিক ক্ষমতার প্রভাবে ভালো হয়ে যায়। কোন প্রামাণ্য বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই এঁদের দাবিকে মান্যতা দিয়ে মাদারকে অলৌকিক বানিয়ে দিলেন পোপ। যদিও মণিকার ডাক্তাররা দাবি করেছিলেন যে যক্ষ্মা থেকে তাঁর পেটে একটা সিস্টের মত হয়েছিল, দীর্ঘ দিন যক্ষ্মার ওষুধ খাওয়ায় তা সেরে যায়। কিন্তু ডাক্তারদের সেই দাবি মিডিয়ার প্রবল সন্তীয় প্রচারের ঢক্কানিনাদে কোথায় যে ভেসে গেল !
বিপদটা এইখানে। 'মাদার এই কলকাতার গর্ব, এই বাংলার গর্ব, পৃথিবীর দরবারে এই দেশের মুখ আলোয় ভরিয়ে তুলেছেন আজ' মার্কা প্রচারে ভেসে যাচ্ছে মিডিয়া। মাদারের মানবসেবা সারা পৃথিবীতে অনন্য করেছে তাঁকে। আমাদের কাছে সেই গর্বের চেয়ে বড় আর কী হতে পারে ! তাঁর নোবেল প্রাপ্তিই তো পৃথিবীর কাছে সেই গর্বকে স্বীকৃত করেছে। মাদারের ওপর আজকের এই অলৌকিকত্ব আরোপ নিয়ে লাফালাফি তাহলে কোথায় পৌঁছে দিচ্ছে আমাদের ভেবে দেখছি কি একবারও? বিপদটা এইখানে ! আমাদের রাজনৈতিক দেশনায়করা এই অলৌকিক ক্ষমতার প্রচারকে মেনেই শুধু নেন নি, তাকে প্রবল মান্যতা দিয়েছেন। এই অলৌকিক অনুষ্ঠানে কেন্দ্রের বিদেশমন্ত্রী, দিল্লী এবং এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীসহ ১০০ জন নেতা-মন্ত্রী-আমলাদের প্রতিনিধি দল ভ্যাটিকান আলো করে তুলেছেন। কিন্তু তাঁরা কি একবারও ভেবেছেন বিজ্ঞান মনস্কতাকে দূরে ফেলে মানুষের এই তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতাকে যদি প্রশ্নাতীত মেনে নেওয়া হয় তাহলে যে কোন তাবিজ-কবজ-মাদুলি, গ্রহ-নক্ষত্র-পাথর ধারন, রংবেরঙের বাবাজী-মাতাজীর লোক ঠকানো ঝাড়ফুঁক, বশীকরণ, চাল পড়া খাওয়ানো থেকে শুরু করে টিভিতে দেখানো ধনলক্ষ্মী যন্ত্র (এ নাকি ধারন করলে ধনপ্রাপ্তি অনিবার্য, টিভিতে চিত্র তারকারা টাকা নিয়ে হাসিহাসি মুখ করে তাঁরা কত উপকৃত হয়েছেন তাঁর বিবরণ দেন)--- এইসব কিছুকেই মান্যতা দিতে হয়। বিজ্ঞান-মননকে দেশসেবক (!) জনপ্রতিনিধিরা এভাবে ফুৎকারে উড়িয়ে দিলে মধ্যযুগের অন্ধকার কী অনিবার্য ঘনিয়ে আসে এই বিপুল নিরক্ষরের, কুসংস্কারে আকণ্ঠ নিমজ্জিতের দেশে। দেশের এই নেতা-মন্ত্রীরা কী সত্যিই বোঝেন না এবার থেকে সাপে কাটলে কেউ যদি হাসপাতালে না নিয়ে কোন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন বাবাজীর কাছে ঝাড়ফুঁকের জন্য নিয়ে যায় বা কঠিন রোগাক্রান্ত স্বজনকে যদি ডাক্তার না দেখিয়ে কোনো মাতাজীর চরণামৃত বা বাবাজীর ধুলোপড়া খাওয়ায় তাহলে তাকে বোঝানোর কোন যুক্তিই থাকে না সরকারের কাছে? কোনো আদিবাসী গ্রামে যদি ডাইনির অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাসী জনগণ কাউকে পিটিয়ে মারে কী যুক্তি দেওয়া হবে তাদের? মানুষ-মাদারের ভালো করার অলৌকিক ক্ষমতা যদি সত্যি হয় তাহলে কোনো মানুষ-ডাইনির খারাপ করার অলৌকিক ক্ষমতাও তো সমান সত্য হয়ে ওঠে! সেটা কুসংস্কার বলে মণিকা বেসরার গ্রামের মানুষ মানবে কেন এখন?
এই দেশসেবকদের বাড়ির কিশোর কিশোরীরা কী শিখছে এই ঘটনা থেকে সেটা জানতে ইচ্ছে করে। তাদের কী বোঝানো হয় আধুনিক পৃথিবীর বিজ্ঞান-মনস্কতাকে ছুঁড়ে ফেলে মধ্যযুগের অন্ধতাকে মেনে নিতে? কিন্তু তারা যদি প্রশ্ন করে মাদারের এই অলৌকিক ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কোটি কোটি আর্ত মানুষের ভেতর কেন দুজন মাত্র উপকৃত হলেন তখন নিশ্চয়ই তাদের বলা হবে, 'ওরে ভোটের জন্য এসব ধর্ম ধর্ম ভেক একটু আধটু ধরতেই হয়, চেপে যা বাপ ! এদ্দিনেও অ্যাকস্টমড্ হতে পারলি না? ধর্ম কেসটা হেব্বি সেন্সেটিভ। যে ধর্মের জল যেদিকে গড়ায় সেদিকে বালতি নিয়ে ছুটবি, ফস্কে না যায় ভোট। ধর্মের নামে কোন প্রশ্ন করতে নেই!'
কোন দলের একজন নেতাকেও বলতে শুনলাম না, 'এভাবে কিছুতেই কোন ক্যানসারের টিউমার সারানো সম্ভব নয়। টিউমার হলে মন্দির-মসজিদ-গির্জা নয় ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।' ভোটের বালাই সব মিথ্যেকে সত্য আর সব সত্যকে মিথ্যে করে দিতে পারে !
দেশনেতাদের বাড়ির ছোটরা এই সন্তায়নে কী শিখবে জানিনা কিন্তু আপনার আমার ঘরে যে মানুষের অলৌকিকত্বে যুক্তিহীন বিশ্বাস আর প্রশ্নহীন অন্ধ ভক্তির বন্যা বইবে এ আমি নিশ্চিত। আমাদের হাতে রঙবেরঙের পাথর বসানো আংটি আরও একটু চেপে, দৃঢ় হয়ে বসবে।
কিন্তু এই ধর্মান্ধতাই কি শেষ কথা বলবে? বোধহয় না। ইয়োরোপে ঈশ্বর এবং ধর্মের অন্ধতায় অবিশ্বাসীদের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। bbc.com -এ কন্টিনেন্টের এই সংক্রান্ত একটা পরিসংখ্যান চোখে পড়ল :
" ২০১৪ সালের ‘ব্রিটিশ সোশ্যাল অ্যাটিচুড’ সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে এখন নাস্তিক বা কোন ধর্মের অনুসারী নন এমন মানুষ ৪৮ দশমিক পাঁচ শতাংশ।
২০১১ সালের সমীক্ষায় এই সংখ্যা ছিল ২৫ শতাংশ। তখনো পর্যন্ত খ্রীষ্টানরাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ।
এর আগের এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল স্কটল্যান্ডেরও ৫২ শতাংশ মানুষ বলেছেন তারা মোটেই ধার্মিক নন। "
ধর্ম- মোহমুক্তির এই প্রবল ঢেউ রুখতে ধর্মের চাই অলৌকিক ক্ষমতা। সেই অলৌকিকের প্রচারে প্রসারে যত দীর্ঘ করা যায় সাবেক ধর্মের মৌরসিপাট্টা। আর তাই আগামীতেও আরও সন্তায়ন আমরা দেখব আশা করতে পারি। আর সেদিনও হয়তো এদেশের মন্ত্রীসান্ত্রীর বিরাট প্রতিনিধি দল উদ্বাহু উপস্থিত থাকবে রোমে আর ভ্যাটিকানের আকাশ শুনবে রবীন্দ্রসুর !
(Pallab Kirtania Page নামক ফেবু পেজ থেকে সংগ্রহ করা )
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ভোর ৪:৫০